এজেন্সি
মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ঈমানের শর্ত

মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ঈমানের শর্ত

মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ঈমানের শর্ত

ড. আহমাদ শাফাআত :
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা একজন ঈমানদারের ঈমান তথা বিশ্বাস এবং অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিমাপক। আমাদের ঈমান শুধু তখনই সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হবে যখন নবীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা এ দুনিয়ার সকল কিছু, এমনকি আমাদের নিজ জীবন অপেক্ষা অধিক হবে। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী, ঈমানদারদের নিকট মহানবী (সা.) এমনকি তাদের নিজ জীবন অপেক্ষাও অধিক অগ্রগণ্য হবেন। (সূরা আহযাব : ৬)
এটি সংজ্ঞায়িতকরণ স¤পর্কিত একটি বাক্য, যা আমাদেরকে বাতলে দিচ্ছে ঈমানদার হওয়ার মানে কী অর্থাৎ মহানবী (সা.)-কে গুরুত্ব প্রদান করা, এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষা। এটা নিশ্চিতকরণে উল্লেখ্য যে, নবী করীম (সা.) এক হাদিসে বলেন : ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে আমি নিজ সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, এমনকি সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা প্রিয়তর হব।’ (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য রেওয়ায়াতে আরো বর্ণিত আছে : ‘তার জীবন, তার সম্পত্তি এবং তার পরিবার (অপেক্ষা)।’
মুমিনদের মধ্যে যারা উত্তম সেই সকল সাহাবি, বিশেষত যাঁরা ছিলেন শ্রেষ্ঠতমদের অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা নবীজীর প্রতি এ রকমেরই ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। মদিনার জনগণের পক্ষ হতে নবী করীম (সা.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁরা বলেন : ‘মহানবী (সা.) আমাদের নিকট আমাদের সহায়-স¤পত্তি, সন্তানাদি, পিতামাতা, পূর্বপুরুষ এবং প্রচ- পিপাসার্ত অবস্থায় ঠাণ্ডা পানি অপেক্ষা প্রিয়তর।’
নবী (সা.)-এর প্রতি এরূপ ভালোবাসার অর্থ
কোনো কোনো অবস্থায় এটা বেশ ¯পষ্টভাবেই বুঝতে হবে যে, মুমিনরা নবীজীকে এভাবেই ভালোবাসবে : কারণ, তিনি তো তাদের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং নেতা, আর তাঁর পক্ষে শিক্ষা দেওয়া, পথপ্রদর্শন করা এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব যদি তারা তাঁকে ভালো না বাসে। তবে ঈমান-এর জন্য নবীর প্রতি ভালোবাসা অতীব প্রয়োজনীয়- এই নীতির আরও গভীর অর্থ আছে।
মহানবীর প্রতি ভালোবাসার অর্থ হলো চরিত্রের সকল সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, নম্রতা এবং অন্তঃশক্তি থাকা, যা মানুষ অর্জন করতে পারে এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে যা নবী করিম (সা.)-এর ছিল উচ্চতম মাত্রায়। মহানবীর প্রতি ভালোবাসা মানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ভিতরে যে সকল কল্যাণ ও মহত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন সে সবকিছু গ্রহণ এবং লালন করা ও সেগুলোর মহিমা প্রকাশ ও প্রচার করা।
এর আরও অর্থ হলো এই যে, মানবতাকে ভালোবাসা। শুধু এজন্য নয় যে, মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণতার সম্ভাবনা রয়েছে; বরং এই সম্ভাবনার বিষয়টি উপলব্ধিতে মানুষের যে সাধারণ অক্ষমতা রয়েছে এবং তার নিজের আর যেসব ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে সেগুলো সত্ত্বেও তাঁকে ভালোবাসা। কেননা, নবী করীম (সা.) শুধু পরিপূর্ণ ও নিখুঁত মানুষ ছিলেন তা নয়, তিনি হাশরের দিনে আল্লাহর সামনে মানবজাতির প্রতিনিধিত্বও করবেন এবং তাদের পক্ষে সুপারিশও করবেন তাদের অপূর্ণতা ও দুর্বলতার জন্য।
এভাবে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা আমাদেরকে মনে-প্রানে পূর্ণতার আকাক্সক্ষা লালনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জনের পথে নিয়ে যায়, অন্যদিকে এটি আমাদের অপূর্ণতাকে মেনে নেয়ার এবং আল্লাহ্র অনুতপ্ত বান্দা হিসেবে তাঁর করুণা লাভে আশান্বিত হয়ে নিজের মধ্যে শান্তিতে থাকার প্রেরণা যোগায়। এ কারণেই নবীর প্রতি ভালোবাসা ঈমানেরই শর্তবিশেষ। কেননা, ঈমান তাহলে কী, যদি না তা আমাদেরকে আমাদের অসম্পূর্ণতা আর দুর্বলতাগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে সেগুলোর জন্য অনুশোচনা করতে এবং অর্জন-অযোগ্য মনে হলেও পূর্ণতা অর্জনে উৎসাহিত করে? আর পূর্ণতা একেবারেই অর্জনাতীত কিছু নয়; বরং মানুষের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণতা অর্জনের যোগ্যতা দিয়েই রেখেছেন।
ঈমানের দুটি ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসংযুক্ত দিক রয়েছে : একটি হচ্ছে ঐশী দিক যাতে আল্লাহকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং তাঁর সাথে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখা হয়। অপরটি হলো : নিজেকে বা নিজের পরিচয়কে চেনা বা জানা এবং নিজের সাথে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখা। এ দুটি দিক যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ; একটিকে ছাড়া আরেকটি টিকতে পারে না। আল-কোরআন এবং হাদিসের বেশ কিছু বর্ণনায় এ দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ : মহানবী (সা.) এক হাদিসে বলেন : ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকেও চিনেছে।’ বিষয়টি আরেক দিক থেকে বিবেচনা করে আল-কোরআনে বলা হয়েছে : ‘…যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’ (সূরা হাশর: ১৯)
ইসলাম শব্দের অর্থ হলো : আল্লাহ্র সাথে বোঝাপড়ার সম্পর্ক যাকে কোরআনে সেই আত্মার সাথে তুলনা করা হয়েছে যে নিজের সাথে শান্তি স্থাপন করে চলে।
মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ঈমানের মানবিক দিক প্রতিফলিত হয়। মানুষ হিসেবে মহানবী (সা.) একজন ঈমানদারের সত্যিকারের পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীর প্রতি তার ভালোবাসার অর্থ সে তার সত্যিকারের নিজ সত্তাকে চিনতে পেরেছে এবং সে তার নিজের সাথে শান্তিতেই আছে।
এর মানে হলো যে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে যার নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সে তাঁর সাথে শান্তিতেই আছে।
নবী করীমও (সা.) আমাদেরকে ভালোবাসতেন
ঈমানদারগণ যদি মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসেন তবে এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা কিন্তু প্রথম নয়। নবী করীমই সর্বপ্রথম ঈমানদারদেরকে ভালোবাসেন। আল-কোরআনই এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে এভাবে : ‘(নবী) তোমাদের ক্ষতিতে অত্যন্ত মর্মাহত; তিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য যার পর নাই উদ্বিগ্ন। ঈমানদারদের জন্য তিনি অত্যন্ত দয়ার্দ্র আর রহমদিল।’ (সূরা তাওবা : ১২৮)।
মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা শুধু যে ঈমানদারদের মধ্যে সীমিত ছিল তা নয়, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিকেই তিনি ভালোবাসতেন। আল্লাহ তা‘আলা আল-কোরআনে বলেন : ‘আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি (হে নবী) সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)
একথা ঠিক যে, মহানবী (সা.)-কে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল যারা নিজেদের ওপর জুলুম করার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তাদেরকে তিনি দোজখের তিক্ত বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এটাও ছিল তাদের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা থেকে, শত্রুতা কিংবা ঘৃণা থেকে নয়। যে সকল লোক নিজেদের ধ্বংসের পথে পা বাড়ায়, তাদেরকে তাদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া সব সময়ই একটি সহজ কাজ বটে। পক্ষান্তরে তাদেরকে ধ্বংসের সেই পথ থেকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন প্রচ- ভালোবাসা আর সৎসাহস। আর ঠিক এ কাজটাই করার চেষ্টা করে গেছেন মহানবী (সা.)। তিনি এ কাজে সফলও হয়েছিলেন জীবনের শেষ দিকে। এমনকি তাঁর শত্রুদের ক্ষেত্রেও তিনি যে রহমতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেটা সহজেই বুঝা যায় যখন মক্কা বিজয়কালে তিনি তাদের সকলকেই কত সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!
মহানবী (সা.) মানবতার জন্য কীভাবে কষ্ট ভোগ করেছিলেন
মানবজাতির জন্য মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসার একটি নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তাঁর বিরোধীদের হাতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের স্বীকার হয়েও তাদেরকে তাঁর বিজয়ের পর অবলীলায় ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
মহানবী (সা.) যখন তাঁর নবুওয়াতি মিশনের কাজ শুরু করেন, তখন তাঁর শহরের প্রায় সকল লোকই তাঁর বিরোধিতা করে যদিও তারা তাঁর জীবনের শুরু থেকেই তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী সৎ এবং বুদ্ধিমান লোক হিসেবেই জানত। প্রথমদিকে তারা মৌখিকভাবে তাঁকে আক্রমণ এবং তিরস্কার ও অপমান করতে থাকে। পরে তারা মৌখিক আক্রমণের সাথে দৈহিক আগ্রাসনও যুক্ত করে দেয়। তারা তাঁর পথের ওপর কাঁটা ছড়িয়ে দিত, তাঁর গায়ে ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। একবার তিনি যখন ঘরে ফিরলেন তখনও তাঁর মাথায় ধুলোমাটি লেগেই ছিল। তাঁর মেয়ে অশ্রুসজল নেত্রে সেই ধুলোবালি মুছে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তাঁর সমাজের মানুষেরা তাঁর সাথে যে আচরণ করেছে সেজন্য যতটা না কষ্ট পেয়েছিলেন তার চেয়ে অধিক কষ্ট পেয়েছিলেন নিজ কন্যার চোখে অশ্রু দেখে। তিনি এই বলে কন্যাকে সান্ত¡না দেন : ‘কেঁদো না, মা আমার! আল্লাহই তোমার বাবার সহায় হবেন।’
একবার তাঁর শহরের লোকজন নবী করীম (সা.)-এর ওপর ভিন্ন এক ধরনের আঘাত হানার চেষ্টা করল। একদিন নবীজী (সা.) কাজের লোক খুঁজতে বের হলেন। একটা লোকও তাঁর দিকে তাকালো না, কিংবা কথাও বলল না বা তাঁকে তিরস্কার বা অপমানও করল না। বাকহীন ভাষায় তারা নবীজীকে বুঝাতে চাইল : ‘তুমি আমাদের কেউ নও, কারণ, তুমি আমাদের ঐতিহ্যগত প্রথার বিরুদ্ধে কথা বল।’ আগে থেকে তিনি যেসব তিরস্কার ও অপমান সয়ে অভ্যস্ত ছিলেন এই ব্যাপারটাতে তিনি তার চেয়েও বেশি আহত হলেন।
মহানবী (সা.) যখন অনুভব করলেন যে, তিনি মক্কাবাসীদের সাথে পেরে উঠছেন না, তখন তিনি হজ উপলক্ষে মক্কায় আসা বাইরের লোকদের দিকে অধিকহারে নজর দিতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু আবু লাহাবের মতো লোকদের কারণে মক্কায় আগত তীর্থ যাত্রীদের মধ্যে তাঁর তৎপরতা বিফল হতে লাগল। আবু লাহাব নবীজীর পিছনে পিছনে যেত আর চিৎকার করে বলত : ‘এই লোককে বিশ্বাস করো না, সে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক।’ একদিন নবীজী বিশেষভবে দুঃখভারাক্রান্ত হলেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না, শুধু ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘হে প্রভু! আপনি না চাইলে এমন হতে পারত না!’
৬২০ খ্রিস্টাব্দে নবীজী (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি মক্কার বাইরে গিয়ে তাঁর বাণী প্রচার করবেন যাতে মক্কার বাসিন্দারা তাঁকে অনুসরণ করতে না পারে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তায়েফকেই তাঁর প্রথম পছন্দ হিসেবে নির্বাচন করে। মক্কা থেকে ৬০ মাইল পূর্বে অবস্থিত এই তায়েফ ছিল নিকটতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। তায়েফের পথে ভ্রমণে যায়েদ ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। উঁচু-নিচু, পাহাড়-পর্বতসহ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে নবীজী (সা.) এক ক্লান্তিকর ভ্রমণে বের হলেন। তায়েফে তিনি ১০ দিন থাকলেন। গোত্রপ্রধান এবং সাধারণ মানুষের নিকট তাঁর বাণী পৌঁছালেন। কিন্তু তারা সবাই এ বলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল যে, নতুন এক ধর্মের জন্য তারা মক্কাবাসীদের সাথে স¤পর্ক নষ্ট করতে চায় না। যতই দিন যেতে লাগলো তায়েফবাসী ততই তাঁর ওপর চড়াও হতে থাকল। অবশেষে ১০ম দিনে তারা তাঁকে পথে পথে তাড়া করতে আর তাঁর ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগল। এমনকি তিনি যখন শহর ছেড়ে চলে আসছিলেন, উত্তেজিত জনতা তাঁর পিছু নিল এবং তাঁকে তপ্ত মরু-বালুর মধ্য দিয়ে তাড়া করে মাইল তিনেক দূরে পাহাড়ের পাদদেশে না পৌঁছা পর্যন্ত ধাওয়া করতে থাকল। তখন তাঁর দুই পা থেকে রক্ত ঝরছিল। ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় রক্তমাখা পায়ে তিনি একটা বাগানে আশ্রয় নিলেন। যায়েদ নবীজীর প্রতি নিক্ষিপ্ত পাথর থেকে নবীজীকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে নিজেই মাথায় পাথরের আঘাতে আহত হলেন।
কয়েক বছর পর নবীজী আরবের অন্যতম শহর মদিনায় যথেষ্ট সমর্থন লাভে সক্ষম হলেন। তিনি সেখানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন। কিন্তু মক্কাস্থ তাঁর শত্রুরা তাঁকে মদিনায় হিজরতের আগেই জানে মারার ষড়যন্ত্র করল, যা সফলতার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি শত্রুতাপূর্ণ মক্কা থেকে তুলনামূলক বন্ধুভাবাপন্ন মদিনায় হিজরতের পরও মহানবীর দুর্ভোগ চলতেই থাকল। কুরাইশ বংশ এবং তাদের প্রভাবাধীন অন্যান্য আরব গোত্র তাঁর ও
তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ বাধাতে থাকল। মদিনাতেও ইহুদিরা তাঁর ওপর ক্ষেপে গেল এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগল, এমনকি এক সময় নবীজীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার উদ্যোগ নিতেও কুণ্ঠিত হলো না। মুনাফিকরা ছিল নবীজীর গোপন শত্রু; তারা মুসলমান হওয়ার ভান করত মাত্র। তারাও ষড়যন্ত্র এবং নবীজীর বিরুদ্ধে কানাকানি শুরু করে দিল। এসবের একটি নোংরা উদাহরণ হলো তারা নবীজীর স্ত্রী হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে চরিত্রগত অভিযোগ তুলল, যা নবীজীর জন্য যেমন বেদনাদায়ক ছিল তেমনি ছিল হযরত আয়েশার জন্যও। কখনো কখনো মুমিনগণও অনিচ্ছাসত্ত্বেও নবীজীর জন্য কষ্টের কারণ ঘটাত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তারা কখনো কখনো অভদ্রজনোচিতভাবে নবীজিকে একা ফেলে রেখে তাঁর কাছ থেকে চলে যেত আর তিনি একা একা দাঁড়িয়ে থাকতেন। আল-কোরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতই এ কথার সাক্ষ্য বহন করে:
‘তারা যখন কোন ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা ক্রীড়াকৌতুক দেখে, তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে যায়…’ (সূরা জুমআ : ১১)
অনেক বছর ধরেই মহানবী (সা.) এই সকল এবং এ রকম আরও বহু দুর্ভোগের স্বীকার হয়েছেন। নবুওয়াতি মিশন শুরুর আগে মানুষ সাধারণভাবে যা আশা করতে পারে এমন সবকিছুই তাঁর ছিল। সুস্বাস্থ্য, সমৃদ্ধ ব্যবসা, সুন্দরী স্ত্রী, সুন্দর সুন্দর সন্তানাদি, বিশ্বস্ত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং সে সাথে ছিল নিজ এলাকাবাসীর আস্থা ও শ্রদ্ধা। চাইলেই তিনি মক্কায় অন্য যে কারো মতো আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কষ্ট আর দুর্ভোগের রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন। আর তিনি তা করেছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য এবং তাদের জন্য যারা অজ্ঞতাবশত তাঁকে নির্যাতন-নিপীড়নের স্বীকার বানিয়েছিল।

মহানবী (সা.)-এর কষ্ট-দুর্ভোগের অর্থ

মহানবীর জীবনের অন্য সকল দিকের মতো তাঁর কষ্ট-দুর্ভোগের মধ্যেও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আছে। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো যে, এই দুনিয়া হচ্ছে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং সুবিচার-অবিচারের মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র; যদিও আল্লাহ চান, পরিণতিতে ভালো বা শুভ, সত্য ও সুবিচারেরই জয় হবে। তিনি এও চান যে, এই বিজয় অতটা সহজ হবে না।
মহানবীর দুর্ভোগের মধ্যে এই মর্মে আমাদের জন্য রয়েছে ¯পষ্ট স্মরণিকা যে, মানুষের মধ্যে যেমন আছে প্রচণ্ড শুভ ও কল্যাণময়তা, তেমনি আছে বিশাল অশুভ ও খারাপের সম্ভাবনাও। মানুষের মধ্যে শুভ ও কল্যাণের যে উচ্চতম সম্ভাবনা রয়েছে মহানবী (সা.) ছিলেন সেই সম্ভাবনার প্রতীক। অপর দিকে, তাঁর বিরোধীরা ছিল ঠিক বিপরীত, অর্থাৎ সকল অকল্যাণ আর খারাপের প্রতীক। মহানবী (সা.) অবশ্য তাঁর আদর্শের বিরোধীদের এবং তাদের অশুভ তৎপরতাকে নিজ ভালোবাসা আর প্রজ্ঞার মাধ্যমে জয় করেছিলেন। তবে যারা মহানবীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরকে নিন্দা করা আমাদের উচিত হবে না। কেননা, যে অজ্ঞতা আর গোয়ার্তুমীপূর্ণ লোকেরা মহানবীর দুর্ভোগের কারণ ছিল তা আমাদের সবার মধ্যেও আছে। কে জানে, আমাদের মধ্যকার কেউ মহানবীর জামানায় মক্কায় থাকলে সেই নবীজীর ওপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ কিংবা তাঁকে নির্যাতন করত না? না, মহানবী (সা.) এজন্য কষ্ট ভোগ করেন নি যে, আমরা কাউকে নিন্দা করব। তিনি ভুক্তভোগী হয়েছিলেন এ জন্য যে, আমরা যেন আশাবাদী আর বিনয়ী হই। তিনি দুর্ভোগ সয়েছিলেন এ জন্য যে, আমরা যেন আমাদের ভিতরে শুভ ও কল্যাণ কতখানি আছে তা খুঁজে নিতে পারি এবং একইভাবে খুঁজে বের করি সকল পাপের মূল কারণ অজ্ঞতা আর একরোখা ভাব কতখানি আছে। আমাদের ভিতরকার এ দুটি জিনিসেরই সম্ভাবনা আমাদেরকে দেখে নিতে হবে। প্রথমটি আমাদেরকে আমাদের এবং সাধারণভাবে মানুষের ভাগ্যে আশা যোগায় আর দ্বিতীয়টি আমাদেরকে বিনয়ী করে তোলে। আর সমৃদ্ধি অর্জনে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো বিনয় এবং আশা।
এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, ====== মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণে আমাদের চিন্তা করা উচিত যে আমাদের সকলের ভিতরেই অশুভ-অকল্যাণের সম্ভাবনা আছে এবং সেই সাথে ঐ অকল্যাণকে আমাদের দমনও করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। পাপচিন্তাকে দমন করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে মহানবীকে ভালোবাসা। কেননা, আমরা যত বেশি তাঁকে ভালোবাসব তত বেশি আমরা আমাদের ভিতরকার নেকচিন্তাকে শক্তিশালী করব এবং ঠিক ততই আমরা পাপচিন্তাকে দমন করতে সক্ষম হব। =====

মহানবী (সা.)-কে মহিমান্বিত করা

মহানবী (সা.)-এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করা যেতে পারে তাঁকে মহিমান্বিত করা ও তাঁর ওপর দরুদ ও সালামের মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে সালাত আলান্নাবী এর মতো একটিমাত্র পরিভাষার সাহায্যে তিনটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। আরবি সালাত আলা তিনটি অর্থ প্রকাশ করে থাকে :
১. ভালোবাসা ও অনুরাগের সাথে কারো প্রতি মনোযোগী হওয়া
২. কাউকে মহিমান্বিত করা বা তাঁর প্রশংসা করা
৩. কাউকে আশীর্বাদ বা অনুগ্রহ করা।
উপরিউক্ত আয়াতে সবগুলো অর্থ একসাথে মিলিয়ে আয়াতটির অনুবাদ করা যায় এভাবে :
‘নিঃসন্দেহে, আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করে; হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ কর আর তাকে যথাযোগ্য সম্মানে সালাম করো।’ (সূরা আহযাব : ৫৬)
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ কীভাবে নবীর ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করেন আর আমরাই বা কীভাবে তা করি?
ন্যূনতম যেভাবে আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসেন তা হলো এই যে, যে-ই তাঁকে অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। আল-কোরআন বলছে :
‘বলুন (মানবজাতিকে, হে মুহাম্মাদ!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন…” (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
আল্লাহ তা‘আলা আর কীভাবে নবী করিমকে ভালোবাসেন তা শুধু তিনিই জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে নবীকে মহিমান্বিত করেন সেগুলো নি¤œরূপ :
১. তিনি তাঁর নাম দিয়েছেন আহমাদ আর মুহাম্মাদ যার অর্থ মহিমান্বিত, প্রশংসিত।
২. তিনি অন্যান্য নবীর মাধ্যমে তাঁর আগমনের সুসংবাদ মানবজাতিকে দিয়ে এসেছেন। (সূরা আলে ইমরান : ৮১, সূরা আরাফ : ১৫৭, সূরা আনআম : ৬১)
৩. তিনি আসমান ও জমিনের বাসিন্দাদের মধ্যে তাঁর নাম ঘোষণা করে থাকেন : ‘আমরা আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’ (সূরা ইনশিরাহ : ৪)
আল্লাহ নবী (সা.)-কে আশীর্বাদ করে থাকেন মাঝেমাঝেই তাঁর মর্যাদা উন্নয়নের মাধ্যমে। মহানবীর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ন্যূনতম আশীর্বাদ হলো : তিনি তাঁকে সমগ্র মানবজাতির নেতা ও প্রতিনিধি বানিয়েছেন।
ফেরেশতাগণ মহানবীকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসেন যেভাবে একজন রাজার পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত চাকর রাজার প্রিয়ভাজনকে ভালোবেসে থাকে। তাঁরা জান্নাতে তাঁর নামের প্রশংসা করার মাধ্যমে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করে থাকেন। আল্লাহকে বেশি বেশি নবী করীমের ওপর দরুদ পাঠ করতে বলার মাধ্যমে মহানবীর ওপর আশীর্বাদ প্রেরণ করে থাকেন।
মুমিনগণ ন্যূনপক্ষে যেভাবে মহানবীকে ভালোবাসতে পারে তা হলো তাঁকে সেইভাবে ভালোবাসা যেভাবে মানুষ তাদের নেতাকে ভালোবাসে। আর যে রকম উত্তমভাবে তাঁকে ভালোবাসা যায় তা হলো তাঁর নামে নিজের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা।
মুমিনগণ যেভাবে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করতে পারে তা হলো কাব্যিক ভাষা ও গদ্যে তাঁর প্রশংসা করা, লেখনী ও কথার মাধ্যমে, রেডিও ও টেলিভিশনে, (আজকাল ইন্টারনেটে), মুসলমান ও অমুসলমানদের সমাবেশে ইত্যাদি।
মুমিনগণ যেভাবে নবীজীকে আশীর্বাদ করতে পারে সেটা হলো যে প্রচলিত যেসব বিভিন্ন রকমের দরুদ আছে সেগুলো পাঠ করা এবং আল্লাহর কাছে দোআ করা যেন তিনি নবীজীকে বেশি বেশি আশীর্বাদ করেন।
(কিছু কিছু ফকিহ বা মুসলিম আইনবিদের মতে, আলোচ্য আয়াতটির মর্ম অনুযায়ী জীবনে অন্তত একবার মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পড়লে তাঁর ওপর দরুদ পড়ার ক্ষেত্রে মুমিনদের দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। অন্যদের মতে, যত বার নবীজীর নাম উচ্চারিত হবে তত বারই দরুদ পড়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ ধরনের শুষ্ক আইনি ব্যাখ্যায় আয়াতটির প্রতি সুবিচার করা হয় বলে আমার মনে হয় না। ঈমানের দাবিই যদি হয় মহানবীকে আমাদের জীবনের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাঁকে ভালোবাসতে হবে আমাদের সন্তানাদি, পিতা-মাতা এবং সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা, তাহলে প্রথাগত একটা গৎবাঁধা ফর্মুলাকে ফরজ মনে করে কেন আওড়াতে হবে?)
দরুদ পাঠ : আয়াতটিতে মুমিনদেরকে যথাযথ সম্মানের সাথে নবীজীর ওপর দরুদ পড়তে বলা হয়েছে। দরুদ পড়ার মাধ্যমে আমরা নবীজীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। কেননা, সব ধরনের দরুদের মধ্যেই নবীজীর প্রতি প্রশংসাজ্ঞাপক ভাব আছে। এটা অবশ্য নবীজীকে সম্মান করার ন্যূনতম পন্থা। উত্তম পন্থা হলো নবীজীকে মনেপ্রাণে আমাদের নেতা হিসেবে এবং শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নেয়া আর তাঁকে আন্তরিক চেতনার সাথে মান্য করা।
মহানবী (সা.)-এর মহিমা প্রকাশে আমরা কতদূর অগ্রসর হতে পারি?
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্য সব প্রশংসাই উপযুক্ত যদি তা মহানবীকে একজন মানুষ এবং আল্লাহর সৃষ্টির পর্যায় থেকে ওপরে না উঠায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা ঘোষণা করতে পারি যে, মহানবী (সা.) আল্লাহর সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তিনি সকল সৃষ্টির সেরা ও মধ্যমণি। এই ধরনের প্রশংসাবাক্য যে নবী করীম (সা.)-এর ব্যাপারে প্রযোজ্য তার প্রমাণ পাওয়া যায় আল-কোরআনের ভাষ্য থেকে। কেননা, পবিত্র কোরআন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য মহানবীকে আল্লাহর রাসূল এবং সমগ্র মানবজাতির ওপর রহমত হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে অন্যান্য নবী-রাসূলের মিশন ছিল নির্ধারিত সময়কাল ও অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইসলামি আক্বিদার মধ্যে এও ¯পষ্ট যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আগেকার নবিগণের মিশনকে পরিপূর্ণ করেছিলেন যারা মাত্র আংশিক বা অসম্পূর্ণ অহি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাদিস থেকেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় যে, নবী মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সর্বসেরা নবী (কাজেই সৃষ্টির সেরা, যেহেতু মানুষ আল্লাহর উত্তম সৃষ্টি এবং সর্বসেরা নবীই আল্লাহর সেরা সৃষ্টি)। এভাবে হাদিসের সকল গ্রন্থ থেকেই আমরা যে বর্ণনা পাই তাতে দেখা যায় : মহানবী (সা.)-কে মেরাজের উদ্দেশ্যে যখন মক্কা থেকে জেরুজালেমের মসজিদে নেয়া হয় তখন পূর্বেকার সকল নবীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং তিনি তাঁদের সাথে ইমাম হিসেবে জামাআতে নামায পড়ান। আবার, সহিহ মুসলিম শরীফে ‘সমগ্র সৃষ্টির ওপর মহানবীর শ্রেষ্ঠত্ব’ শিরোনামে একটি অধ্যায় আছে এবং এতে এ মর্মে একটি হাদিসও আছে :
আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা.) বলেন : ‘বিচার দিবসে আমিই হব সকল আদম সন্তানের নেতা। আমার কবরকেই প্রথম উন্মোচিত করা হবে। আমিই প্রথম শাফাআতকারী হব আর আমার শাফাআতই সর্বপ্রথম গৃহীত হবে।’
কিছুসংখ্যক মুসলমান মহানবী (সা.)-কে সকল নবীর সেরা ঘোষণা করতে দ্বিধান্বিত হয়ে থাকে। কেননা, কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তারা মুমিনগণ আল্লাহর নবিগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না’ (সূরা বাকারা : ২৮৫)
কিন্তু পবিত্র কোরআন এও বলছে : ‘এ সকল রাসূলের মধ্যে আমরা কাউকে কাউকে অন্যদের ওপরে প্রাধান্য দিয়েছি।’ (সূরা বাকারা : ২৫৩)
অন্যান্য আয়াতকে উপেক্ষা করে যদি আমরা প্রথম আয়াতটির ওপরেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করি, তাহলে এটা ¯পষ্ট হয়ে যায় যে, পবিত্র কোরআন নবিগণের প্রকৃতি এবং তাঁদের অবস্থান বা মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য করে থাকে। প্রথম আয়াতটি আমাদেরকে বলছে যে, প্রকৃতির দিক থেকে বিভিন্ন নবীর মধ্যে কোন তফাত নেই : তাঁরা সকলেই এক সত্যপ্রভু কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিলেন, সকলেই আল্লাহর একই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন, সকলে মানুষ ছিলেন এবং এক খোদার নেক বান্দাদের একই ভ্রাতৃত্বের অংশ ছিলেন। দ্বিতীয় আয়াতটি বলছে যে, অবস্থান বা পদমর্যাদার দিক থেকে কোন কোন নবী-রাসূল অন্যদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
কাজেই, ==== এ মর্মে ঘোষণা দানের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই যে, নবী মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সকল নবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ; কাজেই তিনি ছিলেন মহত্তম মানুষ এবং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যমণি ও গৌরব। ===
কিছুসংখ্যক মুসলমান নবী করীম (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসাকে নিরুৎসাহিত করেন দুটি কারণে : এক, অতিরিক্ত ভক্তি-ভালোবাসা নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ এতে র্শিক-এর আশঙ্কা আছে; দুই, ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশের কারণে নবীজীর বাণী এবং আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
দ্বিতীয় আশঙ্কাটি ভিত্তিহীন। কেননা, নবীজীর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশ করা আল্লাহরই নির্দেশমাত্র। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘তাকে ভালোবাস, আশীর্বাদ করো আর তার প্রতি দরুদ পাঠ করো যথাযথ সম্মানের সাথে।’
মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ অবাধ্যতার দিকে নিয়ে যেতে পারে না। বস্তুত এটি বরং ঈমানের জন্যই প্রয়োজন। সত্যিকারের আনুগত্যের জন্যও এটি একান্ত প্রয়োজন।
প্রথম আশঙ্কাটির কিছুটা ভিত্তি আছে। সত্যি বলতে কি, নবীজী নিজেও আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে, বিশেষত যারা তাদের নবীদের প্রশংসায় অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট ছিল এবং নবিগণকে তারা খোদার আসনে বসিয়েছিল। এভাবে তারা শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিল যা সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ। তবে, র্শিক বা অংশী পূজার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নবীর প্রতি আমাদের ভক্তি-ভালোবাসার আগুনে শীতল পানি ঢেলে দেয়াও ভুল হবে। কেননা, সেটা হবে ঈমান ধ্বংস করে র্শিক ধ্বংসের শামিল, যা নিঃসন্দেহে অবিজ্ঞজনোচিত কৌশল।
ঈদে মিলাদুন্নবী (নবী করীম সা.-এর জন্মদিন) সহ অন্য আরো উপলক্ষসমূহে আমরা তাহলে আন্তরিক ও উদারভাবে এবং কৃপণতা না করে নবী করীম (সা.)-এর প্রতি আমাদের সেই রকম ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি যা স্বয়ং আল্লাহ বাদে অন্য কারো প্রতি করা যায়।
মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠের উপকারিতা
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরুদ প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম প্রেরণ করো উপযুক্ত সম্মানের সাথে।’ (সূরা আহযাব : ৫৬)
১. যে ব্যক্তি একবার নবীর ওপর দরুদ পড়বে আল্লাহ তার ওপর দশ বার আশীর্বাদ পাঠাবেন, তার দশটি গুনাহ মুছে দেবেন এবং তার মর্যাদা দশ গুণ বাড়িয়ে দেবেন। (মিশকাত)।
২. শেষ বিচারের দিনে ঐ ব্যক্তি আমার নিকটতম হবে যে এই নশ্বর দুনিয়ায় আমার ওপর সর্বাধিক দরুদ পাঠ করেছে। (তিরমিযি)
৩. (সত্যিই) ঐ ব্যক্তি কৃপণ যে আমার নাম উচ্চারিত হতে শুনেও আমার ওপর দরুদ পড়ে না। (মিশকাত)
৪. তোমরা তোমাদের সভাসমূহ অলংকৃত করো আমার ওপর দরুদ পড়ার মাধ্যমে। কেননা, শেষ বিচারের দিনে এই দরুদই তোমাদের জন্য ঐশী আলোয় পরিণত হবে। (জামিউস সাহিহ)
৫. শুক্রবার বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা, শুক্রবার হচ্ছে ‘সাক্ষী হিসেবে ফেরেশতাদের উপস্থিতির দিন’। এইদিন ফেরেশতারা আমার দরবারে হাজিরা দেয়। এবং নিঃসন্দেহে তোমাদের যে কেউ দরুদ পাঠ করবে, দরুদ পাঠ শেষ হওয়ার আগেই তা আমার দরবারে পৌঁছে যায়। (জামিউস সাহিহ)
৬. শুক্রবারের মহিমান্বিত রাতে অর্থাৎ বৃহ¯পতিবার ও শুক্রবারের মধ্যবর্তী রাতে এবং শুক্রবার দিবসে তোমরা আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়। কেননা, তোমাদের পাঠকৃত দরুদ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমার কাছে উপস্থাপিত হয়। (জামিউস সাহিহ)।
৭. শুক্রবার এবং শুক্রবার রাতে (বৃহ¯পতিবার ও শুক্রবারের মধ্যবর্তী রাত) তোমরা অধিক হারে দরুদ পাঠ করো। কেননা, যে-ই এমন করবে আমি তার সাক্ষী হব এবং শেষ বিচারের দিনে আমি তার পক্ষে কথা বলব। (জামিউস সাহিহ)
অনুবাদ : মিয়া আব্দুল আউয়াল

নিউজলেটার, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৭

মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ঈমানের শর্ত
মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মাহদী মাহমুদ

আমাদের নবী একজন মানুষ। ইসলামের মহানতম ব্যক্তিত্ব! সারা জগতের সেরা সৃষ্টি। অন্যদিকে, গৌতম বুদ্ধ, মহাত্মা গান্ধী, কনফুসিয়াস, শ্রী বিবেকানন্দ, লালন ফকির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন সমাজের আর দশজন থেকে একেবারেই অন্যরকম।

যেখানে আমাদের নবী ছিলেন গৃহি সেখানে অন্য অনেক মহাপুরুষ ছিলেন সন্ন্যাসী। তাঁদের কেউ কেউ বিয়ে-শাদী করেন নি। কেউ বিয়ে করলেও পরে কঠোর ব্রহ্মাচার্য গ্রহণ করেছিলেন! কেউবা সংসারত্যাগী। কেউবা ধ্যানী ছিলেন। কেউবা নির্জন সাধনার মাধ্যমে আত্মবিলয় লাভ করেছিলেন! কেউবা আধ্যাত্মিক আনন্দে আবিষ্ট হয়ে জগৎ-সংসারকে ভুলে ছিলেন।

আমাদের নবী ১১টি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর একজন পালক সন্তান ছিল। তিনি আমাদের মতই সমাজে বসবাস করতেন। তিনি ঘুমাতেন। খাদ্য গ্রহণ করতেন। স্ত্রীদের সাথে সময় অতিবাহিত করতেন। নিজ স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুতে কাঁদতেন। হাসি-মজাও করতেন মাঝে মাঝে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ছিলেন সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে। খেটে খুটে নিজের খাদ্য জোটাতেন।

সত্যি বলতে এই পারিবারিকতা-সামাজিকতা-গৃহিত্বই আমাদের নবীর এক বড় বৈশিষ্ট্য। আমাদের গর্ব আর শিক্ষার ক্ষেত্র। প্রয়োজন শুধু বস্তুবাদী-নাস্তিক্যবাদের চশমা ত্যাগ করে ইসলামের নবীকে ধর্মের প্রকৃত দর্শনের ক্ষেত্র থেকে মূল্যায়ন করা। তবেই নবীর ওপর আরোপিত ভুল ধারণাগুলো আমরা অপনোদন করতে সক্ষম হব এবং নবীর জীবন থেকে প্রকৃত নূর বা আলোকের উৎস খুঁজে পাব।

বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ম মানবজীবনের নিছক একটি অংশ। মানুষ একরকমের জৈব যন্ত্র। কাজ-কর্ম-দুঃখ-কষ্টের দোলাচলে মানুষ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায়। কখনো নিরাশ হয়ে পড়ে। স্থবিরতা দেখা দেয়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু অবস্তুগত মোটিভেশনের দরকার হয়, ধর্ম হলো মোটিভেশন।

আর ধর্মের প্রকৃত দর্শন অনুযায়ী ধর্ম জীবনের নিছক একটি অংশ নয়; বরং এই ক্ষণস্থায়ী অথচ সার্বিক জীবনাচার ও ও ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অঙ্গ বা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক! আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের যৌক্তিক প্রয়োগ আছে।
ইসলাম অনুযায়ী পলিটিক্স মানেই ম্যাকিয়াভেলিক ধোঁকাবাজি নয়। কৌটিল্যের কূটচাল নয়! ইসলামে পলিটিক্স, ইকোনমিক্স কিংবা জার্নালিজম সবই এথিক্সের সাথে জড়িত। আর এথিক্স এর ভিত্তি এখানে ধর্ম।
যাহোক, কথা হচ্ছে, মুহাম্মাদ (সা.) যে বিকশিত একত্ববাদী ধর্ম নিয়ে এসেছেন, সেটা একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। নেহায়াত কোন থিওরিটিকাল সায়েন্স নয় (অর্থাৎ শুধু একটি উচ্চ-মানস শ্রেণির বোধগম্য আধ্যাত্মিক শ্লোক এর সমস্টি নয়)।

ইসলামের আবেদন রয়েছে জ্ঞানী-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, পাপী-নিষ্পাপ, নারী-পুরুষ, আরব-অনারব, রাজা-প্রজা, রোগী-নিরোগ সবার প্রতিই।

অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে সারা দুনিয়া যখন একটি সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থার মুখাপেক্ষিতা অনুভব করছে, ইসলাম সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান; শুধু সাপ্তাহিক ‘ঝঢ়রৎরঃঁধষ জবভৎবংযবৎ’ নয়।

আমাদের নবী একটি গণমুখী জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। আর তাঁর মাঝে রয়েছে সেই জীবনব্যবস্থার বাস্তব ও জীবন্ত রূপ। প্রতিটি শ্রেণির মানুষের জীবনের প্রতি পদক্ষেপের প্রতিটি জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্নের জন্য নবী করিম (সা.)-এর জীবনে রয়েছে উত্তর। আমাদের জন্য নবী (সা.)-এর জীবনের কোন প্রেক্ষাপটই অপরিচিত নয়।

আমাদের নবী সমস্যা-দুঃখ-কষ্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবনের পরীক্ষার সমাধান করেন নি। তিনি মানব-পরিবার-সমাজ-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাসঙ্কুল ঘূর্ণিপাক আর জটের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করেই জীবনে জয়ী হয়েছেন। তিনি পারিবারিক কিংবা সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করেছেন। দারিদ্রের কষ্টকে মোকাবেলা করেছেন। তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়, সমস্যার মধ্যে থেকে সেগুলোর স্থায়ী সমাধান করাই মানবীয় দায়িত্ব। বস্তুজগতের মধ্যেই অধ্যাত্ম-জগতের সন্ধান দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।

উপমহাদেশের একজন আলেমের একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘রাসূল (সা.) মিরাজে গিয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করার পরেও আল্লাহর সান্নিধ্য ছেড়ে আবার বস্তুগত পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। আমি হলে কখনোই ফিরে আসতে সক্ষম হতাম না। আর এখানেই রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।’

এখানেই সাধারণ আধ্যাত্মিক পুরুষগণের সাথে রাসূল পাকের পার্থক্য। অপরদিকে অনেক মহাপুরুষই জীবনের কাঠিন্য আর বাস্তবতাকে বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাঁদের চোখে ঈশ্বরের দুনিয়া শুধুই তাঁদের মনমতই রোমান্টিক হবে! যখন তাঁদের মোহমুক্তি ঘটে তখন তাঁরা ‘নিষ্ঠুর’ বাস্তবতা থেকে পলায়ন করেছেন। বনবাসে গিয়েছেন। নিজ পরিবার ত্যাগ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অন্যদের ফেলে রেখে নিজেরা শান্তি খুঁজেছেন আর অত্যাচারী শাসকদের হাতে নিষ্পেষিত মযলুমদের জন্য কিয়াম করেন নি! কেউ কেউ বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন- ‘ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে পুষ্টিবিজ্ঞানের তত্ত্বকথা তুলে ধরা!’

তাঁদের জীবনে নেই যুলুম-পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আবেদন। কিংবা তা থাকলেও নেই মযলুমদের সমতাভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি গড়ে তোলার মূলমন্ত্র ও বিধিবিধান। অর্থাৎ তাঁদের জীবন বাস্তব সমাজের প্রেক্ষাপটে একপেশে, অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু ইসলামের নবীর জীবন সাধারণ মানুষকে এক্ষেত্রে আশার আলো দিতে পারে।

এতিমদের জন্য তিনি প্রেরণা; কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাপুরুষ হিসেবে তিনি নিজেই এতিমদের প্রতিনিধি। সাধারণ গণমানুষের মতই একজন তিনি।

আবার তিনি দরিদ্রপল্লির সন্তানও নন; বরং বিচিত্র, কিন্তু আমাদের পরিচিত এক পরিবেশে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কাবাঘরের খাদেমের বংশে জন্ম নিয়েও কখনো তিনি মেষ চড়িয়েছেন। কখনো দাদা মুত্তালিবের সাথে শান-শওকত-মর্যাদা উপলব্ধি করেছেন। আবার চাচা আবু তালিবের পরিবারের দারিদ্র দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মরুর দুরন্ত ছেলেদের মাঝে বেড়ে উঠেছেন। দুধ মায়ের সাথে ভিন্ন পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছেন আর দশ জন আরবের মতই! ব্যবসা করেছেন চাচার সাথে সাথে। যুদ্ধ দেখেছেন। কষ্ট দেখেছেন। দারিদ্র অনুভব করেছেন। আবার নিজে হেরা গুহায় আত্মমগ্ন হয়েছেন (নিজ দায়িত্বকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নয়!)।

সমাজের মানুষের সাথেই তিনি জীবনযাপন করেছেন! তাঁর জীবন আমাদের থেকে ভিন্ন অক্ষে ছিল না। তিনি জীবনে বাস্তব পরিস্থিতির পেক্ষাপটে কম-বেশি ৭০ এর মত যুদ্ধ করেছেন। কখনো ভালোবেসেছেন। কখনো কঠোরতা দেখিয়েছেন। শাস্তি দিয়েছেন। কখনো ক্ষমা করেছেন। কারণ, এসব বৈপরীত্ব নিয়েই এ জীবন। কেউ যদি ভালোকে ভালোবাসতে চায় তবে মন্দকে অবশ্যই ঘৃণা করতে হবে! পরম ভালোবাসা সম্ভব নয় এই আপেক্ষিকতার দুনিয়ায়।
‘অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে না!’ এটি একটি থিওরিটিকাল কথা। কিন্তু এতে মানব-সমাজে অশান্তির কোন সমাধান নেই। অপরাধ একটি ক্রিয়ার নাম। ক্রিয়া নিজে ঘটে না। একজন মানুষকে তার ফ্রি উইল দিয়েই ঘটাতে হয়। তাই, শুধু অপরাধকে ঘৃণা করাই যথেষ্ট নয়, অপরাধীকে করুণা আর ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে ঘৃণা করতে হবে। তা না হলে সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের কোন কার্যকরী পার্থক্য থাকবে না। এই ভিত্তিতে ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে সামাজিক শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

‘অহিংসা পরম ধর্ম!’- এটিও একটি থিওরিটিকাল সত্য। কিন্তু এর বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আবার ‘আমরা শান্তি চাই। যুদ্ধ চাই না।’- এটি একটি খোড়া একপেশে বাক্য। ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধ, হিংসা, হিংস্রতা, অশান্তিকে দূর করতে যুদ্ধবাজ, হিংস্র, অশান্তিকামী নিপীড়কের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হয়! মহাত্মা গান্ধীর অহিংস বাণীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করলেও বলতেই হবে, তিনি নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছেন, কঠোর হয়েছেন এবং এর যৌক্তিকতাও উপলব্ধি করেছেন।

কিন্তু ইসলামের নবী তাঁর সমগ্র জীবনে যুদ্ধ করেছেন অন্ধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসের পরাধীনতার বিরুদ্ধে। চিন্তার স্বাধীনতার জন্য। পৌরহিত্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যালেমের বিরুদ্ধে। শোষকের বিরুদ্ধে। তিনি সাধারণ মানুষ আর তাঁর নিজের মাঝে উপস্থিত সকল বস্তুগত ও অবস্তুগত বাধাকে সরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি যে কোরআন নিয়ে এসেছেন তা যেকোন সংস্কারমুক্ত স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষকেই পথ দেখাবে। মানুষের সাধারণ পথ প্রদর্শনে কোরআনের বাণী খুবই সহজ-সরল। আর জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য নবীর জীবন, তাঁর বাণী, তাঁর বংশধর এবং আলেমগণ রয়েছেন।

কোরআন থেকে যেমন সাধারণ মূর্খ কৃষক আলোকপ্রাপ্ত হবেন, তেমনিভাবে ইবনে সিনা, ইবনে রুশ্দ, ফারাবি, মোল্লা সাদরার মত চিন্তাবিদ-দার্শনিকগণ গভীর চিন্তার খোরাক পাবেন। একজন অধ্যাত্মবাদী, অতীন্দ্রিয়বাদীও আত্মার খাদ্য পাবেন। বিপ্লবী পাবে বিপ্লবের চেতনা। আবার খারাপ নিয়্যতের মানুষ কোরআন পাঠ করে অন্ধকারের আরো গভীরেই প্রবেশ করবে! (কোরআনের আয়াত : এই কোরআন মুমিনদের জন্য পাথেয় আর কাফেরদের জন্য ক্ষতির কারণ)। প্রত্যেকে তার যোগ্যতা, জ্ঞান ও চিন্তার স্তর, নিয়্যত অনুযায়ী কোরআন থেকে ফলাফল লাভ করবে।
অন্য মহাপুরুষদের সাথে ইসলামের নবীর আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। অন্য ধর্মের মহাপুরুষেরা বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটে তাঁদের ‘আধ্যাত্মিক’ জীবনধারা গ্রহণ করেছেন। যেমন, সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে যুদ্ধে প্রচুর মানুষকে হত্যা করেন। পরে তাঁর মনে হিংস্রতার বিরুদ্ধে, জীব হত্যার বিরুদ্ধে একটি চেতনা সৃষ্টি হয় এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

ইসলাম খোদামুখী ধ্যান, সাধনা, কঠোর আত্মসংযম ইত্যাদির বিরোধী নয়। বরং ইসলাম এগুলোর জেনারালাইজেশনের বিরোধী। কারণ, ইসলাম এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ্যে মূল্যায়িত হলে আমজনতা ঐ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতো না বরং ভীত হয়ে যেত। তাই নবী (সা.)-এর শিক্ষা হচ্ছে মধ্যপন্থার জীবন, যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য হেদায়াতের পথ।

কিন্তু, নবীর জীবনের সাথে এবং ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ ধরনের কতক আধ্যাত্মিক সাধকের ঘটনাও জড়িত, যাঁদেরকে নবী (সা.) নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের যোগ্যতা, তাঁদের ক্ষমতা আর ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে।
ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিগণ অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁদের জীবনেতিহাস আর জীবন শিক্ষা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উসমান বিন মাজউন (রা.) ছিলেন একজন সন্ন্যাসী-প্রায় মানুষ। তিনি এতটাই আত্মসংযম চর্চা করতেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলতে গেলে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মাংস খেতেন না। এমনকি ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও তিনি মদপান করেন নি। যদিও মহানবী (সা.) তাঁর মাত্রাতিরিক্ত আত্মসংযমের জন্য তাঁকে সতর্ক করতেন, তবুও উসমান বিন মাজউন আল্লাহ, তাঁর নবী ও নবীর আহলে বাইতের নিকট অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর এক পুত্রের নাম উসমান বিন মাজউনের প্রতি ভালোবাসাবশত রাখেন উসমান।

হযরত আবু যার গিফারি ছিলেন মরুদস্যু গোত্রের লোক। অথচ সত্যান্বেষী এই সাহাবী কঠোর আত্মসংযমী জীবন ধারা অনুসরণ করতেন। তিনি মহানবীর মৃত্যুর পর সমাজের ভোগবাদী জীবন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি। তাঁর প্রতি এমনকি তাঁর যামানার ইহুদি, খ্রিস্টানগণও মুগ্ধ ছিল। তিনি সকল ধর্মের সবার প্রতি সাম্যের ভিত্তিতে বিচার করতেন। প্রবলতম শত্রুকেও গালি দিতে কঠোর নিষেধ ছিল তাঁর অনুসারীদের প্রতি! সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিতেন এই মহাপুরুষ। তাঁর সম্প্রীতিবোধের বাণী প্রবাদতুল্য। জনগণের প্রতি ন্যায়শাসনের জন্য তিনি তাঁর প্রতিনিধি মালিক আশতারকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেটি জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের বাইরের দেয়ালে ইংরেজি অনুবাদে টানানো রয়েছে!

