এজেন্সি
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের  ভিত্তি

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের ভিত্তি

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের ভিত্তি

ইরানে সংঘটিত ঐতিহাসিক ইসলামি বিপ্লবকে বুঝতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে মানুষকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেকে বুঝা এবং যে পরিবেশে সে বসবাস করে সেই পরিবেশকে অনুধাবন করা ।

সকল ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ দু’টি কর্তব্যের মুখোমুখি হয়। আত্মসমর্পণ অথবা সংগ্রাম। সংগ্রামের দাবি হলো তার আশু নিকটবর্তী  উপায়-উপকরণ নিয়ে সকল কিছুর পরিবর্তন সাধন করা। কোন মানুষ যদি শেষোক্তটি পছন্দ করে তাহলে এ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই।

তাই পৃথিবীর ইতিহাস বিপ্লবে পরিপূর্ণ। মানুষের পরিবর্তন প্রত্যাশা মোতাবেক তা কখনো পৃথিবীর এক স্থানে কখনো অন্যস্থানে সংঘটিত হয়েছে। তবে পরিবর্তন যে সব সময় কেবল বিপ্লবী পন্থায় সংঘটিত হয়েছে তা নয়। কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে পরিবর্তনের মাধ্যমে বা পর্যায়ক্রমে। আমরা এখানে বিশেষভাবে বিপ্লবী পন্থায় যেসব পরিবর্তন হয় তা নিয়ে আলোচনা করবো ।

একথা সর্বজনবিনিত যে, ইরানে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এবং তার প্রতি সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি অকৃষ্ট হয়েছে। এই বিপ্লব ইরান ইরানের বাইরের কোটি কোটি মানুষের জীবনকে স্পর্শ করেছে। সাম্প্রতিক বিশ্বে ইতিহাসে এমন কোন ঘটনা পাওয়া যাবে না যা পশ্চিমা জগৎ এবং সারা বিশ্বে তাদের ছড়ানো উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তিতে নাড়া দিয়েছে। এই বিপ্লব একজন মানুষকে অত্যন্ত বিখ্যাত করেছে এবং ভালোভাবে হোক আর খারাপভাবে হোক তাঁর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এই বিপ্লব ইসলামের ভাবমূর্তিকে এমনভাবে সমুন্নত করেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ইরানের এই বিপ্লবের ফলে মহান ধর্ম ইসলাম যেন একটি পরিবর্তনের জন্য বিশ্ব-ঘটনা প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে গুলতির মতো আঘাত হেনেছে।

এই বিপ্লব পরস্য উপসাগরীয় অঞ্চল তথা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। এই বিপ্লব একটি নতুন জোট সৃষ্টি করেছে, এর আগে এ জাতীয় কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। যেখানে বন্ধুত্ব ছিল ইসলামের নীতি আদর্শের প্রতি অটল থাকার এই বিপ্লব সেখানে অশ্রুতার জন্ম দিয়েছে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে লোকদের চরিত্র ও সংকল্প পরীক্ষিত হয়েছে। ইরানি জাতির এই বিপ্লবের মাধ্যমে জেহাদের নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়েছে এবং পুরানো রণাঙ্গনের পাঠ চুকে গেছে। এই বিপ্লব পারস্য উপসাগরে মার্কিন সামরিক মহড়াকে নিথর করে দেয় এবং প্রায় অধিকাংশ শক্তিধর দেশ নতজানু হয়ে যায়। ইরানি বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ত্রুটি ও দুর্বলতা এবং সিআইএ-এর যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রকাশ করে দেয়।

তাহলে বিপ্লব বলতে কী বুঝায়? বিপ্লব কী পরিবর্তন করতে চায়? এর বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য কী? কেন এই বিপ্লব সফল হয়েছিল? বিশ্বের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বিপ্লবের সাথে এই বিপ্লবের তুলনা করা যায় কিভাবে? এই নিবন্ধে এসব বিষয়ই তুলে ধরা হবে।

বিপ্লব কী?

ইরানে যা সংঘটিত হয়েছে তার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা উপলদ্ধি করতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই বুঝতে হবে বিপ্লব কী? বিপ্লব হচ্ছে একটি ব্যবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিপূর্ণ আমূল পরিবর্তন। কোন দেশের বেলায় একটি সরকার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করে অন্য একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ।

ইরানে ঠিক এমনটি ঘটেছে। বিপ্লবের মাধ্যমে এদেশের আড়াই হাজার বছরের সুপ্রাচীন ও গভীরে প্রোথিত রাজতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত হয় এবং তদস্থলে ইসলামকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইরানি বিপ্লব কেন সফল হয়?

এ ব্যাপারে সর্ব প্রথমে জানা দরকার যে, ইরানে যে বিপ্লব হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যত্র যেসব বিপ্লব হয়েছে তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফারাসি বিপ্লব আর ইরানি বিপ্লব এক বিপ্লব নয়। ফারাসি বিপ্লব কেবল সে দেশের সরকারের ধরন পরিবর্তন করে , জনগণের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনায় কোন পরিবর্তন আনেনি। অন্য কথায় , বিপ্লবের পরেও ফারাসিরা তাদের কামনা-বাসনা, অভ্যাস ও জীবন আচরণে আগের মতই থেকে যায়। কিন্তু বিপ্লবের পরে ইরানে আগের অবস্থা থাকেনি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ঐ স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল উপনিবেশবাদী  শক্তি ব্রিটিশ মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছিল তা তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া। স্বধীনতা সংগ্রামে আমেরিকানদের বিজয় সত্ত্বেও তাদের ভোগবাদিতা হুবহু আগের মতই থেকে যায়।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব জারদের ক্ষমতাচ্যুত করে বলশেভিকদের ক্ষমতায় আনে। ঐ বিপ্লবে কিছুটা গভীরতা থাকলেও কার্যত তা কেবল নেতৃত্বের ধরন পরিবর্তন করে মাত্র। ঐ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় একটি সাম্রাজ্যবাদী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার স্থলে একটি কমিউনিষ্ট শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। অন্য কথায়, এটি এক ধরনের আদর্শবাদী বিপ্লব ছিল বটে, কিন্তু তার পরিধি কেবল দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ ছিল। কমিউনিজমের ঐ আদর্শ ছিল মূলত তত্ত্বভিত্তিক , ব্যবহারিক জীবনে তা বাস্তবসম্মত ছিল না। একটি কাল্পনিক আশার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে তা একটা স্বর্গ রচনা করতে চেয়েছিল। এ দিবাস্বপ্ন-দ্রষ্টা লেনিন ও তাঁর কতিপয় অনুসারী মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছিল আধো-আধো ধারণা, যা ছিল পৃথিবীতে এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কল্পনাবিলাসের নক্শা মাত্র। আর তাই মাত্র ৭৪ বছর পর ঐ স্বপ্নরাজ্য ভেঙ্গে সম্পূর্ণ খান খান হয়ে গেল।

ইরানের এই বিপ্লব যেহেতু সুস্পষ্টভাবে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার উপর ভিত্তি করে গোটা জীবন ধারাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে তাই তার শেকড় একেবারে গভীরে প্রোথিত। এই বিপ্লব ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তিশীল ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত ও বাস্তবসম্মত। এ কারণেই এই বিপ্লব বিশ্বের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বিপ্লবের উপরে মাথা উঁচু করে এবং ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিপ্লবের লক্ষ্য যতটা না মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তার চেয়ে অনেক বেশি, এমনকি মূলত মানুষের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে তৎপর । মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ঘটনাক্রমে তাকে পরিত্যাগ করতে পারে এবং ভাগ্য বিড়ম্বনায় সে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দার মতো হয়ে পড়তে পারে। পক্ষান্তরে আধ্যাত্মিকতা অবলম্বনকারীর জান্নাত নিশ্চিত হতে পারে।

ইরানি বিপ্লব জনগণের কাছে যে বাণী পৌঁছে দিয়েছিল তা ছিল ধর্মীয় আবরণসমৃদ্ধ। এই বিপ্লবের জন্য ইমামের কাছ থেকে যখন বিদ্রোহের আহ্বান আসল তখন পৃথিবীর কোন শক্তি তা রুখতে পারলো না। এই বিপ্লবের ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক আবেদন স্বয়ং জনসাধারণের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

এই বিপ্লবের সাফল্য এই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, এর ধারণাটি একেবারে মৌলিক এবং তা পুরোপুরি ইসলামি নীতিমালাভিত্তিক । পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবাদের সাথে এই বিপ্লবের কোন সম্পর্ক নেই। কোন মানবীয় বিপ্লব বা মতবাদের ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি হয় ভিন্ন রকম। মানবীয় মতবাদ আসলে কোন গভীর চিন্তাপ্রসূত নয়। তা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক কসরত ও বস্তুগত বিবেচনাপ্রসূত। মানবীয় মতবাদ কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণি সৃষ্টি করে , তাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে এবং অসহায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর উপর তাদের কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দেয়। মানবীয় মতবাদ সমাজকে নানা শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলে এবং কেবল নিজের অস্তিত্ব ও টিকে থাকার স্বার্থে মানুষকে তার নিজস্ব লোকদের থেকে আলাদা করে ফেলে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং এর প্রধান স্থপতি ইমাম খোমেইনি (রহ.)- এর নিশ্চিত অথচ সরল ও অনাড়ম্বর আবেদন দেখে বিপ্লবের শত্রুরা বোকার মতো এই ধারণা গ্রহণ করেছিল যে, এক সময় এই বিপ্লবের অদম্য নেতৃত্বের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জীবনধারা শত্রুদের মিথ্যা আশাকে নস্যাৎ করে দেয়।

বিপ্লবের সাফল্য আসে সকল দিক থেকে । এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্ফটিকের মতো পরিষ্কার। এই বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনি (রহ.) ছিলেন একক মননশীলতার অধিকারী। তিনি খোদায়ী আদর্শ ও চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক ও অটল ন্যায়পরায়ণ। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ। দুশমনদের ক্ষমতা , প্রভাব ও সামরিক সম্ভারে তিনি মোটেই বিচলিত হতেন না এবং তাদের প্রতি বিমুগ্ধও হতেন না। যে কোন মানুষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন তিনি, কিন্তু কাউকে দেখে ভীত হননি । তিনি শত্রুর মোকাবিলা করতেন অত্যন্ত দৃঢ় ও স্থির সংকল্প নিয়ে। শত্রুর গতিবিধি তিনি বুঝতেন। তিনি তার ক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। ইরানি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনি (রহ.) আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ব্যক্তিগত ধন - সম্পত্তি বৃদ্ধি কখনই তার কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় ছিলনা।

ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব নিজেকে সব সময় সমাজের অবহেলিত শ্রেণির একজন মনে করেন এবং কখনই নিজের জন্য কোন বিশেষ সুযোগ – সুবিধা প্রত্যাশা করেন না।এর বিনিময়ে নেতৃত্ব লাভ করেন তাঁরবিপ্লবের অনুকূলে ব্যাপক গণসমর্থন। এই অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব ইসলামের আদর্শ কায়েমের জন্য জনসাধারণকে ত্যাগের আহ্বান জানান।

ইমাম খোমেইনি (রহ.) দেশে বা প্রবাসে যেখানেই থেকেছেন অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে জীবন যাপন করেছেন। তিনি কোন সময়ের জন্য পার্থিব সুখ-আনন্দের দিকে ঝুকেঁননি। তিনি খুব সামান্য আহার করতেন আর বেশী করে ইবাদত করতেন। তিনি অনেক সময় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। বেশী বেশী চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণকে সমান ভালোবাসার চোখে দেখতেন। তিনি ধর্ম ও বিশ্বাস নির্বিশেষে বিশ্বের সকল অবহেলিত মানুষের উদ্দেশে কথা বলেছেন।

অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষ পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সকলের জন্যই কাজ করে গেছেন। তিনি শিয়া ও সুন্নী বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছে। পবিত্র কুরআন ছিল তাঁর একমাত্র দিক নির্দেশনা ও জ্ঞানের উৎস। তিনি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতেন না।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার আরও একটি কারণ হলো মহিলাদেও যোগ্যতা ও প্রতিভাকে স্বীকৃতি দান ও উপযুক্ত ভূমিকা পালনের সুযোগ দান। ইমাম খোমেইনি (রহ.) ও তাঁর সহযোগী অন্যান্য ব্যক্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেন যে, সমাজে মহিলারা অত্যন্ত শান্ত ও ধৈর্যশীল সদস্য হিসেবে বসবাস করে। তাদের ভূমিকা কখনই খাটো করে দেখার নয়। বিপ্লবে মহিলাদেও ভূমিকা মূল্যায়ন করা হয় তাদের মানবিক, মানসিক ও দৈহিক যোগ্যতা এবং সম্ভাবনার আলোকে। এক সময় অবশ্য ইমাম খোমেইনি (রহ.) এ কথাও বলেছিলেন, “মহিলারা নিশ্চিত ভাবে পুরুষের সমান নয় এবং পুরুষও মহিলাদের সমান নয়।” তাই বিপ্লব কাউকেই পরিত্যাগ করতে চায় না।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব আল্লাহতায়ালার অনুগত্য ও জনগণের সেবার জন্য এক পরিপূর্ণ ও নতুন জীবন ধারা অনুসরণের  আহ্বান জানায়। এই বিপ্লব ইসলামি মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার কথা বলে। কারণ নেতিবাচক পশ্চিমা মূলোবোধ ও প্রভাব ইরানের জীবনধারার উপর এক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছিল। এমতাবস্থায় ইসলামকে একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান গ্রহণ করতে হয়।

তাই একে মৌলবাদ বলা হোক আর যাই বলা হোক, মূলকথা হলো একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবংএকটি নিরংকুশ বিজয় ছাড়া তা সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

এই আন্দোলন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংগঠিত করা হয় এবং নৈপুণ্যের সাথে বিপ্লব সফল করা হয়। কোন আন্দোলন কেবল আপন শক্তিতে চালিত হয়ে এমন সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে, ইতিহাসে এর কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং ইসলামি বিপ্লবের শত্রুরা তা উপলব্ধিও করতে সক্ষম হয়নি। সে আন্দেলনের প্রকৃতি ছিল ‘হয় করা আর না হয় মরা।’ ইমাম খোমেইনি (রহ.)-এর আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ বাণী অধিকাংশ ইরানির অন্তরের অন্তঃস্থলে যেভাবে প্রবেশ করেছিল তা ইতিপূর্বে আর কখনও করেনি। ইমাম (রহ.) একেবারে ইরানিদের অন্তরের ভাষায় কথা বলেছিলেন।  ইরানি জনগণের প্রতি শাহ্ এবং তার দোসররা যেসব অবমাননাকর আচরণ করেছিল তিনি নিজেও তা সহ্য করেছেন। কারাগারের বন্দীজীবন এবং নির্যাতন কি তা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন গোয়েন্দা সাভাক বাহিনীর ভয়াবহতা সম্পর্কে। প্রবাস জীবন এবং ক্ষুধার্ত যন্ত্রণা কি তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তাগুতী মনোভাব এবং তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও জানতেন। পারস্য উপসাগরীয় ও অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অসৎ উদ্দেশ্য কি তাও তিনি জানতেন। এসব জ্ঞান ও ধারণায় সমৃদ্ধ হয়েই তিনি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য।

ইমাম খোমইনি (রহ.) তাঁর অস্ত্র ও গোলাবারুদহীন জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাইন পেতে রাখা এক রণক্ষেত্রে এবং মোকাবিলা করেছিলেন বিষদাঁত সমৃদ্ধ এক শত্রুর। যে শত্রু ছিল বিশ্বের দু’টি প্রধান শক্তি সাবেক  সোভিয়েত ও মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট। কিন্তু শাহ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে নি।

ইমাম খোমেইনি (রহ.) যে আওয়াজ উত্থাপন করেছিলেন, তা ছিল বিশ্বের সকল নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষের জন্য এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।

ঐ সময় এবং তার পূর্বেও সমগ্র বিশ্ব ভাবতো শাহের শাসনে ইরান যেন একটি ভূস্বর্গ হিসাবে বিরাজ করছে। মাত্র অল্পসংখ্যক লোক ভাবতো ভিন্ন রকম।

পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো শাহ-শাসনামলের বিশেষ করে কেবল ভালো খবরগুলোই প্রচার করতো। গোপনে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্থায়ী চর হিসাবে গড়ে  তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। পরবর্তীকালে দেখা গেছে, আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছে। তবে সিআইএ ‘আত্মার ও আধ্যাত্মিক শক্তির’ ব্যাপারে কোন চক্রান্ত সফল করতে সক্ষম হয় নি।

আত্মার শক্তিই শেষ পর্যন্ত ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করে তবে অবশ্য তা উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে।

ইরানি জনগণ সেসময় নিজেদেরকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে পেশ করেছিল। তারা গণভাবে তাদের সকল ভয়ভীতি ও উদ্বেগকে আল্লাহর রাহে ত্যাগ করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল আল্লাহ না করুন-সংগ্রামরত অবস্থায় তাদেরকে যদি হত্যা করা হয়, তাহলে তারা শহীদ হবে। যেমন, ইমাম  হোসাইন  (আ.) শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আর যদি আহত কিংবা বিকলাঙ্গ হয় তাহলে তা হবে ইসলামের জন্য তাদের ত্যাগ শিকারের নিদর্শন এবং তাদের দেহের ঐ ক্ষত চিহ্ণ সব সময় স্মরণ করিয়ে দেবে যে, তারা ছিল ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সৈনিক। তাই যখনই ইরানি জনগণের প্রতি ইসলামের জন্য সংগ্রাম করার আহ্বান আসে তখন তারা তাতে সাড়া দেয়। যেমন, কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ. ) এর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল তদানীন্তন দীনদার ও খোদাভীরু লোকেরা।

ইরান যাতে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত হয়, সেজন্য ইরানি জনগণ তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ অর্থাৎ জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত ছিল। শহীদরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। বিপ্লবের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শহীদরা যত জীবন দান করেছে, বিশ্বের আর কোন বিপ্লবে এতো জীবন দিতে হয় নি। যুবক কিংবা বৃদ্ধ, বুদ্ধিজীবী কিংবা সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় গুরু, শিক্ষক, ডাক্তার, অফিস কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, ছাত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্য কেউই ইসলাম ও অন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের মূল্যবান রক্ত ঢেলে দিতে পিছিয়ে ছিল না। সে কারণেই ইসলামি বিপ্লব সাফল্যের স্বর্ণদারে গিয়ে পৌঁছে ছিল।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের ভিত্তি

:

:

:

: