ইসলাম-পরিচিতি (২)
ইসলামের মূল বাণী
ইসলামের মূল বাণী হলো সকল নবির (আ.) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অর্থাৎ তাওহীদ ও একত্ববাদের দিকে প্রত্যাবর্তন যে বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস মহানবি (সা.)-এর প্রসিদ্ধ শিক্ষণীয় বাণীতে মানুষের সফলতা ও সৌভাগ্যের উপকরণ ও নিয়ামক বলে গণ্য হয়েছে। আর এ বাণী হল: ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই তবে তোমরা সফল হবে।’ এ বিশ্বাসের সাথে ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্য ইসলামের অন্যতম মূলভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে যা-সকল নবির (আ.) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়-এমন এক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছে যার মধ্যে মানুষের গায়ের রং, বংশ, জাতি, ভাষা ও এরূপ বিষয়গুলো নিছক মানবজাতির সদস্যদের পরস্পরের পরিচিতি লাভের মাধ্যম বলে গণ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হলো তাকওয়া ও পরহেজগারি।
মহানবি (সা.) তাঁর ঐশী মিশনের এ লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য ক্ষুদ্র একটি শহরে তাওহীদ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি হেজায ও তাহামার পরস্পর বিবদমান গোষ্ঠী ও গোত্রগুলোকে এক উম্মত গঠনের প্রতি–পবিত্র কোরআনের মতে যা সকল নবির অন্যতম লক্ষ্য ছিল-আহ্বান জানালেন। যদিও স্বাভাবিকভাবেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কাজকে প্রথম স্বীয় জাতি ও গোষ্ঠীকে সতর্ক করার মাধ্যমে থেকে শুরু করেছেন কিন্তু তাঁর বাণী হলো বিশ্ব ও সর্বজনীন। (বিশ্ববাসীর জন্য নির্দেশনা ও উপদেশ, সূরা ইউসূফ/ ১২:১০৪) পবিত্র কোরআন যদিও আরবদের প্রচলিত মন্দ সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে যেমন আরবদের অন্ধ গোত্র প্রীতি, আত্মশ্লাঘা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং তাকে জাহেলি ও অজ্ঞতাজনিত আত্মশ্লাঘা বলে অভিহিত করেছে কিন্তু এর পাশাপাশি তাদের পছন্দনীয় অনেক রীতিনীতিকে-যা পূর্ববর্তী ঐশী শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং পরে তাতে বিচ্যুতি সাধিত হয়েছে-তাওহীদী রূপ দিয়েছে বা সংশোধিত করেছে।
ইসলামের প্রথম খলিফাগণ
মহানবি (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন গোত্র একক হুকুমতের (এক রাষ্ট্রের) অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এ রাষ্ট্রটি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সহচরদের মধ্যে কয়েক ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হয় যারা ‘খালিফাতু রাসূলিল্লাহ’ (আল্লাহর রাসূলের খলিফা) বলে পরিচিত হন। তাঁর তিরোধানের পর তিন দশকে তাঁর সহচরদের মধ্যে প্রভাবশালী চারজন একের পর এক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাঁদের শাসনকাল তাঁদের পরবর্তী শাসকদের শাসনকালের সাপেক্ষে (তুলনায়) মহানবির (সা.) সুন্নাত ও অনুসৃত রীতি ও কর্মপন্থার নিকটবর্তী ছিল। তাঁদের শাসনকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তা রাজতন্ত্র ও বংশগত উত্তরাধিকার ছিল না। এ চার খলিফাকে পরবর্তীতে ‘খোলাফায়ে রা’শিদাহ’ নামে অভিহিত করা হয়। শাসনকালের পর্যায়ক্রমে তাঁরা হলেন আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (আ.)।
ইসলামের মৌল বিশ্বাস
