এজেন্সি
ইমাম খোমেইনী (রহ.) : ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি জাগরণ

ইমাম খোমেইনী (রহ.) : ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি জাগরণ

ইমাম খোমেইনী (রহ.) : ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি জাগরণ

তাহের আমেনী গোলেস্তানী

আমাদের আধ্যাত্মিক বিপ্লব স্বল্পকালের মধ্যেই বিশেষজ্ঞগণের মতামতকে অকার্যকর প্রমাণ করে দিল। বস্তুতন্ত্রের নিরিখে তৈরি করা বস্তুবাদীদের অনুসিদ্ধান্ত- খালি হাতে একটি জাতি কখনও পরাশক্তির মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না- ভুল হিসেবে প্রমাণিত হলো। তারা প্রশ্ন তুলেছিল বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত আনাড়ি যুবকদের অথবা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানরত শিক্ষকদের পক্ষে একটি সুসংহত রাষ্ট্রশক্তি- যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সবকিছু, তাকে পরাভূত করা কি আদৌ সম্ভব? তাদের বস্তুতান্ত্রিক এ ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে আমাদের আধ্যাত্মিক বিপ্লবের টিকে থাকা। বস্তুবাদী বিশ্লেষকদের সব ধরনের বিশ্লেষণ এখানে হার মেনেছে। তাহলে এখানে কী ঘটেছে? এখানে আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাপনা পুরো ঘটনার পেছনে সর্বদা ক্রিয়াশীল ছিল। মহান আল্লাহ নিজের হাতে পুরো ঘটনা সাজিয়ে দিয়েছেন। কোন মানুষের কর্ম-প্রচেষ্টায় এরকম একটি আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়, এরকম একটি অভূতপূর্ব শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মানবজাতির পক্ষে সম্ভব নয় নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবা- একটি দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে স্বীয় জীবন উৎসর্গের মন্ত্রে দীক্ষিত করা। এটা ছিল খোদায়ী শক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং ঐশী অনুপ্রেরণা, যা জনগোষ্ঠীর সকল স্তরের মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল, পরস্পরকে ভাইয়ে রূপান্তরিত করেছিল; আর বস্তুবাদী পণ্ডিতদের সকল গবেষণা নিষ্ফল করে দিয়েছিল।

১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সমস্ত দুনিয়া প্রত্যক্ষ করলো ইসলামি বিশ্বে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আবির্ভাব এবং তাঁর সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া। তাঁর আবির্ভাব ইরানে ঘটলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে এক অনন্য পরিচিতি এনে দেয়। ইসলামের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়কে দৃঢ় ভিত্তি দান করে যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে অনুপ্রাণিত করে।

ইরানি বিপ্লব (যা ‘ইসলামি বিপ্লব’ অথবা ‘১৯৭৯ বিপ্লব’ নামে খ্যাত) পাহলভী রাজবংশের মুহাম্মাদ রেযা শাহ্কে উৎখাত করার অবিস্মরণীয় ঘটনার সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে ইরান আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান-এ রূপান্তরিত হয়।

বিপ্লব-পরবর্তী যুগে প্রচলিত কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে যেগুলোর সাথে রাজনীতির কোনরূপ সম্পর্ক নেই। এই আলোচনাসমূহ ‘মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের অনুসরণের স্কুল অব থট’কে বিভিন্নভাবে বিকশিত করেছে।

ইসলামি বিপ্লব জনগণের ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটায় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও বিভাগগুলোতে পরিবর্তন এনে মন্দ পরিস্থিতিসমূহ বিদূরিত করে গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি নিশ্চিত করে।

কতিপয় বিশ্লেষক ইসলামি বিপ্লবকে নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করেন- বস্তুত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বিপ্লব সফল হওয়ার আগে এ রকম কোন বিপ্লবের নজির বিশ্বে ছিল না। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে যা প্রচলিত কিছু রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ বিপ্লবগুলো দরিদ্রতা অথবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সংঘটিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবসমূহও মূলত শাসকের অত্যাচার, নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হবার অদম্য বাসনা থেকে সৃষ্ট প্রতিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেপথ্যেও এ সকল কারণ ক্রিয়াশীল ছিল, কিন্তু এসব কারণের বাইরেও কিছু কারণ ছিল যা এ বিপ্লবকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। বিপ্লবের এ নতুন ধারণা শুধু অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়ই ছিল না; বরং বিপ্লব প্রচলিত ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থার তত্ত্বেও বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় এবং এক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটায়। বিভিন্ন উপলক্ষে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর বক্তৃতায় বলেন : “এসত্য কারো কাছে গোপন নয় যে, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য এবং বিপ্লবের বিজয়ের পেছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তা হলো স্বয়ং ইসলাম; আর আমাদের ইরানি জাতির জনগণ, হোক সে রাজধানীর বা অন্য কোন শহরের অথবা অখ্যাত কোন গ্রামের অধিবাসী, তাদের আত্মত্যাগ, তাদের রক্ত ও তাদের ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি। তাঁরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অসংখ্য জনতার উপস্থিতিতে নজিরবিহীন ও অবিস্মরণীয় গণভোটে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ভোটদান করেছেন এবং ফলে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকল দেশ ইরান নামের ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’-কে স্বীকৃতি প্রদান করে।’ উপরিউক্ত কারণসমূহের দ্বারা ইরানে যে সংবিধান পাশ হয় এবং আইন প্রণীত হয় তা শতভাগ ইসলামের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। যদি ছোট একটি অনুচ্ছেদও ইসলামের বিশ্বাসের পরিপন্থি হয় তবে সেটা হবে প্রজাতন্ত্রের এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মতের পরিপন্থি।”
কিছুসংখ্যক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞের মত হলো, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ধারা মুসলমানদের মাঝে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন মুসলিম সমাজে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে ইমাম খোমেইনী (রহ.) রাজনৈতিক ইসলামকে পুনঃপ্রচলন করেন এবং এই ইসলামকে তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলাম হিসেবে রূপায়িত করেন। তিনি ধর্ম এবং রাজনীতির মধ্যে এমনভাবে সমন্বয় করেন যাতে সমাজ এবং রাজনীতির প্রাণশক্তিতে পরিণত হয় ইসলাম। যার ফলে ইরানি জনগণের মাঝে শাহাদাত, মহান আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগ এবং শাসকের যুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনা উদ্দীপ্ত হয়। ইসলামি বিপ্লব আধুনিক বিশ্বে ইসলামের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যাবলি

ইসলামি বিপ্লব ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত বহুমাত্রিক ধারা সৃষ্টি করে। বিপ্লবের ফলে বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হয় এবং তাদের মাঝে আত্ম-সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আস্থাবোধ সর্বোপরি ইসলামি চেতনার উন্মেষের বিকাশ ঘটার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিপ্লব বিভিন্ন মুক্তি আন্দোলন ও নব উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুক্তির আদর্শ, সামাজিক ন্যায়-বিচার, বহিঃশক্তির প্রতিরোধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে টেকসই গতিশীল ব্যবস্থাপনার ব্যবহার করতেও এটি তাগিদ দেয়।

ইসলামি বিপ্লবের কিছু বৈশিষ্ট্য

১. স্বৈরাচার থেকে মুক্তি

২. ঐক্যের শক্তি

৩. আইন ও ন্যায় বিচার

৪. আত্মবিশ্বাস ও নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা

৫. স্বকীয় সত্তা (না পূর্ব, না পশ্চিম)

৬. ইসলাম সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণা

অধিকন্তু ইসলামি বিপ্লব এখনও পশ্চিমা শক্তি ও বিভিন্ন অপশক্তির নানামুখি অপপ্রচারের শিকার। শুরু থেকে ইসলামি বিপ্লব পরাশক্তির সাথে আপোস করেনি। ঈমানের বলে বলীয়ান হওয়ায় এই বিপ্লব পরাশক্তির সামরিক শক্তির ভীতিকে মোকাবেলা করতে পেরেছে। ইরান শত্রুর সকল ধরনের চাপের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। তাই এই বিপ্লবকে মজবুত বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

এত কিছুর পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রাপ্তি অনেক। ইসলামি দুনিয়ায় বিভিন্ন অংশে সঠিক ইসলামের পুনঃপ্রচলন ও ইসলামি আন্দোলনকে প্রভাবিত করছে এই বিপ্লব। এই বিপ্লব ইমামের আদর্শকে ধারণ করে সমস্ত ধরনের গোষ্ঠীবিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে নিঃসন্দেহে বিশ্ব মুসলিমকে জাগ্রত করছে।

Reference:

  1. Sahifeh Noor, vol 7, P-174
  2. Islamic Revolution of Iran, MS Encarta, Archived October 31, 2009
  3. The financial press, vol. 20, no. 387, Regd No. DA 1589
  4. God is Greater than everything and to be described
  5. Sahifeh Noor, vol. 9, P-280

অনুবাদ : সেলিনা পারভীন

ইমাম খোমেইনী (রহ.) : ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি জাগরণ

:

:

:

: