ইসলাম-পরিচিতি (১)
ইসলাম একত্ববাদী একটি ধর্ম যার প্রচার ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে মক্কা নগরীতে শুরু হয় এবং অর্ধশতাব্দীর মধ্যে অতি দ্রুত ও লক্ষণীয় মাত্রায় প্রসার লাভ করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের এক বড় অংশে প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। এ ধর্মের অনুসারদের মুসলিম বা মুসলমান নামে অভিহিত।
ইসলামের অভিধানিক অর্থ হলো নির্দেশের সামনে অনুগত থাকা ও আত্মসমর্পণ করা এবং দ্বীনি পরিভাষায় মহান আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানের সামনে নত হওয়া ও আত্মসমর্পণ করা।
ইসলাম পরিচিতির মৌলিকতম উৎস পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহের ভিত্তিতে এ ধর্ম নবিদের সকলের আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হওয়ায় বিশ্বাসী। এক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করে না। (বাকারা: ২/১৩৬) বরং কোরআনের ভাষায় সকল নবি এক ধর্ম ইসলামকেই প্রচারের উদ্দেশে প্রেরিত হয়েছেন যদিও তাঁদের (শরীয়তের) ধরনে পার্থক্য ছিল। আর তাঁদের সকলেরই শিক্ষার সাধারণ বিষয়বস্তু ছিল এক আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করা।
এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে পবিত্র কোরআনে ইসলামকে সর্বজনীন একত্ববাদী ধর্ম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, ইসলাম হলো ‘দ্বীনুল্লাহ’ বা আল্লাহর দ্বীনযা ব্যতীত কোনো ধর্মই আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না (আলে ইমরান/ ৩: ১৯, ৮৩ ও ৮৫) এবং সব নবি এ দীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন। আর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এ ধর্মের সর্বোত্তম রূপটি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন যা পূর্ববর্তী একত্ববাদী ধর্মগুলোকে পূর্ণতা দানকারী। (মায়েদাহ/ ৫: ৩ ও ৪৮) তিনি তেইশ বছর ধরে এ দীন প্রচারের জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন।
ইসলামের আত্মপ্রকাশ ও মহানবি (সা.)
মহানবি (সা.)-এর তেষট্টি বছরের জীবনকাল নিয়ে পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন করলে আমাদের সামনে এমন একজন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ব্যক্তি ও ঐশী নবির আত্মপ্রকাশের চিত্র ফুটে ওঠে যিনি তাঁর সমাজকে সংস্কার ও পরিশুদ্ধ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অসংখ্য কষ্ট ও প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেছেন কিন্তু কখনও নিরাশ হননি। তিনি আরব উপদ্বীপকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত করেন যে, ইসলাম হেজাযের (আরব ভূখণ্ড) সীমার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি এমন এক ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছেন যা বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
নবুওয়াতের সূচনা থেকে হিজরতকাল
ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থে যা নবুওয়াতের সূচনা বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা হলো ঐ রাত যাতে ওহির ফেরেশতা হেরা পর্বতের গুহায় মহানবির সামনে প্রকাশিত হন এবং তাঁকে সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত পড়ে শোনান। কিছুদিন পর ওহির ফেরেশতা তাঁর নিকট তাঁর জাতিকে হেদায়েত এবং তদীয় সমাজকে ধর্মীয় ও নৈতিক বিচ্যুতি ও অনাচার থেকে মুক্ত ও সংস্কার করার নির্দেশ নিয়ে আসেন। সেইসাথে তিনি আল্লাহর গৃহ কাবাকে মূর্তি ও প্রতিমাশূন্য এবং মানুষের মন থেকে মিথ্যা সব উপাস্যকে দূর করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন।
রাসূল (সা.) তওহীদের প্রতি দাওয়াতের কাজটি নিজের গৃহ থেকে শুরু করেন। প্রথম যে নারী তাঁর ওপর ইমান আনে তিনি হলেন তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজা এবং পুরুষদের মধ্যে তাঁর চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবি তালিব যখন তিনি (মহানবি) তাঁর অভিভাবকত্বের দায়িত্বে ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের গ্রন্থসূত্রসমূহে অন্য কয়েক ব্যক্তিকে, যেমন হযরত আবুবকর ও যায়েদ বিন হারেসাকে প্রথম মুসলমান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নবুওয়াতের সূচনার তিন বছর পর মহানবি (সা.) নির্দেশপ্রাপ্ত হন কুরাইশদেরএকস্থানে সমবেত করে তওহীদের দাওয়াত দেওয়ার। কিন্তু কুরাইশ মুশরিকরা তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের ওপর কঠোরতা আরোপ করে। তিনি তাঁর কতিপয় সাহাবাকে নির্দেশ দেন ইথিওপিয়ায় হিজরত করার। মহানবি (সা.) মক্কার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষত তায়েফের অধিবাসীদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানালেও তারা তা গ্রহণে অসম্মতি জানায়। পরিশেষে মহানবি (সা.)-এর দৃষ্টি ইয়াসরেবের (মদীনার) দিকে আকৃষ্ট হয় যা তাঁর কাছে দাওয়াতের উপযুক্ত বিবেচিত হয়। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইয়াসরেবের দুই গোত্র –আওস ও খাজরাজ- তাঁর সাথে (বাইয়াত ও আনুগত্যের শপথে) চুক্তিবদ্ধ হয়। এ চুক্তির মাধ্যমেই পরবর্তীতে মহানবি (সা.) কর্তৃক ইয়াসরেবে প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
মহানবির (সা.) সাথে মক্কায় বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়ে এবং তাঁর প্রেরিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ইয়াসরেবের অধিবাসীদের অধিকাংশই তাঁর ওপর ইমান আনে এবং কিছুদিনের মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে তাদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যকই কেবল বিধর্মী থেকে যায়। যদিও তাঁর (সা.) সাথে ইয়াসরেব বাসীদের বৈঠকগুলো গোপনে সংঘটিত হতো কিন্তু কুরাইশরা তা বুঝতে পারে। ফলে তারা মহানবি (সা.) ও মুসলমানদের ব্যাপারে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, সমবেতভাবে (কুরাইশদের প্রত্যেক উপগোত্র থেকে একদল লোক) মধ্যরাতে হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করবে। এতে কোনো একক ব্যক্তি বা দলের ওপর তাঁকে হত্যার দায়িত্ব বর্তাবে না। মহানবি (সা.) তাঁদের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরে হযরত আলীকে (আ.) নিজের স্থানে (বিছানায় শুইয়ে) রেখে হযরত আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে ইয়াসরেবের দিকে রওয়ানা হন।
হিজরত থেকে ওফাত পর্যন্ত
মক্কা থেকে মহানবি (সা.) এর প্রস্থান, যা হিজরত নামে সমধিক পরিচিত, তাঁর জীবন ও ইসলামের ইতিহাসের এক নতুন দিক উন্মোচনকারী ঘটনা। মহানবি (সা.) নবুওয়াতের সূচনার ১৪তম বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে ইয়াসরেবে পৌঁছান। এ শহরটি পরবর্তীতে তাঁর নামে ‘মদীনাতুর রাসূল’ বা সংক্ষেপে ‘মদীনা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
মহানবি (সা.) মদীনায় স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দিন দিন লোকেরা মক্কা ও অন্যান্য স্থান থেকে মদীনায় হিজরত করা শুরু করল। হিজরতকারীদের মুহাজির নামে অভিহিত করা হয়। আর মদীনার অধিবাসীরা বহিরাগতদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে অনসার বা সাহায্যকারী নামে অভিহিত হয়। মহানবি (সা.) মুহাজির ও আনসারদের পরস্পরকে ভ্রাতৃত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। তিনি হযরত আলীকে (আ.) নিজের ভাই হিসাবে মনোনীত করেন।
পরবর্তীতে মুসলমান ও মুশরিক কুরাইশদের মধ্যে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় অবশেষে হিজরতের অষ্টম বর্ষে মুসলমানদের হাতে মক্কা বিজিত হয়। এর ফলে আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ স্থান মহানবির (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অধীনে আসে।
রাসূল (সা.) দশম হিজরিতে হজে যান এবং হজ থেকে ফিরার পথে গাদিরে খুম নামক স্থানে হযরত আলী (আ.)-কে নিজের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত ও মুসলমানদের নেতা ও অভিভাবক (মাওলা) হিসাবে ঘোষণা করেন। ১১ হিজরির প্রথম দিকে রাসূল (সা.) খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ঐ বছরের সফর মাসের ২৮ তারিখে (অন্য বর্ণনা মতে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে) ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সেসময় তাঁর সন্তানদের মধ্যে কেবল হযরত ফাতিমা (আ.) বেঁচে ছিলেন। তাঁর পবিত্র দেহ মোবারককে হযরত আলী (আ.) গোসল দেন ও কাফন পরান এবং তাঁর বংশের বিশেষ কয়েক ব্যক্তির মহযোগিতায় তাঁরই গৃহে–যা বর্তমানে মসজিদুন্নবির অংশ-দাফন করেন।
মহানবি (সা.)-এর গুণ-বৈশিষ্ট্য
মহানবি (সা.)-এর বৈশিষ্ট্য ও গুণ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি অধিকাংশ সময় চুপ থাকতেন, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না, কখনও ঠোঁট দুটি এতটা খুলতেন না যে তাঁর মুখগহ্বর দেখা যাবে, সমসময় মৃদু হাসতেন, কখনও উচ্চৈঃস্বরে হাসতেন না, কারো সাথে কথা বলতে বা কারো কথা শুনতে তার দিকে সম্পূর্ণ দেহ ফিরাতেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ও সুগন্ধ ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। তিনি যদি কোন পথ দিয়ে যেতেন তাঁর (গমনের) পর আগত পথিকরাও তাঁর সুগন্ধ থেকে সেখানে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করত। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। মেঝেতেই বসতেন এবং মেঝেতেই বসে খাবর খেতেন, কখনই অহংকার করতেন না। কখনই পেট ভরে খেতেন না. অনেক সময়ই, বিশেষত মদীনায় আসার প্রথম বছরগুলোতে, অভুক্ত থাকতেন।
কিন্তু এসত্ত্বেও তিনি বৈরাগী ও সন্ন্যাসীদের ন্যায় জীবন যাপন করতেন না এবং বলতেন যে, একদিকে তিনি এ দুনিয়া থেকে পরিমাণমত ভোগ করেছেন অন্যদিকে রোজাও রেখেছেন ও ইবাদতও করেছেন। মুসলমান এমনকি অন্য ধর্মের (নিবেদিতপ্রাণ) অনুসারীদের সাথেও তিনি ক্ষমা, মহত্ত্ব, অনুরাগ ও দয়ার সাথে আচরণ করতেন। তাঁর জীবনাচরণ, কর্মপন্থা ও অনুসৃত রীতি মুসলমানদের কাছে এতটা পছন্দনীয় ও আকর্ষণীয় ছিল যে, এগুলোর খুঁটিনাটি দিকগুলোও তারা একে অপরের কাছে বর্ণনা করতেন ও বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিতেন। এভাবে তা বর্তমান প্রজন্মের কাছেও পৌঁছেছে এবং তাঁর জীবনের সকল কর্ম ও আচরণকে তারা তাদের ধর্মীয় ও দৈনন্দিন জীবনের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে।
ইসলাম-পরিচিতি (১) | |