ইসলামের মৌল বিশ্বাস অর্থাৎ একত্ববাদ, নবুওয়াত ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মের ভিত্তি বলে গণ্য। এ কারণে ইসলামি সূত্রসমূহে উল্লিখিত যে কোনো বাক্যেরই–বিবরণমূলক হোকবা নির্দেশনামূলক (নির্দেশসূচক)-অর্থগত উদ্দেশ্য নির্ণয়ের বিষয়টি কোনো না কোনোভাবে এ তিন মৌল বিশ্বাসের যে কোনো একটির অথবা তিনটিরই ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং এ মৌল বিশ্বাসগুলোর বিষয়ে ইসলামের অনুসারীদের সকলেই একমত যদিও এগুলোর অর্থ, ব্যাখ্যা ও খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্যই শুধু নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম বৈপরীত্য রয়েছে। তারা সকলেই নির্দ্বিধায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে এ বিশ্বাস রাখে যে, ১. মহান আল্লাহ সত্তাগত, গুণগত ও কর্মগতভাবে এক ও অদ্বিতীয় এবং কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়; ২. হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত ঐশী বাণীবাহী পুরুষ যিনি নবিদের আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবি হিসাবে মনোনীত হয়ে এসেছেন। পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর মৌখিক বাণীর এক সঙ্কলন যা তাঁর (সা.) নিকট ওহিরূপে (প্রত্যাদেশ) এসেছে। ৩. পরকাল বা কিয়ামত দিবস অবশ্যম্ভাবী এক দিন যেদিন সকল মানুষকে তাদের ভালো ও মন্দ চিন্তা ও কর্মের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং পুণ্য ও সৎকর্মশীলরা বেহেশতে ও মন্দ ও অসৎকর্মকারীরা দোজখে যাবে।
ক. খোদাপরিচিতি
পবিত্র কোরআনের শিক্ষানুযায়ী মহান আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়টি এতটা স্পষ্ট যে, এর জন্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। এজন্যই এ ঐশী গ্রন্থে সমগ্র অস্তিত্ব জগতে আল্লাহর গুণাবলি, কর্ম ও মর্যাদার বিচিত্র প্রকাশ নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণের সপক্ষে কোনো আলোচনা করা হয়নি। কারণ, তাঁর উপস্থিতি এতটা আবরণহীন ও সমুজ্জ্বল যে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। (সূরা ইবরাহিম/ ১৪:১০)
খ. বিশ্বপরিচিতি
বিশ্বজগৎ কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তো নয়ই; বরং এর অদৃশ্যজগৎ বস্তুজগতের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত ও প্রসারিত। পবিত্র কোরআন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতকে, অদৃশ্যজগতের (আলামে গাইবাত) বিপরীতে ‘দৃশ্যমান’ জগৎ (আলামে শাহাদাত ও প্রত্যক্ষ) বলে অভিহিত করেছে। (সূরা রাআ’দ/ ১৩:৯) অদৃশ্যজগতের প্রতি বিশ্বাসের বিষয়টি পবিত্র কোরআনে এতটা গুরুত্বের অধিকারী যে, পরহেজগারদের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনায় নামায প্রতিষ্ঠা এবং ওহি (ঐশী গ্রন্থসমূহ) ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনার সমপর্যায়ে স্থান পেয়েছে।
গ. নবুওয়াত
‘নবি’ نبی শব্দটি ‘নাবা’ نبأ শব্দমূল -যার অর্থ খবর- থেকে নেওয়া হয়েছে। নবিদের এজন্য নবি বলা হয় যে, তাঁরা অদৃশ্য জগতের খবর দেন। পবিত্র কোরআন (নবিদের মধ্যে বিদ্যমান) অদৃশ্য জগৎ থেকে সংবাদ গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন বোধশক্তিকে ‘ওহি’ এবং যে ব্যক্তি তা লাভ করে তাকে নবি বা রাসূল বলে অভিহিত করেছে। ওহি হলো আল্লাহর সাথে মানুষের কথোপকথনের মাধ্যম যা ব্যক্তি নবি হওয়ার শর্তে আল্লাহর পক্ষ থেকে পেয়ে থাকে। (সূরা নিসা/ ৪:১৬৩) ওহি ওপ্ররণের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সতর্ক করা বিশেষত কিয়ামতের হিসাব-কিতাবের বিষয়ে তাদের সতর্ক করা। কেননা, যদি নবিরা কিয়ামত সম্পর্কে সতর্ক না করতেন তবে কোন দ্বীনি দাওয়াতই সফল হতো না। ওহি বা নবিদের অভ্যন্তরীণ রহস্যময় বোধশক্তি কখনই পরিবর্তিত ও লয়প্রাপ্ত হয় না। এজন্যই নবিরা সবাই নির্ভুল ও নিষ্পাপ। নবিরা তিন ক্ষেত্রে নির্ভুলতার অধিকারী: আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ভুলতা, আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভুলতা এবং পাপকর্ম থেকে মুক্ততা অর্থাৎ এমনকর্ম যা আল্লাহর আদেশের বিরোধী এবং তাঁর আনুগত্যের পরিপন্থী ও দাসত্বের লঙ্ঘন বলে গণ্য তাঁরা তা থেকে প্রমুক্ত। তাঁদের সত্তায় এমন কিছু রয়েছে যা তাঁদের অপছন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য কর্ম, যেমন ভুল-ত্রুটি ও গুনাহ থেকে নিবৃত্ত রাখে।
নবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুজিযা (অলৌকিক নিদর্শন) প্রদর্শন। পবিত্র কোরআন এমন কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছে যা প্রাকৃতিক নিয়ম বহির্ভূত বা তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল। কোরআন এধরনের অনেক মুজিযা কিছুসংখ্যক নবি, যেমন : হযরত নূহ, হূদ, ছালিহ, ইবরাহিম, লূত, মূসা, দাউদ, সুলায়মান, ঈসা ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি আরোপ করেছে। ইসলাম একমাত্র ধর্ম যা মানবজীবনের সবদিক নিয়ে আলোচনা করেছে এবং মানুষের কর্ম ও তার সাথে সম্পর্কিত পৃথিবীতে বিদ্যমান বস্তুসমূহকে পবিত্র ও অপবিত্র এ দু’ভাগে ভাগ করেছে। প্রথম প্রকারের কর্ম ও বস্তুকে হালাল (বৈধ) এবং দ্বিতীয় প্রকারের কর্ম ও বস্তুকে হারাম (অবৈধ) বলে ঘোষণা করেছে। ইসলাম পূর্ববর্তী ঐশী ধর্মসমূহের (আহলে কিতাবের শরীয়তের) বিশেষত ইহুদি ধর্মের কঠোর ও অসহনীয় কষ্টকর বিধানসমূহকে রহিত করেছে।
মহানবি (সা.)-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি শেষ নবি এবং এবং তাঁর আনীত ধর্ম ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম। (সূরা আহযাব/ ৩৩:৪০) ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম হওয়ার অর্থ হল এ ধর্মের বিধান ও নির্দেশাবলি কখনও রহিত হবে না এবং এ শরীয়ত চিরস্থায়ী এবং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পূর্ণতার সীমা কেবল তা-ই যা কোরআন বর্ণনা করেছে এবং এতে শরীয়তের বিধান হিসাবে প্রণীত ও বর্ণিত হয়েছে। আর কোরআন হলো মহানবি (সা.)-এর চিরন্তন ও জীবন্ত মুজিযা। কোরআন ইসলামের সবচেয়ে মৌলিক উৎস ও সূত্র। এ গ্রন্থ কেবল ইসলামের মৌলনীতি ও শিক্ষা অর্থাৎ মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়সমূহ ও তার থেকে উৎসারিত অন্যান্য বিশ্বাসের বিষয়গুলোকেই শামিল করে না; বরং এর সাথে পছন্দনীয় নৈতিক চরিত্র ও পন্থা এবং দ্বীন ও শরীয়তের সার্বিক আইন-কানুন ও বিধিবিধানও বর্ণনা করে। কোরআনের দাবি অনুযায়ী এ গ্রন্থ এমন এক জীবনব্যবস্থার দিকে আহ্বান করে যা অন্য সব ধর্মের তুলনায় উত্তমরূপে মানবজাতিকে পথনির্দেশ দেয় ও সেদিকে পরিচালিত করে। (সূরা বনি ইসরাঈল/ ১৭:৯)
ঘ. পরকাল
পরকালে বিশ্বাস ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি বলে গণ্য। পরকালকে অস্বীকারের আবশ্যিক পরিণতি হলো আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, বেহেশতের প্রতিশ্রুতি ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে সতর্ককরণ এবং ওহি ও নবুওয়াতকে অস্বীকার যা প্রকৃতপক্ষে এ ঐশী ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারের নামান্তর।
পবিত্র কোরআনের বহু সংখ্যক আয়াত বিভিন্নভাবে পরকালের সাথে সম্পর্কিত। কোনো কোনো আয়াতে যখন কাফেরদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে তারা যে তাওহীদ ও নবুওয়াতে বিশ্বাসী নয় তার উল্লেখ না করে কেবল তাদের এ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করাই যথেষ্ট গণ্য করা হয়েছে যে তারা পরকালকে অস্বীকারকারী। (বনি ইসরাঈল/১৭:১০) এ বিষয়টি নির্দেশ করে যে, যদি কেউ আল্লাহর একত্ব ও ধর্মের অন্যান্য মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়ে ঈমান রাখে কিন্তু পরকালকে অস্বীকার করে তবে তার এ বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই।
ইসলাম-পরিচিতি (২) | |