এই সাহাবিগণের অনেকেই নবীর হাতে প্রশিক্ষিত। এভাবে নবীর সাহাবীদের জীবনে রয়েছে ভিন্নমাত্রার শিক্ষা।
নবীর পারিবারিক জীবন আমাদের পারিবারিক জীবনের জন্য শিক্ষার উৎস। তাঁর পারিবারিক জীবনে কখনো স্ত্রী খাদিজা, উম্মে সালামা কিংবা কন্যা ফাতেমার সাহচার্য তাঁকে শান্তি দিয়েছে। আবার কখনো পারিবারিক সমস্যাগুলোকে সামাল দিতে হয়েছে ধৈর্য আর প্রজ্ঞার সাথে। কিন্তু তিনি পালিয়ে যান নি। তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে বিচলিত হলেও আত্মসমর্পণ করেন নি জীবনযুদ্ধে।

আমাদের নবী আর যেকোন মহাপুরুষের চেয়ে অনেক বেশি মযলুম-নির্যাতিত ছিলেন। সত্য সাধনার পথে মুনাফিকের কূটচক্রের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। সাম্রাজ্যবাদী, মূর্তিপূজারি পুরোহিত সমাজ তাঁকে বয়কট করেছিল। সেই অন্ধকূপ থেকেই তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন মানবতাকে। বাস্তবসম্মতভাবে। সহজ-সরল ও বোধগম্য ভাবে। মানুষের সাথে, সমাজের সাথে, রাজনীতি আর অর্থনীতির মধ্যে থেকে তিনি কূটজাল ছিন্ন করে সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ, কিন্তু তিনি কোন রোবোট ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষ। যিনি তাঁর মনো-দৈহিক চাহিদা পূরণ করেছেন সুন্দরতম স্বাভাবিক উপায়ে এবং আমাদেরকেও তেমনটাই শিক্ষা দিয়েছেন। যে যতটুক ধারণক্ষমতাস¤পন্ন, নবীর শিক্ষা তাকে ততটাই হেদায়াত দেবে। যার অন্তর যত গভীর তার অন্তরে ততদূর পর্যন্ত আলো প্রবেশ করবে। যার অন্তর যতটা পরিষ্কার তার অন্তর ততটাই আলোক প্রতিফলন করবে। নবীর হেদায়াত সাধারণতম মানুষ থেকে অসাধারণতম মানুষ পর্যন্ত! শেষকথা, ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক আত্মার সাধনার ধর্ম নয়। আবার নিজের প্রতি উদাসীন থেকে শুধু সমাজ-রাষ্ট্রমুখী সংশোধনের ধর্মও নয়; বরং ইসলাম হলো একই সময়ে ব্যক্তি ও সমস্টির আত্মিক-মনোদৈহিক-পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয়-জাগতিক উন্নয়নের মধ্যপন্থি ধর্ম, যেখানে ব্যক্তির ধর্ম আত্ম উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা আর সমাজের ধর্ম সামাজিক-রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির সকল প্রকার বিকাশের পথ সুগম করা।
অবিশ্বাসী কিংবা বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা এরকম সর্বব্যাপী ধর্ম চায় না। তারা চায় আংশিক এবং পঙ্গু ধর্ম যেগুলো তাদের শোষণব্যবস্থার ওপর বাধার সৃষ্টি করবে না। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্র তেমন আংশিক ক্ষেত্র বিশেষের জন্য নয়। ইসলামের নবীও আংশিক বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে প্রেরিত হন নি।

পরিশেষে আমরা নবী করিম (সা.)-এর সেই অমিয় হাদিসের কথা স্মরণ করব। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি তোমার দায়িত্ব রয়েছে। তোমার উচিত সেগুলো পালন করা।’

 

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা
বিশ্বমানবের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা

বিশ্বমানবের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা

বিশ্বমানবের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

‘(হে রাসূল!) বলুন : এসো আমি পাঠ করি তা তোমাদের রব্ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তা হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছু শরীক করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ কর এবং দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। বস্তুত আমিই তোমাদেরকে ও তোমাদের ব্যতীত অন্যদেরকে রিয্ক প্রদান করে থাকি। আর তোমরা প্রকাশ্য বা গোপনীয় কোনো ধরনের নির্লজ্জতার কাছেও যেও না। আর ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত আল্লাহ্ যাকে হত্যা করাকে হারাম করেছেন এমন কাউকে হত্যা করো না। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিচ্ছেন; আশা করা যায় যে, তোমরা বিচারবুদ্ধি দ্বারা তা উপলব্ধি করবে। আর (তাদেরই) কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যতীত তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যেও না যতক্ষণ না তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আর তোমরা মাপক পাত্র ও তুলাদণ্ডকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহার কর। বস্তুত আল্লাহ্ কারো ওপরে তার সাধ্যের অতীত দায়িত্ব চাপান না। আর তোমরা যখন কথা বলবে তখন ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখবে,এমনকি তোমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বেলায় হলেও। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ কর। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিয়েছেন,আশা করা যায় যে,তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সূরা আল্-আন্‘আম : ১৫১-১৫২)
মক্কা শরীফে সফরের উদ্দেশ্যে আগত এক ব্যক্তিকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছিল যে,তিনি যেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কথা না শোনেন,কারণ,(নিষেধকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী) তাহলে ঐ সব কথা তাঁকে জাদুগ্রস্ত করে ফেলবে। কিন্তু তিনি ছিলেন বিচারবুদ্ধির অনুসরণকারী একজন মুক্ত বিবেক মানুষ। এ কারণে তিনি তাদের এ মন্দ উপদেশ উপেক্ষা করেন এবং মসজিদুল হারামে গিয়ে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে দেখা করেন। অতঃপর কোরআন মজীদের উপরিউক্ত আয়াত দু’টি শুনে তিনি সাথে সাথে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং অনুভব করেন যে,এ আয়াত দু’টিতে নিহিত শিক্ষা তাঁর সম্প্রদায়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করবে।

ঐ ব্যক্তিটি মক্কায় সফরে এসেছিলেন মদীনা থেকে- যে শহরটি অচিরেই রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নতুন বাসভূমিতে পরিণত হয়। আর তিনি সেখানে উপরিউক্ত ঐশী ও সুবিচারপূর্ণ মূলনীতিমালা এবং অন্তরঙ্গতার ভিত্তিতে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রবের পক্ষ থেকে মানুষকে এ শিক্ষা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ইবাদত-বন্দেগি না করে এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক না করে। তাঁকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয় যে,তিনি যেন লোকদেরকে পৌত্তলিকতার ন্যায় মানবতার জন্য অবমাননাকর যুলুম থেকে এবং কুসংস্কারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। তিনি লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ করে;সমাজের কাছে নয়,শাসকদের কাছে নয় বা সংখ্যাগুরু জনগণের কাছে নয়,কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে। তিনি এ শিক্ষা প্রদান করেন যে,আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নিহিত রয়েছে।

মুক্তি ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি আমাদেরকে সকল লজ্জাকর গুনাহের কাজ পরিহার করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের নিজেদের কাছে,আমাদের মূল্যবোধসমূহের কাছে ও আমাদের আদর্শের কাছে ন্যায়নিষ্ঠ ও আন্তরিক হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং আমাদেরকে পাপপ্রবণ প্রবৃত্তির আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে- যাতে আমাদের প্রকৃত ও চূড়ান্ত ধ্বংস নিহিত রয়েছে,তাতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, কোনো ব্যক্তি যখন গুনাহের পথ বেছে নেয় সে ক্ষেত্রে সে যদি এ পথে ধীর পদবিক্ষেপেও অগ্রসর হতে থাকে,হলে শেষ পর্যন্ত তার ধ্বংস অনিবার্য।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে জীবনের মর্যাদা শিক্ষা দিয়েছেন। আর তিনি এমন এক সময় এ শিক্ষা প্রদান করেন যখন প্রতিশোধমূলক হত্যার ও তথাকথিত মর্যাদা রক্ষার জন্য হত্যার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। তখন অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে যে কাউকে হত্যা করা হতো। সে পরিস্থিতিতে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে,কেবল ন্যায়সঙ্গতভাবে ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করা যাবে না,যদিও ক্ষমা সর্বাবস্থায়ই সর্বোত্তম।

তখন এমন একটি সময় ছিল যখন পিতা কেবল এ কারণে স্বীয় সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত যে,সে ভয় করত যে,এ শিশুর ভরণ-পোষণ বহনে সক্ষম হবে না। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এ শিক্ষা প্রদান করেন যে,পিতা-মাতা ও সন্তান নির্বিশেষে সকলকে আল্লাহ্ তা‘আলাই রিয্ক্ প্রদান করেন।

বর্তমানে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করছি যখন প্রতিদিন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়কর সংখ্যক প্রাণ বিনষ্ট হচ্ছে। যখন প্রাণসমূহ এমনকি মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছুতেই জীবনের মর্যাদা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে সুবিচার ও সত্য শিক্ষা দিয়েছেন এবং নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণের ভিত্তিসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আসমান ও যমীন সুবিচার বা ভারসাম্যের ওপর ভিত্তিশীল। তিনি সব সময় ও সর্বাবস্থায়ই সুবিচারকে সমুন্নত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে,সর্বাবস্থায়ই সত্য বলতে হবে,এমনকি তা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও।
তিনি বলেন যে,সুবিচার প্রতিষ্ঠার কাজে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করা সত্তর বছর (নফল) ইবাদত করার চেয়েও অধিকতর উত্তম।
আমরা সকলেই বেশ ভালোভাবেই জানি যে,অন্যায়,অবিচার ও মিথ্যাচার,বিশেষ করে তা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে হয়,কীভাবে আমাদের এ বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে পারে। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে,ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সুবিচার ও সত্যবাদিতার ওপর অবিচলতা কীভাবে আমাদেরকে আমাদের পারিবারিক,সামাজিক ও বৈশ্বিক সমস্যাবলির সমাধানে সাহায্য করে।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন এমন একজন মহান শিক্ষক যিনি সব সময়ই ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ক্ষেত্রে গভীর আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার পরিচয় দিতেন। কখনো যদি এমন হতো যে,তাঁর কোনো বন্ধু বা স্বজনের সাথে তিন দিন পর্যন্ত তাঁর দেখা হয় নি তাহলে তিনি তাঁকে দেখতে যেতেন এবং তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তিনি চলার পথে যদি কোনো শিশুকেও দেখতে পেতেন তাহলে তার প্রতি হাসিমুখে তাকাতেন এবং তাকে আগে সালাম দিতেন। তিনি যখন তাঁর সাহাবীদের সাথে বসতেন তখন তিনি তাঁদের সকলের প্রতি সমানভাবে দৃষ্টিপাত করতেন যাতে সকলেই নিজেদেরকে সমানভাবে ধন্য মনে করতেন এবং অনুভব করতেন যে,তাঁদেরকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তাঁর ক্বওমের লোকেরা তাঁর আন্তরিকতা এবং দয়া-অনুগ্রহে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বর্ণিত আছে যে,একবার জনৈকা মহিলা তাঁর পুত্রকে দান হিসেবে কিছু পাবার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে পাঠান। যেহেতু মহিলা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খুবই দানশীল ছিলেন এবং এ কারণে কখনো কখনো এমন হতো যে,তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই থাকতো না। সেহেতু মহিলা তাঁর পুত্রকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে যদি দান করার মতো কিছু না থাকে তাহলে সে যেন তাঁর কাছে তাঁর গায়ের জামাটি চায়। ঘটনাক্রমে সেদিন তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই ছিল না। তাই ছেলেটি তাঁর কাছে তাঁর পরিধানের জামাটি চায়। তখন তিনি তাঁর কক্ষের দরজা বন্ধ করে তাঁর গায়ের জামাটি খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে ছেলেটিকে দান করেন। এরপর আরেকটি জামার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর গৃহে আবদ্ধ থাকেন।
আরেক বার তিনি তাঁর চাচাতো ভাই,তাঁর ঘনিষ্ঠতম সাহাবী ও তাঁর ওয়াসী হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর জন্য একটি জামা কিনে আনতে বাজারে পাঠালেন। হযরত আলী তাঁর জন্য বারো দেরহাম মূল্যে একটি জামা কিনে আনলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অপেক্ষাকৃত কম দামি একটি জামা চাচ্ছিলেন। তাই তিনি হযরত আলীকে সাথে নিয়ে বাজারে গেলেন। তিনি ঐ জামাটি বিক্রেতাকে ফিরিয়ে দিয়ে চার দেরহাম মূল্যের একটি জামা নিলেন এবং অবশিষ্ট আট দেরহাম সহ তিনি ঘরে ফিরে আসার পথ ধরলেন। পথে একজন গরীব লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো যার গায়ের জামাটি ছিল ছিন্ন ও মলিন। তখন তিনি তাকে চার দেরহাম দিলেন এবং একটি জামা কিনে নিতে বললেন।

এরপর এক ধনী পরিবারের এক ক্রীতদাসী বালিকার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। মেয়েটির মনিব তাকে চার দেরহাম দিয়ে মুদি দ্রব্যাদি কেনার জন্য পাঠিয়েছিল,কিন্তু সে তা হারিয়ে ফেলেছিল,তাই সে তার মনিবের ভয়ে কাঁদছিল। তখন নবী করীম (সা.) তাঁর অবশিষ্ট চার দেরহাম ঐ মেয়েটিকে দান করলেন। কিন্তু এরপরও সে কাঁদতে লাগল। সে বলল যে,সে দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে বসে কাঁদছিল এবং এখন দেরীতে ঘরে ফিরলে তার মনিব তাকে দেরী করার কারণে প্রহার করবে। তখন মেয়েটির মনিব যাতে তাকে প্রহার না করে সে জন্য নবী করীম (সা.) তার সাথে তার মনিবের গৃহে গেলেন। তিনি মেয়েটির মনিবের গৃহের দরজায় পৌঁছে গৃহবাসীদের উদ্দেশে সালাম করলেন। জবাব আসতে দেরী হওয়ায় তিনি তিন বার সালাম করলেন। এরপর তারা জবাব দিল। নবী করীম (সা.) তাদের গৃহে আসায় তারা নিজেদেরকে ধন্য মনে করল এবং তাঁর সম্মানার্থে মেয়েটিকে ক্ষমা করে দিল। শুধু তা-ই নয়,তাঁর সম্মানার্থে তারা ক্রীতদাসীটিকে মুক্ত করে দিল। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তিন বার সালাম না করা পর্যন্ত তাদের জবাব না দেয়ার কারণ জানতে চাইলেন। জবাবে তারা বলল : ‘আমরা আপনার কণ্ঠের সুমিষ্ট সম্ভাষণ তিন বার শুনতে চাচ্ছিলাম।’

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নেতৃত্বের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং বিশ্ববাসীর প্রতি সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহ ছিল হযরত আলী (আ.)-কে স্বীয় উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীতকরণ। কারণ,নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (আ.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ততার জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তিত্ব-যিনি রাসূলুল্লাহর নীতিমালা ও শিক্ষাকে সমুন্নত রাখেন,বিশেষ করে তাঁরই মতো সুবিচার ও সত্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করেন।

হযরত আলীকে যখন মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ও পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয় তখন তিনি বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে সামাজিক সুবিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্বের জন্য পরিপূর্ণ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তুত হযরত আলী (আ.) মানবজাতির মধ্যে সুবিচারের কণ্ঠস্বরে পর্যবসিত হন এবং তিনি সত্য ও সুবিচার নিয়েই বেঁচে থাকেন এবং সত্য ও সুবিচার নিয়েই শাহাদাতবরণ করেন।

অনুবাদ: নূর হোসেন মজিদী

বিশ্বমানবের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা
মহানবী (সা.)-এর সিরাতে বিশ্বশান্তি ও সুবিচার

মহানবী (সা.)-এর সিরাতে বিশ্বশান্তি ও সুবিচার

মহানবী (সা.)-এর সিরাতে বিশ্বশান্তি ও সুবিচার

শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। ইসলামের এ লক্ষ্য কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমস্ত মানুষই এ লক্ষ্যের আওতাধীন।

আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে যখন মহানবী (সা.)-এর জামাতা ও উওরাধিকারী হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) মালিক আশতারকে মিসরের গভর্নর নিয়োগ করেন তখন তাঁর কাছে শাসনব্যবস্থার মূলনীতিসমূহের রূপরেখা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে একটি পত্র প্রেরণ করেন।

তখন মিসর ছিল ইসলামী খেলাফতের অন্তর্গত একটি প্রদেশ যেখানে বহু ধর্মের অনুসারী লোকেরা বসবাস করতো। ইমাম আলী (আ.) তাঁর এ পত্রে মালিক আশতারকে নিম্নরূপ নির্দেশনা প্রদান করেন : ‘তোমার মনে জনগণের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা লালন করো আর তাদের প্রতি মমতা ও হৃদ্যতা পোষণ করো। হিংস্র পশুর মতো হয়ো না যে, তাদের ভক্ষণ করাকে গনীমত মনে করবে। কারণ, মানুষ দুই শ্রেণির : হয় তারা তোমার ঈমানী ভাই, না হয় তোমার সমপ্রজাতির (মানুষ)।’
মানুষ হিসেবে অমুসলমানদের প্রতি এ মমত্ববোধ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ- যার বার্তা নিয়ে আসেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)। আর এজন্যই এ মহান ব্যক্তিত্ব ও তাঁর সহগামীদের সম্পর্কে জানার প্রয়োজন রয়েছে।

নবী-রাসূলগণের মিশন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন; তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ হচ্ছেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আর সকল নবী-রাসূলই মানবসমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন : ‘নিঃসন্দেহে আমি আমার রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে গ্রন্থ ও ন্যায়দণ্ড (নিক্তি) অবতীর্ণ করেছি,যাতে মানুষ সুবিচার সহকারে দণ্ডায়মান থাকে।’ (সূরা আল্-হাদীদ : ২৫)

বস্তুত সকল মানুষই এ দুনিয়ায় শান্তি কামনা করে। কিন্তু শান্তি এমন নয় যে, তা শূন্যতা থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হবে, বরং এটি ন্যায়বিচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই ন্যায়বিচার সমাজব্যবস্থার অংশ হতে হবে,নতুবা টেকসই শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে,ন্যায়বিচার কী? ন্যায়বিচার হচ্ছে সবকিছুকে তার যথাযথ অবস্থানে স্থান দেয়া। যখন কেউ কোন কিছুকে তার যথাযথ স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও স্থান দেয় তখন সামাজিক সুস্থিতি ও শান্তির ব্যাঘাত ঘটে।

আর সামাজিক শান্তি নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মিক প্রশান্তির ওপর। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেন,সেই ব্যক্তিই ন্যায়বান যে তার রাগ ও ক্রোধকে আকল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি আকল প্রয়োগ করে অযাচিত ভাবাবেগ,লোভ,ক্রোধ ইত্যাদি দমন করাকে ‘বৃহত্তর জিহাদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

একবার মুসলিম সেনাবাহিনী সফল যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে এলে নবী করীম (সা.) তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘অভিনন্দন তাদের জন্য যারা একটি ছোট জিহাদ (জিহাদে আসগার) শেষে ফিরে এসেছে এবং এখনো বড় জিহাদ (জিহাদে আকবার) বাকি রয়েছে।’ সৈন্যরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কোনটি বড় জিহাদ?’ তিনি বললেন,‘আত্মার পরিশুদ্ধির জিহাদ।’

আত্মিক জিহাদ কোনো সহজ জিহাদ নয়, বরং এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে তার প্রচণ্ডতম ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে আক্ল ও সচেতনতার দাবি মেনে জীবনযাপন করতে হয়। আর যারা নিজেদের আমিত্বকে বর্জন করতে পারে কেবল তারাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

আল্লাহর রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিরাট ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি যুদ্ধের সময়ে অমুসলমান শত্রুদের সাথে কী রকম আচরণ করেছিলেন তার ওপর দৃষ্টিপাত করলেই তা সহজে বুঝা যাব। কারণ, বিরূপ পরিবেশেই কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রকৃত স্বভাব উন্মোচিত হয়।

নবী করীম (সা.) ও তাঁর অনুসারিগণ মক্কায় সমাজের নিপীড়িত সংখ্যালঘু শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। নির্যাতন সীমা অতিক্রম করে গেলে তিনি মদীনায় হিজরত করেন- যার অধিকাংশ অধিবাসী এর আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মদীনায় গমনের পর নবী করীম (সা.) লক্ষ্য করলেন যে,সেখানকার ইহুদি সম্প্রদায়ের ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ নেই। তাই তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তাদেরকে একটি পারস্পরিক সম্মতি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে আহ্বান জানালেন যাতে মদীনার প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় সমাজে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে। এ চুক্তির কয়েকটি অনুচ্ছেদ ছিল সংক্ষেপে এরূপ : ইহুদিদের মধ্যে যেসব গোষ্ঠী এ চুক্তিতে আবদ্ধ থাকবে তারা যে কোনো প্রকার অপমান ও নিপীড়ন থেকে নিরাপদ থাকবে। সমাজে তারা যে কোন ভালো কাজ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমান ভাগীদার হবে। মদীনার ইহুদি এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমানদের সাথে মিলে একটি একক জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। ইহুদিরা মুসলমানদের মতোই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। ইহুদিদের মিত্ররাও ইহুদিদের মতোই নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। মদীনা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে ইহুদিরা মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়ে শত্রুকে প্রতিহত করবে। যারাই এ চুক্তি মেনে নেবে তাদের জন্য মদীনা পবিত্র গণ্য হবে। ইহুদি ও মুসলমানদের মিত্ররাও চুক্তির মূল সম্প্রদায়দ্বয়ের (ইহুদি ও মুসলমান) মতোই একইরূপ সম্মানিত গণ্য হবে।

মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উদ্যোগে বাস্তবায়িত এ চুক্তি সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর চরিত্রের ন্যায়-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। আর তিনি যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে মদীনায় ইসলামের ভিত্তি গড়ে তোলেন নি; বরং ভিন্ন ধর্মানুসারীদের সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন এটি তারই প্রমাণ। ইবরাহীমী ধর্মত্রয়ের মধ্যে একমাত্র ইসলামই অপর দুই ধর্ম তথা ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মকে ধর্মতত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃতি দিয়েছিল (অর্থাৎ উক্ত ধর্মদ্বয়ের সম্মানিত চরিত্রসমূহ ইসলামেও সম্মানিত এবং একটা সময় ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মদ্বয় যে হকের পথে ছিল তার স্বীকৃতি দেয়) এবং এ দুই সম্প্রদায়কে ‘আহ্লে কিতাব’ বা ঐশী গ্রন্থধারী হিসেবে আখ্যায়িত করে।

অমুসলিম আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে আচরণ প্রতিবেশীদেরকে ভালোবাসা এবং যত্ন করার ইসলামী নির্দেশনা সব মতের, সকল প্রকার প্রতিবেশীর প্রতিই প্রযোজ্য। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘আর তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই অংশীদার গণ্য করো না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, দরিদ্র, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী,সহচর, অসহায় পথিক ও ক্রীতদাসদের সাথে সদাচরণ করো; নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক-অহঙ্কারীদেরকে ভালোবাসেন না।’ (সূরা আন্-নিসা : ৩৬)

এমনকি যদি কোন মুসলমানের পিতা-মাতা মূর্তিপূজক হয়, তবুও একত্ববাদের ধর্ম ইসলাম তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন : ‘তারা (তোমার পিতা-মাতা) যদি আমার সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার করার জন্য তোমাকে পীড়াপীড়ি করে অথচ সে সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নেই (তুমি জান যে, তা ঠিক নয়), সে ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করো না এবং পার্থিব জীবনে তাদেরকে উত্তমভাবে সাহচর্য প্রদান করো…।’ (সূরা লুকমান : ১৫)
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি ন্যায় ও শান্তির নীতি

ইসলাম তার অনুসারীদের প্রতি নির্দেশ দেয় যে, তারা যেন ন্যায়বিচার করে, এমনকি শত্রুদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও। এরশাদ হয়েছে : ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর খাতিরে ন্যায়ের ভিত্তিতে সাক্ষ্যদানকারী হও এবং (সাবধান!) কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরিতা যেন তোমাদেরকে কখনো সুবিচার না করার জন্য প্ররোচিত না করে; বরং সুবিচার করো, এটাই তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, কারণ, আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।’ (সূরা আল্-মায়েদা : ৮)

ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধটি ছিল অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এ যুদ্ধটি মুসলিম ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে হিজরি দ্বিতীয় সনে সংঘটিত হয়। অতি অল্প পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে জয়ী হন এবং তাদের অনেককে আটক করা হয়।

সে সময় সকল জাতিগোষ্ঠীর রীতি ছিল আটককৃত যুদ্ধবন্দিদেরকে হত্যা করা কিংবা দাস হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মুসলমানদেরকে যুদ্ধবন্দিদের সাথে মানবিক আচরণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। তাই মুসলমানরা যুদ্ধবন্দিদের নিরাপত্তা প্রদান করে মদীনায় নিয়ে এলেন এবং যে মুসলমান যাকে বন্দি করেছিলেন তাকে নিজের বাড়িতে সসম্মানে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

পাশ্চাত্যের অন্যতম খ্যাতনামা মনীষী স্যার উইলিয়াম মূর-এর বর্ণনায় : “মুহাম্মাদের নির্দেশনা অনুসরণ করে… মদীনার জনগণ যুদ্ধবন্দিদেরকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে নেন। ‘মদীনার জনগণের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক! তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের বাহনগুলোতে সওয়ার করিয়েছিলেন যখন নিজেরা পায়ে হেঁটে চলেছিলেন,তাঁরা আমাদেরকে গমের রুটি খেতে দিয়েছিলেন যখন সেটির অপ্রতুলতা ছিল এবং আমাদেরকে খেজুরের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত করেছিলেন’- এভাবেই পরবর্তীকালে একজন যুদ্ধবন্দি মদীনাবাসী মুসলমানদেরকে স্মরণ করেন।”

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যুদ্ধবন্দিদের সাথে যেরূপ আচরণ করেছিলেন তা ছিল নজিরবিহীন। তিনি দরিদ্র বন্দিদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং ধনাঢ্য বন্দিদের নিকট থেকে সুনির্দিষ্ট মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ, কোরআন মজীদে বন্দিদেরকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে বা না করে মুক্তি দেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে (সূরা মুহাম্মাদ : ৪)। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুক্তিপণ ছিল শিক্ষিত যুদ্ধবন্দিদের বেলায়; রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, দশজন মুসলিম শিশুকে লিখতে-পড়তে শেখানোর বিনিময়ে একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে।

মুসলমানদের জন্য যুদ্ধকালে রণাঙ্গন বহির্ভূত সাধারণ লোকদের,এমনকি পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারেও মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যেমন :

-চুক্তি লঙ্ঘন করবে না।

-বৃদ্ধ,শিশু ও নারীদের হত্যা করবে না।

-গাছপালা ও বনজঙ্গল কাটবে না বা জলমগ্ন করবে না।

-খেজুর গাছ পুড়িয়ে ফেলা ও জলমগ্ন করা থেকে বিরত থাকবে।

-ফলবান গাছ কাটা থেকে বিরত থাকবে।

-বিধর্মীদের পানিতে বিষ প্রয়োগ করবে না

এ সবই চৌদ্দশ’ বছর আগের বিধান যখন ‘জেনেভা চুক্তি’র কোন অস্তিত্বই ছিল না।

সিআইএ নিয়ন্ত্রিত গুপ্ত কারাগারসমূহে ও আবূ গারীব কারাগারে নৃশংস নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথেই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি,যুদ্ধবন্দিদের সাথে আচরণের যে শিক্ষা ও নজির রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জীবন থেকে আমরা পেয়েছি সেটা,এমনকি একুশ শতকের মানদণ্ডেও অনেক বেশি মানবিক ও শ্রেয় বরং অতুলনীয়।

উপসংহার
‘সভ্যতাসমূহের মধ্যে সংলাপ’-এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নবী-রাসূলগণের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করার পন্থা খুঁজে বের করা। তাই সকল ধরনের চরমপন্থীদেরকেই আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার পন্থা এটা নয় যে, আমরা ধর্মকে হালকাভাবে গ্রহণ করব; বরং আরো দৃঢ়ভাবে ধর্মকে গ্রহণ ও মূল্যায়ন করতে হবে- যাতে ধর্মে বর্ণিত মানুষের পারস্পরিক আচরণবিধিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়।

মুসলমানদের উচিত রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর খ্রিস্টানদের উচিত নবী হযরত ঈসা (আ.)-এর শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করা; শুধু তখনই বিশ্বে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহ্লে বাইত্ (আ.) থেকে প্রাপ্ত একটি দো‘আর কথা আমরা স্মরণ করি যেখানে উচ্চারিত হয়েছে-‘হে আল্লাহ! তুমিই শান্তি,তোমার থেকেই শান্তি এবং তোমার কাছেই শান্তির প্রত্যাবর্তন।’

অনুবাদ : মাহদী মাহমুদ

মহানবী (সা.)-এর সিরাতে বিশ্বশান্তি ও সুবিচার

ইসলামিক কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন অর্গানাইজেশন হল ইরানি সংস্থাগুলির মধ্যে একটি যেটি সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের সাথে অধিভুক্ত; এবং 1995 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[আরও]

:

:

:

: