হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অসিয়তনামা
ইসলামী উম্মাহর অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) সারাটি জীবন ধরে ইসলামী উম্মাহর ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর এ সংগ্রামের ফলে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বুকে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হয় এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । তাই ইরানের বিপ্লবী মুসলিম জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়। এ বিপ্লব বিজয়ী হবার পরে ও ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইসলামী বিপ্লবের হেফাযত, বিস্তার এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কথা, লিখা ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ইরানের বিপ্লবী জনগণ কিভাবে পথ চলবে সে ব্যাপারে পথনির্দেশ দানের জন্য তিনি তাঁর অন্তিম বাণী রেখে গেছেন। আর অন্তিম বাণীসহ তাঁর এ সমগ্র ততপরতারই একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া।
আরেফে রব্বানী হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রতিটি মুহূর্তেই খোদার দিদারের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তাই ইন্তেকালের সাড়ে ছয় বছর পূর্বে তিনি তাঁর অন্তিমবাণী রচনা করেন এবং রচনার সমাপ্তিতে হিজরি ১৪০৩ সালের পহেলা জমদিউল আওয়াল (মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) তারিখে স্বহস্তে লিখিত এ বাণীতে সমাপ্তি স্বাক্ষর ও তারিখ লিপিবদ্ধ করেন। এ অন্তিমবাণীর প্রতিটি পৃষ্ঠার শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর সীলমোহর সহকারে তা ধর্মীয় নগরী মাশহাদে আহলে বাইতের অষ্টম নিষ্পাপ ইমাম হযরত রেযা (আ.)-এর মাযারে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটি অনুলিপি তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। বছর দুই পূর্বে তিনি তাঁর এ অন্তিমবাণীর মূল কপি মাশহাদ থেকে আনিয়ে নেন এবং কিছুটা সংশাধন করে পুনরায় সীলমোহর করে মাশহাদে পাঠিয়ে দেন।
হযরত ইমামের ইন্তেকালের পরদিন ৪ঠা জুন (১৯৮৯) সকাল ৯টা ১০ মিনিটের সময় মজলিশে শুরায়ে ইসলামী ভবনে অনুষ্ঠিত নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ, মজলিশে শুরায়ে ইসলামীর সদস্যগণ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের যৌথ সমাবেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ততকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান রাহবার) হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক এ অসিয়তনামা পঠিত হয়। এরপর জাতীয় প্রচারমাধ্যমসমূহে তা প্রচারিত হয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক হযরত ইমামের অন্তিম বাণীটি মরহুমের সংরক্ষিত অনুলিপি থেকে পঠিত হয়; পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাশহাদে সংরক্ষিত মূল কপিটি খোলা হয়। হযরত ইমামের স্বহস্তলিখিত এ অসিয়তনামার মূল অংশটি ২৯ পৃষ্ঠা, ৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা ও ১ পৃষ্ঠা পরিশিষ্টসহ মোট ৩৬ পৃষ্ঠা।
হযরত ইমামের অসিয়তনামার পূর্ণ বিবরণ
নবীপাক (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সম্মানিত দু’টি জিনিস (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। অতঃপর নিশ্চয়ই এ দুটি জিনিস হাউজে (কাউসারে) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’-হাদীসে সাকালাইন১
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের, যিনি সকল কিছু থেকে পবিত্র। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর অবারিত শান্তি বর্ষণ কর, যাঁরা তোমার সৌন্দর্য ও মহিমার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা তোমার আসমানি গ্রন্থের গুপ্ত রহস্যের ভাণ্ডার। এটা এমন এক গ্রন্থ যার মাঝে তোমার সকল পবিত্র নাম, এমনকি ইসমে মুন্তাসার (ইস্মে আযম) সহ একত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যে ইসমে মুন্তাসার-এর প্রকৃত তাৎপর্য সম্বন্ধে তুমি ব্যতীত আর কেউ অবহিত নয়। আর অপবিত্র বৃক্ষের মূল যালেমদের প্রতি তোমার অভিশাপ বর্ষিত হোক।
অতঃপর এই ‘দুই পবিত্র আমানত’ (সাকালাইন) সম্পর্কে সংক্ষেপে আপনাদের কিছু অবহিত করা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করছি। এদের অলৌকিক, আধ্যাত্মিক বা মরমি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। যেখানে আমার মতো খালকের লেখনি কূল মখলুকের সেই সুবিশাল সাম্রাজ্যে এগিয়ে যেতে অক্ষম, যা দুনিয়া থেকে সপ্ত আসমান এবং সেখান থেকে সুমহান খোদায়ী অস্তিত্ব অবধি পরিব্যাপ্ত। যার ধারণা আমার এবং আপনার বোধগম্য নয়, বরং সাধ্যেরও বাইরে। যদিও এটাকে অসম্ভব বলছি না। সর্বোত্তম আমানত ‘আল কোরআন’ ও তার পরের মর্যাদায় ‘আহলে বাইত’ বস্তুতপক্ষে এই ‘আহলে বাইত’ সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তার মাঝে সর্বোত্তম আমানত ছাড়া আর কিছুই নয় যা ‘পরম শ্রেষ্ঠতম’ (আকবরই মতলুক)। সর্বোত্তম আমানতদ্বয়ের প্রকৃতি ও গুণাবলির প্রতি অবহেলা ও এর থেকে দূরে থাকার কারণে মানবজাতির পরিণতি কি হয়েছে তার কোন ফিরিস্তি আমি দিচ্ছি না কিংবা আল্লাহর দুশমনদের এবং কুচক্রী শাসকদের তরফ থেকে এই দুই আমানতের প্রতি কী আচরণ করা হয়েছে তারও কোন হিসাব আমি তুলে ধরছি না। এদের সংখ্যা এতো বেশি যে, সময়ের অভাবে ও সীমিত জ্ঞানের দ্বারা তার সম্যক অনুধাবন আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি শুধু পবিত্র এ দুই আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে তারই খানিকটা বক্তব্য তুলে ধরা উপযুক্ত মনে করছি।
‘এই দুটি কখনো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না আমার সাথে হাউজে (কাওসার) মিলিত না হওয়া পর্যন্ত’- কথাটি দ্বারা সম্ভবত এটাই ইংগিত বহন করে যে, নবী করিম (সা.)-এর তিরোধানের বেলায়ও ঘটেছে তাই। একটিকে অমান্য করা মানে অপরটিকেও অমান্য করা ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না হাউজে কাওসারে, রাসূলুল্লাহর সাথে উভয়ের মিলন ঘটে। এ ‘হাউজ’ বলতে কি একত্বের মাঝে একাধিকত্বের সম্মিলন, না বারিবিন্দুসমূহের মহাসমুদ্রে বিলীন হওয়ার মতো অবস্থা, না অন্য কিছু তা সাধারণ মানববোধের অতীত বিষয়! এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, আল্লাহর রাসূলের দুই আমানতের প্রতি অত্যাচারীদের পক্ষ থেকে যে অন্যায় করা হয়েছে ঠিক তদ্রূপ অবিচার করা হয়েছে সাধারণ মুসলিম জাতির (উম্মতে ইসলামীয়া) প্রতি, তথা গোটা মানবজাতির প্রতি, যার বর্ণনা দানে এই ক্ষুদ্র লেখনি অপারগ।
এটা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, ‘হাদীসে সাকালাইন’ রাসূলে পাক (সা.) থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়ে এসেছে। এই মহান হাদীস সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে মুসলমানদের সকল মাযহাবের জন্য এক অকাট্য দলিল (হুজ্জাতে কাতে)। সব মুসলমানের ক্ষেত্রেই এই দলিল প্রযোজ্য। অজ্ঞ-মূর্খদের এতে ওজর থাকলেও মাযহাবসমূহের আলেমদের কোন অজুহাতই নেই।
এখন দেখা যাক সুমহান খোদায়ী নেয়ামত এই আল্লাহর কিতাব এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া পবিত্র আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে। সেই দুঃখজনক ঘটনাবলি শুরু হয়েছিল ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর থেকেই- যার স্মরণে অবশ্যই রক্তাশ্রু ঝরা উচিত। কোরআনবিরোধী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে স্বার্থান্বেষী লোকজন ও যুলুমবাজের দল কোরআনকে উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারীদেরকে, শিক্ষিত ও জ্ঞানীদেরকে, যাঁরা সরাসরি রাসূলে পাক (সা.)-এর কাছ থেকে কুরঅআনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অজুহাত তুলে দৃশ্যান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; যাঁদের কানে অনুরণিত হচ্ছিল বারবার সেই নবীবাণী- ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মহান ও মূল্যবান দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।’
প্রকৃতপক্ষে যে কোরআন মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছে সর্বোতকৃষ্ট জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা সেইদিন পর্যন্ত যেদিন হাউজে কাওসারে নবীর সাথে ঘটবে মিলন, সেই কোরআনুল কারিমকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পবিত্র কিতাবের অন্যতম আদর্শ, সঠিক খোদায়ী ইনসাফভিত্তিক হুকুমতকে তারা বাতিল ঘোষণা করে এবং আল্লাহর দ্বীন, তাঁর পবিত্র কিতাব ও সুন্নাহ থেকে এত বেশি বিভ্রান্তিকর ধারণার জন্ম দেয় যে, তা বর্ণনা করতে রীতিমত হতবাক হতে হয়। আর যতই এই ভ্রষ্ট কাঠামোটি এগিয়ে যেতে লাগল ততই বক্রতা ও বিচ্যুতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর তা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলো যে, পাক কোরআন- যে পবিত্র গ্রন্থ মহানবী মুস্তাফা (সা.)-এর ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ও ওহীর সমাপ্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দুনিয়ার মানবজাতিকে সমুন্নত করতে, মুসলমানদের ঐক্য, এমনকি গোটা মানবজাতির ঐক্যের উতস হিসেবে, যাতে মানবতার যথার্থ উন্নয়ন সাধিত হয়, যার আগমন শয়তান এবং তাগুতীদের হাত থেকে আল্লাহ পাকের পবিত্র নামোদ্ভূত জ্ঞানের সৃষ্টি মানবসন্তানদের (ওয়ালীদা-ইলমুল আসমা) রক্ষা করতে, ন্যায়বিচার (আদল) এবং সাম্য (ক্বিস্ত) প্রতিষ্ঠা করতে, হুকুমতকে আল্লাহর মাসুম বন্ধুদের (তাঁদের উপর দরুদ ও সালাম পৃথিবীর আদিকাল হতে তার সমাপ্তিকাল পর্যন্ত) হাতে সমর্পণ করতে, যেন তাঁরা মানবতার স্বার্থে উতসর্গকৃত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করতে পারেন, কিন্তু এই কোরআনকে এমনভাবে ময়দান থেকে বিদায় দেয়া হয়েছিল যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যেন মানবতার পথনির্দেশনায় এর কোন ভূমিকাই নেই। এই বিচ্যুতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, স্বৈরাচারী সরকারগুলো এর অপব্যবহার শুরু করেছিল। পরম প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন এবং যালেমদের শাসনকে বৈধ রূপ দেবার জন্য এবং সমাজে অবিচার ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠার (হুকুমতে গায়ের) জন্য অত্যাচারী শাসকদের চেয়ে নিকৃষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ আলেমদের (আখুন্দ) দ্বারাই কোরআনের অপব্যবহার হয়েছিল বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, কুচক্রী ও মূর্খ বন্ধুদের কাছে এই ভাগ্যনির্ধারক কিতাব আল-কোরআন এর কবরস্থান আর দাফন অনুষ্ঠানগুলোতে আবৃত্তি ছাড়া যেন অন্য কোন ভূমিকাই আর থাকল না। যে কিতাব হওয়ার কথা ছিল মুসলমানদের তথা সমগ্র মানবজাতির একতার উতস এবং তাদের এক জীবন্ত নিদের্শনা, অথচ হয়ে গেল অনৈক্য আর বিচ্ছিন্নতার উতস। কিংবা কোরআনকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা হলো যে, কেউ যখনই ইসলামী সরকার বা ইসলামী রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলত অর্থাত সেই সুমহান ইসলাম- যা মহানবী (সা.)-এর জীবন এবং কোরআন-সুন্নাহর বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গ রূপ, তখনই ‘রাজনৈতিক আলেম’ (আখুন্দে সিয়াসী) তথা পরিপূর্ণ ধর্মচ্যুত আলেম নামে আখ্যয়িত করা হত। যেন ইসলামী রাজনীতির কথা বলে সে কোন মহা-অপরাধ করে ফেলেছে। এ অবস্থা বর্তমানকালেও বিদ্যমান।
অতি সম্প্রতি পাক কোরআনের সঠিক পরিচয় মুছে ফেলার লক্ষ্যে এবং বৃহত শক্তিগুলোর স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে শয়তান শক্তিগুলো ইসলামের প্রতি দায়িত্বশীল বলে মিথ্যা দাবিদার, পথভ্রষ্ট মুসলিম সরকারগুলোর মাধ্যমে চোখধাঁধাঁনো লিপি-চাতুর্যের সাহায্যে রঙচঙে কোরআন শরীফ প্রকাশ করে। লোকজনকে মিথ্যার মোহজালে বিভ্রান্ত করার মানসে সর্বত্র এই ধরনের কোরআন শরীফ ছড়িয়ে দেয়। এটা হলো কোরআনকে জীবনপট থেকে সরিয়ে ফেলার অপকৌশল। আমরা সকলেই নিজ চোখে দেখেছি, মুহাম্মাদ রেযা খান পাহলভী (শাহ) কর্তৃক মুদ্রিত কোরআন কিভাবে কতিপয় মৌলভীসহ লোকজনকে প্রতারণা করেছে। ইসলামের লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ এসব লোকজন শাহের গুণগানে ছিল মুখর। আমরা আরো দেখেছি, প্রতিবছর কিভাবে বাদশাহ ফাহদ জনগণের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় করে এই ধরনের কোরআন শরীফ অজস্র পরিমাণে প্রকাশ করে থাকে। এর মাধ্যমে সে কোরআনবিরোধী ওয়াহাবী মতবাদ (যা কুসংস্কারপূর্ণ ও ভিত্তিহীন একটা জঘন্য মতবাদ) এর ঘৃণ্য প্রচারণায় লিপ্ত। এর ফলে অজ্ঞ ও নিরীহ জনসাধারণ ও বিভিন্ন জাতি বৃহত শক্তিগুলোর প্রতি আকর্ষিত হয়। আর এই অপকৌশল থেকে ফায়দা হাছিল করে তা তারা প্রিয় ইসলাম এবং পবিত্র কোরআনের ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত করে।
আমরা গর্ব অনুভব করি এই জন্য যে, আমরা মহান ইসলাম ও কোরআনের প্রতি আত্মোতসর্গকৃত জাতি। গৌরবান্বিত এই জন্য যে, আমরা এমন একটি মাযহাবের অনুসারী যা কোরআনী সত্যকে কালের সমাধি খুঁড়ে উন্মোচনে ততপর, সে সত্য মুসলমানের ঐক্য, এমনকি মানবতার ঐক্যের কথা বলে। যে সত্য সকল প্রকার বন্ধন ও শৃঙ্খল থেকে মানবতার মুক্তির ব্যবস্থাপনা- যে বন্ধন ও শৃঙ্খলসমূহ মানবতার হাত-পা, অন্তর ও বিবেকের টুটি চেপে ধরেছে আর তাকে (মানবতাকে) ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংস ও তাগুতীদের (মিথ্যাশ্রয়ীদের) দাসত্ব ও উপাসনার দিকে।
আল্লাহ তাআলার অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে নবীপাক (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সে পবিত্র মাযহাবের অনুসারী হয়ে আমরা আজ গর্বিত এবং আমরা এ জন্যও গর্বিত যে, বিশ্বাসীদের মহান নেতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ইবনে আবি তালিব-সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত মহান সেই বান্দা-যাঁর উপর মানুষকে দাসত্বের সকল প্রকার শৃঙ্খল থেকে মক্ত করার ভার অর্পিত।
আমরা গৌরবান্বিত যে, নাহজুল বালাগাহ্ নামের মহাগ্রন্থটি আমাদের নিষ্পাপ (মাসুম) ইমাম [হযরত আলী (আ.)] থেকে- যে নাহজুল বালাগাহ হচ্ছে কোরআনের পর মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও জাগতিক জীবনব্যবস্থা ও মানবজাতির মুক্তির সর্বোতকৃষ্ট গ্রন্থ। যে গ্রন্থের আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক অনুশাসন ও নীতিমালাগুলো হচ্ছে পরম মুক্তির শ্রেষ্ঠ পথ।
আমরা এজন্য গর্বিত যে, আমদের মাসুম ইমামগণ হচ্ছেন হযরত আলী বিন আবি তালিব (আ.) থেকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা যামানার সর্দার হযরত মাহদী (আ.) পর্যন্ত যিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কুদরতে জীবিত (আছেন) ও আমদের সকল কার্যকলাপ অদৃশ্য থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
আমরা এজন্যও গর্ব অনুভব করছি যে, প্রাণসঞ্জীবনী দু’আ বা প্রার্থনাসমূহ যা ‘কোরআনে সায়েদ’ অর্থাত ‘ঊর্ধ্বগামী কোরআন’ নামে পরিচিত তা আমাদের ইমামদেরই রচিত। ইমামদের শা’বানীয়া মুনাজাত, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আরাফাতের দু’আ, আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্মীয় বন্দনা বা ‘যাবুর-ই আলে মুহাম্মাদ’ নামে প্রসিদ্ধ ‘সাহীফা-ই-সাজ্জাদিয়াহ’, হযরত ফাতেমা যাহরা মারযীয়ার প্রতি আল্লাহপাকের তরফ থেকে ইলহামকৃত ‘সাহীফা-ই ফাতেমীয়া’- এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের।
পঞ্চম ইমাম বাকের-উল উলুম (আ.)-কে নিয়েও আমরা গর্বিত। তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। একমাত্র আল্লাহ জাল্লা শানুহু, তাঁর পেয়ারা রাসূল (সা.) এবং মাসুম ইমামাগণই তাঁর মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম।
আর আমরা গৌরবান্বিত যে, আমরা জাফরী মাযহাবের অনুসারী। সীমাহীন মহাসমুদ্রের মতো বিশাল এই (ফিকহী) চিন্তাধারা তাঁর [ইমাম জাফর সাদেক (আ.)] দ্বারাই বিকশিত হয়েছে। আমরা সকল মাসুম ইমাম (আ.)-কে নিয়েই গর্ব অনুভব করি এবং তাঁদের অনুসরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমরা গৌরবান্বিত এজন্যও যে, মাসুম ইমামগণ ইসলামকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে, সত্য ও ন্যায়নীতির হুকুমত প্রতিষ্ঠায় কোরআনের প্রয়োগ করতে গিয়ে এবং তাঁদের যামানার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকে এবং যুলুমবাজদের উতখাত করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন, নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন এবং পরিশেষে শাহাদাতবরণ করেছেন। আমরা এজন্য গৌরবান্বিত যে, আমরা চাই পাক কোরআন ও সুন্নাহর নীতিমালাকে কার্যে পরিণত করতে এবং এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের জাতির বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণির জনগণ এ মহান ভাগ্যনির্ধারক প্রচেষ্টায় আল্লাহর রাহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের জানমাল ও প্রিয় বস্তুসমূহ কুরবান করে দিচ্ছে।
আমাদের জন্য এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের নারীরা সকল বয়সের, খ্যাত কিংবা অখ্যাত, সবাই ইসলামের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে, ইসলামের সৌন্দর্যকে সমুন্নত রাখতে, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি- অনেক সময় অধিকতর যোগ্যতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যে সকল নারী যুদ্ধ করতে সক্ষম তারা মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছে- যা ইসলাম ও ইসলামী ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তারা সাহস ও দৃঢ়তার সাথে উপেক্ষা করেছে- কুচক্রী দুশমন ও মূর্খ সুহৃদ কর্তৃক তাদের উপর তথা ইসলামের অনুশাসন ও কোরআনের উপর আরোপিত হীনতা ও বঞ্চনাকে। সাধারণ মুসলমানদের স্বার্থহানি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার মানসে দুশমনরা মূর্খ ও ভণ্ড আলেমদের দ্বারা যে সমস্ত কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে, সেসবের শৃঙ্খলও নারীরা নির্ভয়ে ভেঙে ফেলেছেন। আর যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম তারা যুদ্ধময়দানের পশ্চাতে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে এত বেশি নিবিষ্টচিত্ত যে, তা দেখে আমাদের গোটা জাতি আজ অভিভূত এবং তাদের মহতী সেবা দেখে দুশমন ও দুশমনদের চেয়ে নিকৃষ্ট মূর্খদের অন্তর ক্রোধ ও উষ্মায় ফেটে পড়ছে।
বারবার আমাদের চোখে পড়ছে মহিয়সী নারীরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে, সেই মহাসম্মানিতা নারী হযরত যায়নব (আ.)-এর মতো যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর রাহে এবং মহা ইসলামকে বুলন্দ করার লক্ষ্যে তাদের সন্তানদের কুরবানি দিয়ে আজ তাঁরা গর্বিত এবং তাঁদের সবকিছু তাঁরা এভাবে বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত। তাঁরা জানেন যে, এর ফলে তাঁরা যা কিছু অর্জন করেছেন তা দুনিয়ার তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস তো কোন ছার, স্বয়ং বেহেস্তের অফুরন্ত নেয়ামতের চেয়েও মর্যাদাপূর্ণ। আমাদের জাতি তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ও অন্যান্য নির্যাতিত জাতি এজন্য আজ গর্বে উদ্বেলিত যে, তাদের দুশমন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন, কোরআন এবং সত্যধর্ম ইসলামের দুশমন। যারা নিষ্ঠুর-বর্বর এবং যারা নিজেদের ঘৃণ্য দুষ্কর্ম হাসিলের উদ্দেশ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তারে শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি পাশবিক আচরণ ও বিশ্বাসঘাতকতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এদের প্রধান হচ্ছে জাত সন্ত্রাসবাদী আমেরিকান সরকার, যে সারা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসের অগ্নিশিখা। তার অন্যতম দোসর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, যে নিজের শয়তানি খায়েশ পুরো করার মানসে যে কোন অপকর্ম করতে ততপর, যার হিসাব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়, বর্ণনা দিতে গেলে কণ্ঠ লজ্জায় রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের ঘৃণ্য দুরাশা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সব রকমের ইবলিসি ততপরতায়। মুসলিম জাতি এবং দুনিয়ার মযলুম জনগণ আজ এটা উপলব্ধি করে গর্বিত যে, পেশাদার বর্বর জর্দানের বাদশাহ হোসেন, মরক্কোর বাদশাহ হাসান ও মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক তাঁদের দুশমন এবং অপরাধী আমেরিকা ও ইসরাইলের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। এরা নিজেদের জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে মোটেও ইতস্তত নয় এবং আমরা আরও গৌরবান্বিত এ জন্য যে, ইরাকের বামপন্থী সাদ্দামও আমাদের দুশমন যাকে তার দোস্ত ও দুশমনরাও মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনকারী অপরাধী হিসেবেই জানে। সকলের কাছেই এটা পরিষ্কার যে, ইরাক ও পরস্য উপসাগরীয় শেখশাসিত রাষ্ট্রগুলোর জনসাধারণের বিরুদ্ধে সাদ্দামের যে বিশ্বাসঘাতকতা, তা ইরানী জাতির বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
বর্বর পরাশক্তিগুলোর দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রচারযন্ত্রগুলো যে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করেছে তাতেও আমরা এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতি গর্বিত।
এরচেয়ে সুখবর আর গৌরবের বিষয় কী হতে পারে যে, বিশ্বের নির্যাতিত ও পশ্চাদপদ বিপুল বৈভবের উপর একচ্ছত্র অধিকার, সামরিক শক্তি, বিভিন্ন পুতুল সরকারের সমর্থন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পেয়েও আমেরিকার সরকার তার সকল নির্জলা মিথ্যা দাবি নিয়ে বাহাদুর ইরানী জাতি এবং হযরত বাকিয়াতুল্লাহ (আ.) (তাঁর পবিত্র আগমনে আমাদের জীবনসমূহ কুরবান হোক) এর দেশ ইরানের মোকাবেলায় এমনভাবে পর্যুদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়েছে যে, এরপর কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে সে জ্ঞান পর্যন্ত তার (আমেরিকার) লোপ পেয়ে গেছে। অতঃপর সে যার কাছেই যায় তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। এটা সম্ভব হত না মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গায়েবি মদদ ছাড়া। যিনি জাতিসমূহকে বিশেষভাবে ইরানী জাতিকে জাগ্রত করেছেন, তাদেরকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ঘোর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের পবিত্র নূরে করেছেন আলোকিত। এহেন সন্ধিক্ষণে মযলুম মহান জাতিসমূহ এবং প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন নাস্তিক প্রাচ্য বা অত্যাচারী কাফের পাশ্চাত্যের কোন পথই অনুসরণ না করেন। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকীমে স্থির সংকল্প, দৃঢ়চিত্ত ও আনুগত্যের সাথে অবিচল থাকেন। খোদার নিয়ামতের শোকর আদায় করতে মুহূর্তের জন্য যেন উদাসীন না হন এবং পরাশক্তিগুলোর দোসরদের নাপাক হস্তসমূহকে প্রশ্রয় না দেন- তারা বিদেশি হোক বা দেশি- যারা বিদেশি দুশমনদের চেয়েও জঘন্যতম এবং এরা যেন আপনাদের নিয়তের পবিত্রতা এবং দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে কোনরকম নাড়া দিতে না পারে। আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে, আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো যতই আপনাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে ততই আপনাদের খোদায়ী শক্তি প্রস্ফুটিত হবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে (পরাশক্তিগুলো ও তাদের দোসরদেরকে) ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতেই শাস্তি বিধান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল নিয়ামতের সর্বময় কর্তা, ‘তাঁর অধিকারেই সকল কিছুর কর্তৃত্ব’ (আল-কোরআন ২৩ : ৮৮)। মুসলিম জাতিসমূহের প্রতি আমি একান্ত বিনীতভাবে আরজ করছি, পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আত্মোতসর্গের মনোভাব নিয়ে যথাযোগ্য আদবের সাথে মানবজাতির সর্বোত্তম পথনির্দেশক মাননীয় পবিত্র ইমাম (আ.) গণের অনুসরণ করতে; বিশেষ করে তাঁদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কায়দাকানুন, অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতিমালাকে মেনে চলতে এবং আহ্বান জানাই ফিকহ-ই সুন্নাতী থেকে সামান্যতমও সরে না যেতে। এই সুন্নাতী ঐতিহ্যই নববী এবং ইমামী চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ এবং জাতিসমূহের উন্নতিবিধান এবং মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। যদিও বা তা ‘প্রাথমিক অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই আওয়ালিয়াহ্) বা ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই সানাভিয়াহ্) হয় যেগুলো উভয়ই ইসলামী আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। হক ও মাযহাবের বিভ্রান্ত দুশমন শয়তানদের প্রলুব্ধকর বিষয়াদির দিকে কখনো যেন মনোযোগ না দেন। এক বিঘত পরিমাণ বিচ্যুতি ধর্মের তথা ইসলামী অধ্যাদেশ এবং ইনসাফপূর্ণ খোদায়ী হুকুমত ও আইন-কানুনের ধ্বংসসাধন করার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কখনো জুমআর নামাযের প্রতি অবহেলা করবেন না। এই নামায, নামাযের রাজনৈতিক তাতপর্য ফুটিয়ে তোলে। শুক্রবারের এই জুমআর নামায আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য তিনি মনোনীত করেছেন। ইমামগণের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠানগুলোর প্রতিও অবজ্ঞা প্রদর্শন করবেন না। বিশেষ করে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ও মযলুমদের নেতা হযরত আবি আবদিল্লাহ হুসাইন (আ.)-এর শোক অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। (মহান আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাকূল, নূরনবী এবং সকল সালেহ বান্দার পূর্ণ দরুদ ও সালাম তাঁর পবিত্র ও নির্ভীক রুহের উপর বর্ষিত হোক)।
জনগণের স্মরণ রাখা উচিত কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলি। নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের দুশমনদের উপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে তা আসলে যুগ যুগ স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসমূহের বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ। আপনাদের জানা উচিত, উমাইয়্যাদের (তাদের উপর আল্লাহ্র লা’নত) অত্যাচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দাবাদ ও অভিশাপের কথা। যদিও তারা এখন পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, তথাপি এই ফরিয়াদ ইঙ্গিত বহন করে বর্তমান দুনিয়ার যালেমদের বিরুদ্ধে মজলুম জনতার আর্তচিতকার। এ যুলুমবিধ্বংসী ফরিয়াদকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ইমামদের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে প্রতিটি যুগের যালেমদের দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও দুঃখজনক ঘটনাগুলো জোরালোভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। আর বর্তমান যুগ- যা হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও তাদের দোসরদের বিশেষ করে আল্লাহ পাকের পবিত্র হারামের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সৌদি রাজবংশের (তাদের উপর আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতা ও রাসূলগণের লা’নত বর্ষিত হোক) হাতে মুসলিম বিশ্বের নির্যাতিত হওয়ার যুগ, (এই যুগেও) জোরালোভাবে (সত্য ইমামগণের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে) আলোচনা করা, অভিশাপ ও ধিক্কার দেয়া উচিত। আমাদের সকলেরই বুঝা উচিত, যে জিনিস মুসলমানদের ঐক্য সাধন করবে তাহলো এই রাজনৈতিক অনুষ্ঠানমালা- যেগুলো মুসলমানদের বিশেষ করে বার ইমামের অনুসারী শিয়াদের জাতিসত্তাকে সংরক্ষণ করবে।
এখানে প্রত্যককে যা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি তা হলো, আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এই অসিয়ত শুধু ইরানের মহান জনগণের জন্য লিখিত নয়; বরং এটা সকল মুসলমান তথা জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবত মযলুম জনগণের জন্য এক উপদেশ হিসেবেও পরিগণিত।
মহামহিম আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের খেদমতে আমার সবিনয় নিবেদন, আমাদের এবং আমাদের জাতিকে যেন তিনি কখনও একা ছেড়ে না দেন। ইসলামের সন্তানদের এবং আমাদের প্রিয় সৈনিকদের যেন এক মুহূর্তের জন্যও স্বীয় গায়েবি মদদসমূহ থেকে বঞ্চিত না করেন।
রুহুল্লাহ্ আল-মুসাভী খোমেইনী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
বহু সহস্র অমর শহীদ, এ বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রিয় নাগরিকবৃন্দ- যাঁরা জীবন্ত শহীদ ও লক্ষ লক্ষ জনতার সীমাহীন কুরবানির বিনিময়ে অর্জিত এই মহিমাময় ইসলামী বিপ্লব, যার গুরুত্ব এত অধিক যে, এর পরিমাপ লেখনি এবং বাগ্মিতার ক্ষমতারও অতীত। যে বিপ্লব সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মুসলমান ও মুস্তাযআফের আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকবর্তিকা।
আমি রুহুল্লাহ্ মুসাভী খোমেইনী, যে নিজের অসংখ্য দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমত হতে নিরাশ নই। রহমানুর রহীম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমতের আশাকে সম্বল করে আখেরাতের পথে দুর্গম সফর শুরু করছি। ধর্মতত্ত্বের একজন নগণ্য ছাত্র হিসেবে অন্যান্য মুমিন ভাইয়ের মত এই ইসলামী বিপ্লব, এর ফলাফলের স্থায়িত্ব এবং অনাগত উত্তরোত্তর ফলোদয়ের প্রতি আশা রেখে আমি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রিয় প্রজন্মের প্রতি অসিয়ত হিসেবে ইত্যবসরে পুনরাবৃত্তি হলেও কিছু বিষয় সম্পর্কে বলার ইচ্ছে পোষণ করছি। এজন্য পরম প্রভু দয়ালু আল্লাহ্ তাআলার কাছে আমার মিনতি, যেন তিনি আমাকে এই কাজে পূর্ণাঙ্গ আন্তরিক হওয়ার তওফিক দান করেন।
১. আমরা জানি, ইরানের বুক থেকে বিশ্বগ্রাসী আর স্বৈরাচারীদের প্রভাবকে খতম করে আল্লাহ তাআলার গায়েবি মদদের মাধ্যমে এই মহা ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান শতাব্দীর প্রাক্কালে ইসলাম ও আলেমসমাজের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক প্রচারণা চলছে, যখন বিভিন্ন জনসভা আর প্রচারমাধ্যমগুলোয় জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বাকপটু আর প্রচারকরা অসংখ্য বিভেদমূলক টিট্কারি প্রচারে ততপর, যখন চারদিকে অশ্লীল কবিতা ও সরস রচনার ঢেউ, অসংখ্য এবং বিচিত্র প্রকারের গণিকালয়, জুয়ার আড্ডা, শুঁড়িখানা, অবৈধ ক্লাব ও মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি- এ সবগুলোই দেশের যুবসমাজ- (যারা) আমাদের দেশের প্রিয় ভবিষ্যত, অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি (তাদেরকে) দুর্নীতি, ধ্বংস, শাহ ও শাহের অসভ্য পিতার বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপের অনুকূলে ঠেলে দিচ্ছিল; যখন শক্তিধর বিদেশি দূতাবাসসমূহের পক্ষ থেকে আয়োজিত সভা-মজলিসগুলো জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল, যখন সর্বাধিক জঘন্য অবস্থায় নিপতিত সকল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে-যেগুলোর উপর দেশের ভাগ্য নির্ভরশীল-পাশ্চাত্যঘেঁষা বা প্রাচ্যঘেঁষা সম্পূর্ণরূপে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতি, এমনকি জাতীয়তাবাদের নামে সঠিক জাতীয়তাবাদবিরোধী শিক্ষক ও অধ্যাপকরা শয়তানি চর্চায় রত ছিল আর যে সমস্ত নিষ্ঠাবান ও দরদি শিক্ষক-অধ্যাপক ইসলামের ন্যায় ও সত্য প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন তাঁদেরকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আবদ্ধ করে রেখেছিল, ফলে সংখ্যাল্পতার দরুন এই সৎলোকগুলোর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সে সময় যখন দেশের আলেমসমাজকে শাহের স্বৈরাচারী সরকার কোন জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে দিত না এবং জোরপূর্বক তাদের অনেকের মতাদর্শকে বিকৃত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে ৩৬ মিলিয়ন ইরানী জনতার পক্ষে একই স্লোগান এবং পতাকাতলে সমবেত হয়ে, একই লক্ষ্যের ভিত্তিতে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে, চোখধাঁধাঁনো এবং মোজেযাপূর্ণ কুরবানির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত এবং বিদেশি শক্তিগুলোকে বিতাড়িত করে দেশের ভাগ্যকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়া কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। সন্দেহ নেই যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং এর সূচনা, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অন্যান্য বিপ্লব থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র। নিঃসন্দেহে এই দেশে এই বিপ্লব মহান আল্লাহ্ তাআলার এক ঐশী উপঢৌকন ও গায়েবি হাদিয়া যা এই লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত জাতিকে তিনি দান করেছেন।
২. ইসলাম এবং ইসলামী সরকার হলো খোদায়ী সত্তার প্রকাশ। এদের বাস্তব রূপায়ন তোমাদের সন্তানদের জন্য এই জগতের সমৃদ্ধি ও পরজগতের নাজাতের একমাত্র সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। ইসলাম অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং দুর্নীতিসমূহের মূলোতপাটনে সক্ষম। এটা মানবতার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক। এটা নাস্তিক মতাদর্শসমূহের বিপরীত এমন এক মতাদর্শ যার রয়েছে পথনির্দেশিকাসমূহ, যেগুলোর সাহায্যে ব্যক্তিজীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়সমূহসহ সঠিক ব্যাপার তথা জনগণের সামাজিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, জাগতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু সমাধান দেয় এবং পরিচালিত করে। যত সামান্যই হোক না কেন সকল খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিয়েই এই ইসলামী নির্দেশনাগুলো মানুষের শিক্ষা, সামাজিক, বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক প্রগতির আলোকে সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান উপহার দেয়।
মহান আল্লাহ্র ফজলে জাতির দৃঢ়চিত্ত ও নিষ্ঠাবান জনতার সম্মিলিত শক্তির সাহয্যে এখন ‘জমহুরিয়ে ইসলামী’ (ইসলামী প্রজাতন্ত্র) কায়েম হয়েছে। এর একমাত্র লক্ষ্য হলো ইসলাম ও ইসলামের আহকামসমূহের উন্নয়ন। যতটা সম্ভব ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খাতিরে ইসলাম এবং এর অনুশাসনমালার শ্রেষ্ঠত্বের কথা মনে করে ইরানী জনগণের অবশ্যই কর্তব্য ইসলামী ব্যবস্থার সকল দিকের পরিপূর্ণতা বিধানের পর এর হেফাজতের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো। কারণ, ইসলামের হেফাজত অন্য সকল ফরজের চেয়ে অগ্রগণ্য।
হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে খাতামুন নাবিয়্যীন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এই ইসলামের হেফাজতের জন্যই কোন বাধাবিপত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অবিচল নিষ্ঠা ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের জান কুরবান করেছিলেন, আর কোন বাধাবিপত্তিই তাঁদেরকে এই সুমহান ফারিযা (ফরয কাজ) থেকে পিছু হটাতে পারেনি এবং তাদের এই সংগ্রামের দায়িত্ব পরবর্তীকালে নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তাঁদের সুযোগ্য সাহাবা ও অনুসারীবৃন্দ এবং পবিত্র ইমাম (আ.) গণ যাঁরা এর হেফাজত ও উন্নয়নের জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি নিজেদের রক্ত দান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
আজ ইরানে সরকারিভাবে ঘোষিত এই খোদায়ী পবিত্র আমানত- যার বিচ্ছুরণে অতি স্বল্প সময়ে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সেই ‘ইসলামী রাষ্ট্রের’ যথাসাধ্য নিরাপত্তা বিধান করা দুনিয়ার সকল মুসলিম, বিশেষ করে ইরানী জাতির একান্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য (ফরয)। আরো কর্তব্য এমন সব দরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে প্রজাতন্ত্রের সাফল্যের পথে যাবতীয় বাধাবিপত্তি পরিষ্কার হয়ে এর স্থায়িত্ব বিধান সুসম্পন্ন হয়। এর ফলে আশা করা যায় যে, এর নূরানি আলোকে হয়তো সকল মুসলিম দেশ আলোকিত হবে; সরকার এবং জনতার মাঝে এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি সম্পর্কে সমঝোতার সৃষ্টি হবে এবং যা দুনিয়ার নির্যাতিত ও অবহেলিত (মুস্তাযআফিন) জনগোষ্ঠীর উপর থেকে বিশ্বগ্রাসী পরাশক্তিগুলো ও ইতিহাসের দুষ্কৃতকারীদের ঘৃণ্য প্রভাবের শৃঙ্খল চিরতরে ছিন্ন করতে সাহায্য করবে।
আমি যে এখন জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছি, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমার ইতিকর্তব্য স্মরণ করে এই মর্মে কিছু মৌলিক বিষয় যা এই পবিত্র বেহেশতি হাদিয়ার প্রতিরক্ষা এবং স্থায়িত্বে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হবে। আর এমন কিছু বাধাবিপত্তি ও অসুবিধার উল্লেখ করব যা এই স্বর্গীয় উপহারের প্রতি হুমকিস্বরূপ। সকলের সাফল্য ও সমৃদ্ধি হোক এটাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমার একান্ত মোনাজাত।
ক. তর্কাতীতভাবে এটা সত্য যে, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের টিকে থাকার রহস্য আর এর বিজয়ের রহস্য একই। আর ইরানী জাতি ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের রহস্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকেবহাল। ভবিষ্যত প্রজন্মের বংশধরেরা তাদের ইতিহাস গ্রন্থসমূহে পড়বে যে, এই মহান বিপ্লবের দু’টি প্রধান অংশের একটি ছিল ঐশী চেতনা ও ইসলামী হুকুমাতের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং অপরটি ছিল এই একই চেতনা ও উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত মতাদর্শগত ঐক্যের ভিত্তিতে সারা দেশের জনগণের সংহতি।
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল প্রজন্মের বংশধরদের প্রতি আমার অসিয়ত, যদি আপনারা আল্লাহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান, যদি আপনাদের দেশ থেকে দেশি ও বিদেশি শোষক ও উপনিবেশবাদীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিলোপ সাধন স্বচক্ষে অবলোকন করতে চান তাহলে এই খোদায়ী চেতনাকে কোনক্রমেই হাতছাড়া হতে দিবেন না- যার উপর পাক কোরআনে আল্লাহ্ তাআলা সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এই খোদায়ী চেতনা- যা ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও স্থায়িত্বেরই রহস্য আর লক্ষ্য বিস্মৃতি, বিভেদ-বিসংবাদ হলো এই চেতনার ঠিক পরিপন্থী; এটা অযথাই নয় যে, আমাদের দুশমন এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের মুখপাত্র সুনিপুণ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোটি কোটি ডলার অপচয় করে সাধ্যমত চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভেদমূলক মিথ্যাগুজব, আর বানোয়াট প্রচারণা। ঠিক একইভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানবিরোধীদের এতদঅঞ্চলে অনবরত সফর কোন উদ্দেশ্যবিহীন ঘটনা নয়। দুর্ভাগ্যবশত এদের মঝে কিছু মুসলিম দেশের হর্তাকর্তাদেরকেও দেখতে পাওয়া যায়, যারা শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চিন্তাতেই মশগুল এবং অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। আরও কিছু ভণ্ড আলেমও এদের সাথে যোগ দিয়েছে। এই বিভেদকারী ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণাকে নির্মূল করার চিন্তাই আজ এবং আগামীকালের ইরানী জাতি এবং বিশ্বমুসলিমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। মুসলমানদের বিশেষভাবে বর্তমানকালের ইরানীদের প্রতি আমার পরামর্শ তারা যেন এই সকল বৈরী প্রচারণামূলক ষড়যন্ত্রসমূহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আর যে কোন উপায়ে যেন তাদের নিজেদের ঐক্য ও অবস্থান সুদৃঢ় থেকে সুদৃঢ়তর করে এবং ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের দুশমন কাফের ও মুনাফেক বকধার্মিকদের দলকে যেন নিদারুন হতাশায় নিমজ্জিত রাখে।
খ. বর্তমান শতাব্দীতে, বিশেষ করে গত কয়েক দশকে, বিশষভাবে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে যে উল্লেখযোগ্য ষড়যন্ত্রগুলো প্রকাশ্যভাবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে তাদের অন্যতম হলো বিশ্বব্যাপী তাদের সুদূরপ্রসারী প্রচারণার মাধ্যমে জাতিসমূহেকে আতঙ্কিত করে তোলা। বিশেষ করে আত্মোতসর্গী ইরানী জনগণের ইসলামের প্রতি আস্থাকে দুর্বল করে দেয়া। কোন কোন সময় ওরা সরাসরি একেবারে নগ্নভাবে ঘৃণ্য ততপরতায় লিপ্ত হয়। যুক্তি দেখায় যে, চৌদ্দশ’ বছরের পুরোনো ইসলামী অনুশাসনগুলো বর্তমান শতাব্দীর দেশগুলোর প্রশাসন পরিচালনায় অপারগ। কেননা, ইসলাম আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি উদ্ভাবন ও প্রগতিবিরোধী পশ্চাদপদ ধর্ম। তাছাড়া বর্তমান যুগের দেশগুলো দুনিয়ার আধুনিক সভ্যতা এবং আত্মপ্রকাশকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। আর একই রকম মূর্খতাপূর্ণ এবং অনেক সময় অসৎ ও বিদ্বেষপূর্ণ শয়তানি প্রচারণাকে অত্যন্ত চমতকারভাবে ইসলামী কথাবার্তার মোড়কে সাজিয়ে ইসলামপন্থী প্রচারণারূপে উপস্থাপন করে এরূপ ধারণাকে সমর্থনের ছুতা তোলা হয় যে, ইসলাম এবং অন্যান্য ঐশী ধর্ম আসলে আধ্যাত্মিক ব্যাপার সম্পর্কিত, মানবজাতির নৈতিক পরিশুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত- (এগুলো) পার্থিব কোন কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং দুনিয়াকে ত্যাগ করতে আহ্বান জানায়। এসব ধর্ম মানুষকে বস্তুজগতের বন্ধন থেকে সরিয়ে ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-আযকার ও দোয়া-প্রার্থনা প্রভৃতির দিকে নিমগ্ন রাখে, যার ফলে (ওদের যু্ক্তিতে) বস্তুজগতের বিষয়াবলি থেকে দূরে সরিয়ে মানুষকে খোদার নৈকট্যে নিয়ে যায়। তাই পার্থিব সরকারের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যসমূহের পরিপন্থী এবং এই কর্মকাণ্ডগুলো কেবল দুনিয়াবি ব্যাপার এবং নবী-রাসূলদের শিক্ষার বিপরীত এবং এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ কতিপয় মুসলিম মৌলভী-মাওলানার দল এই মারাত্মক ধারণায় প্রভাবিত এবং তাদের মনে এ সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, রাজনীতি এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে নাক গলানো অমার্জনীয় অপরাধ এবং ফাসেকি কাজ। এটাই ইসলামের উপর আপতিত এক মহাদুর্যোগ।
প্রথম ধরনের মতামতের প্রবক্তারা হয় সরকার, আইন ও রাজনীতি সম্পর্কে একবারেই অজ্ঞ নতুবা নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এরূপ ভান করে থাকে। কারণ, সততা, সাম্য ও নায়বিচারের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন, স্বৈরাচারী শাসন ও শাসকের বিরোধিতা করা, ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি, পতিতাবৃত্তি প্রভৃতিকে বাধা দান করা এবং একই সাথে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য উপনিবেশবাদ, শোষণ, বাঞ্চনা, দাসত্ব ও গোলামিকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ন্যায়বিচার ও যুক্তির ভিত্তিতে নাগরিক স্বাধীনতার সমর্থন দান করা, ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শারীরিক শাস্তির বিধান প্রচলন করা ও সমাজের দুর্নীতি ও অবনতি দমন করা এবং একইভাবে যুক্তি, ন্যায়বিচার, সাম্য ও অন্য গুণাবলির ভিত্তিতে রাজনীতি ও সমাজের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা প্রভৃতি কালের প্রবাহে এবং মানুষের সামাজিক জীবনের জন্য কোন প্রাচীনপন্থী সেকেলে বিষয় নয়। এদের দাবির অর্থ কেবল এই ধারণায় পর্যবসিত যে, বর্তমান শতাব্দীতে সাধারণ জ্ঞানের নিয়মসমূহ গণিতের নিয়মসমূহের মতোই নতুন নিয়মনীতি দ্বারা সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। তাহলে ধরে নিতে হবে, যদিও মানবজাতির সৃষ্টির শুরু থেকেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাআলার আদেশ রয়েছে যে, সামাজিক সাম্য চালু করতে হবে, স্বৈরাচার, লুটতরাজ ও নরহত্যা বন্ধ করতে হবে তথাপি বর্তমান এই আণবিক যুগে (বিরুদ্ধবাদীদের মতে) ওইসব খোদায়ী আইন সেকেলে এবং অচল।
নির্জলা মিথ্যা একটা দাবি যে, ইসলাম নব নব কারিগরি উদ্ভাবনের বিরোধী। এরূপ একটি সুপরিকল্পিত ধারণা ছিল ক্ষমতাচ্যুত মুহাম্মাদ রেযা শাহ পাহলভীর যে, ইসলামী বিপ্লবের সমর্থক ও আলেম সম্প্রদায় আধুনিক যুগেও চতুস্পদ জন্তুতে করে সফরের ওকালতি করে। এটা একটা নেহায়েতই আহাম্মকি অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, তারা যদি সভ্যতার নিদর্শন ও নতুন কিছুর উদ্ভাবনকে এবং মানুষ ও তার সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম কোন আবিষ্কার, নতুন দ্রব্যসামগ্রী ও উন্নতমানের প্রকৌশলীকেই বুঝায়, তাহলে তাদের এই ধারণাকে কখনো ইসলাম বা অন্য কোন তাওহীদী ধর্ম বিরোধিতা করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। উপরন্তু ইসলাম এবং পাক কিতাব কোরআনুল হাকিম বিজ্ঞানশিক্ষা এবং প্রকৌশল শিল্পের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু যদি ‘সভ্যতা এবং আধুনিকতা’কে কিছু পেশাদার বুদ্ধিজীবীর ধারণামতে ব্যাখ্যা করা হয যেসব বুদ্ধিজীবী সভ্যতা এবং আধুনিকতা বলতে বদমায়েশি এবং সমকামিতাসহ সকল প্রকার ধর্মনিষিদ্ধ দুষ্কর্ম সক্রিয়ভাবে পালন করাকে ‘স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করে তাহলে আমি শুধু এর জবাবে এটাই বলতে চাই যে, সকল ঐশী ধর্ম, বিবেকবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ নির্বিবাদে এই কুধারণার বিরোধী। যতই অপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যঘেষাঁ লোকেরা তদীয় প্রভুদের অন্ধ অনুকরণে এর প্রচার ও প্রসারে ততপর হোক না কেন।
ইসলামবিরোধী দ্বিতীয় শ্রেণি- যারা রাজনীতি ও সরকার থেকে ইসলামকে আলাদা করে রাখতে চায় এবং যাদের ভূমিকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই অজ্ঞদের আবশ্যিকভাবে বলা উচিত যে, পাক কোরআন ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাহয় অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কীয় অনুশাসনমালা এতই বেশি রয়েছে যে, অন্য কোন বিষয়ে ততটা নেই। এমনকি বাহ্যত ইসলামের যেসব ইবাদতের বিধিমালা রয়েছে তার অনেকগুলোই রাজনৈতিক ইবাদত সংক্রান্ত বিধিমালা। যার অবহেলার কারণে বর্তমান মুসলিম দুনিয়ার এই দুর্দশা।
ইসলামের মহান নবী (সা.) পৃথিবীর অন্য সরকারগুলোর মতোই একটা সরকার গঠন করেছিলেন, কিন্তু তফাতটা ছিল এই যে, নবী করিম (সা.)-এর সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রসার ঘটানো। ঠিক তদ্রূপ প্রাথমিক মুসলিম খলিফাদেরও ছিল ব্যাপকভিত্তিক সরকার এবং তেমনি ছিল হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সরকার। যা ছিল সঠিক নবুওয়াতী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, অধিকতর ব্যাপক, বিস্তৃত এবং যে সরকার ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন ও আদর্শ। এর পরবর্তীকালীন সরকারগুলো ইসলামের নামেই স্থাপিত হয়োছল। এমনকি বর্তমানেও বিভিন্ন ধরনের বহু সরকার ইসলাম এবং নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে থাকে।
আমার এ অসিয়তনামায় এ প্রসঙ্গে শুধু আভাস দিয়ে গেলাম, তবে আশা করি লেখক, সমাজতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকগণ মুসলিম জাতির মোহমুক্তি ঘটাবেন। যেন ওরা বুঝতে পারে যে, নবী (সা.) শুধু আধ্যাত্মিকতা নিয়েই বিভোর ছিলেন না, বরং এসব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নবী এবং তাঁর অনুসারীরাও অশংগ্রহণ করতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করতেন না এবং ঠিক একই কারণে এই সব কর্মকাণ্ডে আমাদেরও নির্দ্বিধায় জড়িয়ে পড়া উচিত। কেননা, এতদিন এসব থেকে দূরে থেকে আমরা ভুল করেছি এবং এই দুঃখজনক ভুলের কারণে মুসলিম দেশগুলো ধ্বংসের দিকে ঢলে পড়ে এবং রক্তপিপাসু উপনিবেশবাদীদের জন্য দরজা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে, হতাশাব্যঞ্জক একটা ব্যাপার হলো স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক ইবলীসী সরকারগুলোর অস্তিত্ব। যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য আর যারা পার্থিব দুষ্কৃতি সম্পাদনে ততপর- যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সম্পদ কুক্ষিগত করা, ক্ষমতা হস্তগত করা এবং দুনিয়াতে খোদাবিমুখ রাখার মতো মারাত্মক অপরাধ করা। যেসবের ফলশ্রুতিতে মানুষ প্রকৃত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ খোদাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়ায়- এটাকে ইসলাম নিষেধ করেছে। নির্যাতিত এবং অহেলিত জনগণের স্বার্থে স্বৈরাচার ও অত্যাচার দমনের নিমিত্তে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের শাসন কায়েমের জন্য সরকার গঠন এক মহান দায়িত্ব। যে রকম একটা দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন নবী সোলায়মান ইবনে দাউদ (আ.) এবং ইসলামের মহান নবী (সা.) এবং তাঁর মহান অসিয়তপ্রাপ্ত ইমামগণ। এ ধরনের সরকারসংশ্লিষ্ট সুষ্ঠু রাজনীতি অন্যন্ত জরুরি বিষয়।
সদাজাগ্রত এবং সতর্ক ইরানী জনগণের প্রতি অনুরোধ, ইসলামী জোশে বলীয়ান হয়ে তাঁরা যেন এই ধরনের ঘৃণ্য ততপরতাকে নস্যাত করে দেন এবং আমি আরো অনুরোধ জানাই নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও বক্তাদের, তাঁরা যেন আমাদের কালের ষড়যন্ত্রকারী বিশ্ব শয়তানদের বিনাশ সাধনে জাতির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
গ. একই শ্রেণির আর একটা ষড়যন্ত্র সম্ভবত অন্য সবগুলোর চেয়ে অধিক বিদ্বেষপ্রসূত, তা হলো গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে বৈরী প্রচারণা। এই ধরনের ছড়ানো গুজব নিয়মিত আমাদের দেশের বাতাসকে দূষিত করে তোলে। এর ফলে এই ধরনের কটাক্ষের জন্ম হয় যে, পূর্বসূরির মতোই বর্তমানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র জনগণের জন্য কিছুই করেনি। হতভাগা জনগণ উতসাহ ও উদ্যম সহকারে আত্মোতসর্গী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল নিজেদেরকে স্বৈরাচারী শাসন ও যালিমদের হাত থেকে বাঁচাতে, কিন্তু বিজয়লাভ করেও তারা দেখলো এক মারাত্মক প্রশাসনের নিগড়ে তারা বন্দি, উদ্ধত ধনীরা আরও উদ্ধত হয়ে উঠেছে, নির্যাতিত জনগণ আরো বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, জেলখানাগুলো যুবা-বয়সী জনসাধারণে ভরে উঠেছে- যে যুবাশ্রেণি দেশের ভবিষ্যতের আশা-ভরসা। নির্যাতনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগের চেয়ে অধিকতর পাশবিক রূপে সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিদিন ইসলামের নামে অনেক মানুষ বলি হচ্ছে। এই প্রশাসন ‘ইসলামী’ নাম ধারণ না করলে সুবুদ্ধিরই পরিচয় দিতো। এখনকার সময় রেযা খান, এমনকি তার ছেলের আমলের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। লোকজন এখন নিদারুণ যন্ত্রণা, কঠোরতা ও জীবনযাপনের উচ্চমূল্যের অথৈ পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাষ্ট্রের কর্ণধার ব্যক্তিরা এ সরকারকে এক কম্যুনিস্ট সরকারে পরিণত করছে। জনগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা হরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের নাগরিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো হরেক রকমের গুজব, যা শয়তানদের উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে চারদিকে। একটা ষড়যন্ত্রকে খাড়া করতে এগুলো যে কার্যকরী হাতিয়ার স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয়। প্রত্যেকটা গুজবই আর একটা গুজব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে শহরের অলিগলিতে সকলের মুখে মুখে কয়েকদিন ধরে প্রচার করা হয়। সাধারণত এসব ছড়ানোর প্লাটফরমগুলো হলো আমাদের ট্যাক্সি, বাস এবং ছোটখাট লোক সমাগমের যে কোন জায়গা এবং একবার যদি কোন গুজব পুরোনো হয়ে যায়, সাথে সাথে অন্য আর একটা নতুন গুজব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটা দঃখজনক ব্যাপার যে, আমাদের কতিপয় আলেম যারা শয়তানি ফিকির সম্পর্কে একেবারে আনকোরা, সহজেই গুজব প্রচারকারীদের ফাঁদে পড়েন এবং নিজেরা দুই একজন ষড়যন্ত্রকারীর সংস্পর্শে এসেই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাঁরা যেটাই গুজব আকারে শুনেছেন সেটাই সত্য। এর একমাত্র কারণ হলো এসব আলেম চলতি দুনিয়ার ঘটনাবলি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন, দুনিয়ার বিপ্লবগুলোর কোন খবরই তাঁরা রাখেন না। বিপ্লবগুলোর পরবর্তী ঘটনাক্রমের অপরিহার্য কঠিন মুছিবত সম্পর্কেও তেমন জ্ঞান রাখেন না। ইসলামের খাতিরেই যেসব (সামাজিক) পরিবর্তন হচ্ছে সে সম্পর্কেও তাঁদের সঠিক ধারণা নেই। তাঁরা এসব গুজব অন্ধভাবে শোনেন এবং এভাবে তাঁরা ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক একই ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক ধারণার শ্রীবৃদ্ধি করেন।
তোমাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, ইসলামী সরকারের দোষ খুঁজতে চেষ্টা করো না, একে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করো না, কিংবা এই ইসলামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাঁড়ামোপূর্ণ অবমাননা করো না; তার পূর্বে চলতি দুনিয়ার পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমাদের সম্যক অধ্যয়ন করা উচিত। ইরানী বিপ্লবের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য বিপ্লবের তুলনা করে ওসব বিপ্লবের সময় এবং বিপ্লবের পরে দেশ ও জাতির অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তাও জানা উচিত। আরো জানা উচিত ইরানী জাতির সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য রেযা খান এবং তার চেয়েও বদ্ মুহাম্মাদ রেযার (রেযা খানের পুত্র) লুট-পাটের শাসনামলে ইরানে কী ধরনের মুছিবত চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল আর সেই বদশাসনের জের এই সরকারের উপর বর্তেছে। বিপ্লবপূর্ব সময়ে বিদেশি শক্তিগুলোর উপর ধ্বংসাত্মক নির্ভরতা সে সময়ের সরকারের মন্ত্রণালয় ও অফিস আদালতগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরো জানা উচিত বিপ্লবপূর্বে এই জাতির অর্থনীতি এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থা কী রকম ছিল। ফূর্তি ও মজা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির আড্ডাখানা নির্মাণ করে এবং নেশাকারক অলস সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়ে কিভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে বিষিয়ে তুলেছিল! বিপ্লবপূর্ব আমলে শিক্ষার মান এবং স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাই বা কেমন ছিল! আরো স্মরণ করা উচিত চলচ্চিত্রগুলোর অবস্থার কথা! যুবসমাজ, নারীসমাজ ও আলেমসমাজের অবস্থার কথা! আত্মবিশ্বাসী মুক্তিকামী জনতার এবং শাহ আমলের মযলুম অথচ পবিত্র সেই নারীদের অবস্থা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তাগুতী আমলে মসজিদগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। তাদের ব্যাপারগুলো, যাদের ইসলামী বিপ্লবের পর ফাঁসি দেয়া হয়েছে কিংবা যারা দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে গেছে, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আরো দেখতে হবে গণকর্মচারীরা কী করেছে! বড় বড় ধনী ও জমিদার শ্রেণির সম্পদের হিসাব নিতে হবে এবং মজুতদার ও মুনাফাখোরদের অবস্থা জানতে হবে। জানতে হবে বিপ্লবপরবর্তী আদালত ও বিপ্লবী ট্রাইবুনালসমূহ এবং বিপ্লবপূর্বের বিচার ব্যবস্থার তুলনামূলক অবস্থা। এই তুলনামূলক বিচারের মাধ্যমে দেখতে হবে মজলিস-ই শুরা-ই ইসলামী প্রতিনিধিবৃন্দের মর্যাদা এবং মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য গভর্নর ও বিপ্লবোত্তর কর্মচারীর মর্যাদা তাঁদের পূর্ববর্তীদের তুলনায় কেমন ছিল! অনুসন্ধান করে দেখতে হবে বর্তমান সরকারের ততপরতা এবং বঞ্চিত গ্রামগুলোর পুনর্গঠন জিহাদ-এর কার্যক্রম, যেসব গ্রামে আগে, এমনকি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, মৌলিক চিকিতসা সুবিধারও কোন বন্দোবস্ত ছিল না। পূর্বের অবস্থার সাথে এগুলোর তুলনা করে দেখা উচিত। চাপিয়ে দেয়া এতবড় যুদ্ধের বোঝা মাথায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ যুদ্ধবন্দি শরণার্থী এবং অসহায় যুদ্ধাহত জনগণ ও তাদের শহীদ পরিবার এবং আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারে জর্জরিত ইরান কিভাবে এই উন্নয়ন ততপরতায় লিপ্ত! চিন্তা করে দেখা উচিত অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা ইরানের বিরুদ্ধে কত রকম ষড়যন্ত্র পাকিয়ে চলছে! ইসলামী বিপ্লব পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়ার পর থেকে ইসলামী বিপ্লবের নাদান বন্ধুগণ কর্তৃক যেসব বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে (ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে) তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, আর সে সময় পর্যাপ্ত মোবাল্লেগ ও ইসলামী বিচারকের অভাব ছিল । আমি আপনাদের অনুরোধ জানাই এই অসহায় ইসলামের প্রতি রহম করতে, যে ইসলাম শত শত বছরের শক্তি মদমত্ত স্বৈরশাসনের দাপটে জর্জরিত এবং জনসাধারণের অজ্ঞতার ফলশ্রুতি হিসেবে তা এখন কম্পিতপদ শিশুর মতো দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে শুধু। আপনারা, সমালোচকগণ, একটু চিন্তা করে দেখুন যে, এই বিপ্লবকে ধ্বংস করার পরিবর্তে এর সংশোধন ও সাহায্যে এগিয়ে আসা কি উত্তম হবে না? যালেম, মুনাফেক, বেইনসাফী, খোদাবিমুখ মজুতদার ও পুঁজিপতিদের বদলে মযলুম ও বঞ্চিত জনতার সমর্থন করুন।
বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী ও ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের প্রতি আপনাদের পরোক্ষ সমর্থনের পরিবর্তে এদের হাতে শাহাদাতপ্রাপ্ত মযলুম নিষ্ঠাবান ইসলামের খাদেম আলেমগণের প্রতি একটু নজর দিন।
আমি পূর্বে কখনো বলি নি কিংবা কখনো এমন কোন দাবি উত্থাপন করছি না যে, আমাদের প্রজাতন্ত্রে মহান ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিংবা এ-ও বলছি না যে, অজ্ঞতাবশতই হোক, ব্যক্তিগত ঘৃণাবশত হোক, কিংবা আত্মশৃঙ্খলার অভাবের কারণেই হোক, ইসলামী বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করেনি। তবে আমি বলতে চাই, এই সরকারের মতো বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ এই দেশকে ইসলামীকরণের কাজে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ-কোটি জনতার এই জাতিও এই সরকারকে সমর্থন করে। যদি সংখ্যালঘিষ্ঠ মুষ্টিমেয় এই সমালোচক ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী দল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বিপ্লবের এই লক্ষসমূহ আরো সহজ ও দ্রুতগতিতে অর্জিত হবে। এবং আল্লাহ না করুন যদি এই সমালোচক ও বিপথগামীদের বোধোদয় না হয় তাহলে কখনো জনগণের প্রবল প্রমত্ততার মুখে তারা টিকে থাকতে পারবে না।
যেহেতু এই সচেতন বিশাল জনগণ প্রকৃত পরিস্থিতি ওয়াকেবহাল এবং তারা ময়দানে সদা উপস্থিত তাই আল্লাহপাকের অপার ইচ্ছায় বিপ্লবের মানবতাবাদী ও ইসলামী দিকগুলো অচিরেই বাস্তব রূপ লাভ করবে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে আমি দাবি করছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যামানার হিজাজের জনগণের চেয়ে এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর যামানার কুফা ও ইরাকের জনগণের চেয়ে আজকের ইরানী জাতি এবং ইরানের লক্ষ-কোটি জনগণ অধিকতর উত্তম।
আমাদের নবী (সা.)-এর যামানায় হিজাজের জনগণ জিহাদে যাবার জন্য নবী (সা.)-এর আদেশ লঙ্ঘন করত এবং এ জন্য বিভিন্ন প্রকার ওজর আপত্তি উত্থাপন করে এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের মুখ ফিরিয়ে রাখত। তাদের ওই ধরনের মুনাফেকী আচরণের জন্য স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআন পাকের সূরা তাওবায় বিভিন্ন আয়াতে তাদেরকে তিরষ্কার করেছেন এবং তাদেরকে চরম শাস্তিদানের কথাও ঘোষণা করেছেন। এই মুনাফেকরা নবী করিম (সা.)-এর প্রতি এত বেশি মিথ্যা অপবাদ উত্থাপন করেছিল যে, বর্ণনানুসারে নবীজী বিরক্ত হয়ে নিজে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে বদদোয়া দিয়েছিলেন। অপরদিকে ইরাক ও কুফার জনগণও আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে অসদাচরণ করেছে। যথাসম্ভব তারা তাঁকে অপদস্থ ও অমান্য করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁর যামানার এই ঘটনা, মুনাফেকদের সম্পর্কে পবিত্র ইমামের অভিযোগসমূহ ধর্মীয় এবং ইতিহাসের কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঠিক তেমনি ইরাক ও কুফার এই মুসলমানদের আমলেই সর্বকালের বৃহত্তম অবিচার সংঘটিত হয়েছিল সাইয়্যেদুশ শুহাদা-শহীদকুল শিরোমণি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উপর । এমনকি এই কুফার যারা তলোয়ার হাতে সরাসরি ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়নি তারা হয় এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো যুদ্ধক্ষেত্রের পিছনে থেকে কী ঘটে তা দেখার জন্য দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে আমরা আজ দেখতে পাই, গোটা ইরানী জাতি তথা জাতির সশস্ত্র বাহিনী, সেপাহ্ (ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী IRGC), বাসিজ (গণবাহিনী), বিভিন্ন উপজাতীয় বাহিনী এবং অন্যান্য সকল স্বেচ্ছাসেবী দল জেহাদের ময়দানে নিজেদের জান কুরবান করতেও পিছপা হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও সমান আত্মত্যাগী মনোভাব নিয়ে অপরিসীম উদ্যম সহকারে ইসলামী হুকুমতের খেদমতে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশব্যাপী আমাদের সম্মানিত জনগণ জাতীয় প্রচেষ্টার প্রতি কীরকম প্রশংসনীয় সহযোগিতা করেছেন! আমরা আরো দেখতে পাই, শহীদ পরিবার এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ যাঁরা যুদ্ধে নিজেদের আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন এবং আহত যোদ্ধদের আত্মীয়স্বজনরা ঈমানী তেজ ও আত্মবিশ্বাস সহকারে আমাদের শুধু কথা ও কাজের মাধ্যমে উৎসাহই যোগাচ্ছেন। এগুলোর সবটাই তাঁদের মহান প্রভু, ইসলাম ও অমর জীবনের প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার প্রমাণ। যদিও বাস্তবতা এই যে, তাঁরা নবী করিম (সা.)-এর যামানার লোকও নন আবার নিষ্পাপ ইমামদের (আ.) যামানার বাসিন্দাও নন। এভাবে তাঁরা গায়েবি খোদার উপর ঈমানের বলে বলিয়ান- যা কোন ক্ষেত্রে বিজয় লাভের মূল রহস্য। এই ধরনের সন্তানদের লালন করে ইসলাম গৌরবান্বিত এবং এই যুগে বাস করা, বিশেষ করে এই ধরনের জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য সত্যিকার অর্থে আমরা সবাই গর্বিত।
আজকের এই মুহূর্তে আমার অসিয়ত কিছু ব্যক্তির প্রতি যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ইসলামী বিপ্লবের বিরোধিতা করে এবং ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকল যুবাশ্রেণির প্রতি- যারা মুনাফেকদের দ্বারা বিভ্রান্ত এবং সুযোগসন্ধানী কতিপয় পথভ্রষ্টের প্রতি যারা অপরের স্বার্থহানি করে নিজেরা লাভবান হতে চায়। সকলের প্রতি আমার আহ্বান তারা যেন নিরপেক্ষ ও মুক্ত মন নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বিচার করে দেখে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য দুশমনদের অপপ্রচারসমূহকেও পরীক্ষা করে দেখে। এসব দুশমন মযলুম জনগণের প্রতি কিরূপ আচরণ করে এবং বিদেশি সরকারগুলো এবং কিছু কুচক্রী দলের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে সরলমনা দেশবাসীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের মতলব হাসিল করে এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনমত নিজেদের ভোল পাল্টায়! যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিলোপ কামনা করে, আমি চাই তারা অনুসন্ধান করে দেখুক মুনাফেক ও পথভ্রষ্টদের হাতে মৃত্যুবরণ করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের চরিত্র কেমন ছিল এবং তাঁদের দুশমনদের মোকাবেলায় তাঁদের পুনর্মূল্যায়ন করুক। ঐসব শহীদের রেকর্ডকৃত টেপসমূহ রয়েছে এবং আপনারাও হয়তো ইসলামী শাসনবিরোধীদের টেপরেকর্ড করেছেন। এবার শুধু খুঁজে বের করুন কোন দলটা আসলে অত্যাচারিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমর্থক।
প্রিয় ভাইয়েরা আমার, আমার জীবদ্দশায় আপনারা এই লেখাগুলো পাঠ করবেন না। যখন হয়তো এই লেখা পড়বেন তখন আর আমি আপনাদের মাঝে নেই যে, ক্ষমতার জন্য সংগ্রামে অথবা স্বার্থপরতার লোভের বশবর্তী হয়ে আপনাদের যুব অনুভূতিকে বিপথগামী করার খেলা করব। যেহেতু আপনারা মেধাবী যুবসমাজ, তাই আমি চাই আপনারা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের খেদমতে, আমাদের প্রিয় ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খাতিরে আপনাদের তারুণ্যদীপ্ত জীবনকালকে এমনভাবে ব্যয় করুন যেন ইহলোকে এবং পরলোকে উভয়কালেই আপনারা সৌভাগ্যবান হতে পারেন। পাপমোচনকারী গাফুরুর রাহীম খোদার কাছে আমার আকুল মোনাজাত তিনি যেন আপনাদের মানবতার সহজ সরল পথে তথা সিরাতুল মুস্তাকিমে পরিচালিত করেন এবং তাঁর অফুরান রহমতের বরকতে আমাদের ও আপনাদের অতীত গোনাহ-খাতা মাফ করে দেন। আপনারাও একান্ত নিরিবিলি সময়ে আল্লাহর কাছে এই আকুল দোয়া করুন। কারণ, তিনিই পথপ্রদর্শক ও রহমান।
আমার এই অসিয়তনামায় ইরানী জনগণ ও দুনিয়ার দুর্নীতিবাজ সরকারসমূহ এবং বৃহত শক্তিগুলোর চাপে জর্জরিত অন্যান্য জাতির প্রতি একটি কথা বলার আছে। প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমি আহ্বান জানাই অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নিজেদের সন্তানদের তাজা খুনের বিনিময়ে যে মহা নেয়ামত (ইসলামী প্রজাতন্ত্র) তাঁরা লাভ করেছেন সে নেয়ামতের যেন অত্যন্ত সম্মানের সাথে সমাদর করা হয়। তার উপযুক্ত হেফাজত করা হয়, তাকে যেন নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে গণ্য করে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হয়। এই খোদায়ী রহমত, এই মহাদানকে যেন কোনমতেই অবহেলা করা না হয় এবং নির্ভয়ে এই রহমতের হেফাজতের জন্য সকল বাধাবিপত্তির মোকাবেলা করা হয়। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাক কোরআনে এরশাদ করেছেন : ‘যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থানকে দৃঢ় করে দেবেন।’ (আল কোরআন) হৃদয় দিয়ে শরীক হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমস্যা সমাধানে অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। আমি আহ্বান জানাই, দেশের মজলিশ ও সরকারকে নিজেদের আপন বলে মনে করুন এবং তাদেরকে সম্মানী ও প্রিয় বলে সংরক্ষণ করুন।
মজলিশ, সরকার ও সকল প্রশাসনের প্রতিও আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যেন এই জাতির দায়িত্বকে তাঁরা সম্মান করে জনগণ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। বিশেষ করে শোষিত, বঞ্চিত ও মযলুম জনতার দিকে তাঁদের খেয়াল রাখা উচিত। তাঁরা আমাদের নয়নের মনি, সবকিছুর হিতসাধনকারী, যাঁরা নিজেদের জান কুরবান করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্বও তাঁদের মহান অবদানের ফল। নিজেদেরকে আপনারা জনগণের বলেই মনে করুন আর জনগণও আপনাদেরই অংশ। সবসময়ই ইসলামী হুকুমতের উপযুক্ত ও শোভন মানবিক আচরণের দ্বারা যালিম সরকারগুলোকে নিন্দাজ্ঞাপন করবেন- যারা আগেও যেমন ছিল, বর্তমানেও ঠিক তেমনি মস্তিষ্কশূন্য ও বর্বর দল।
আর সকল মুসলিম জাতির প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, ইরানের ইসলাকী হুকুমত ও ইরানের মুজাহিদ জনগণকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রাখুন। নিজেদের জনগণের চাহিদার নিকট নতি স্বীকার করে সেই ধরনের নিষ্ঠুর সরকারকে বশীভূত করুন। ইরানী জাতিরও এই একই দাবি। এটা স্মরণ করা দরকার যে, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল সরকারগুলোই মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের প্রকৃত কারণ। আপনাদের প্রতি আমার জোরালো নসিহত, কখনো ইসলামের এবং মহান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দুশমনদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় কর্ণপাত করবেন না। কারণ, ইসলামকে ময়দান থেকে বিতাড়িত করাই এদের মূল উদ্দেশ্য যাতে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
ঘ. অনেকদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর একটা ইবলিসী পরিকল্পনা হলো দেশের আলেমসমাজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ইরানে রেযা খান এবং তার পুত্র মুহাম্মাদ রেযার আমলে এই ষড়যন্ত্র চরম আকার ধারণ করে। রেযা খানের শাসনামলে শয়তানদের অপকৌশল ছিল আলেমদের উপর অত্যাচার চালানো, তাঁদের ইসলামী লেবাস ছিনিয়ে নেয়া, তাদেরকে বন্দি করা। আর তার সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মাদ রেযা পাহলভীর আমলে তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনায় আরও কিছু বিষয় যোগ হয়েছিল, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও আলেমদের মাঝে পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতার আগুন ছড়িয়ে দেয়া যেন সবাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এতে বৃহত শক্তিগুলোর শয়তানি চালবাজির প্রতি ছাত্র-শিক্ষক ও আলেমরা নজর না রাখায় এবং তাদের সরলতার সুযোগে পাহলভী শাসকগোষ্ঠী অবাধ প্রচারণার সাহায্যে নিজেদের মতলব হাসিল করেছিল। একদিকে তারা খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখত যে, সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক ও উপাচার্য পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা কিংবা ইসলামবিরোধী বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের থেকে যেন নির্বাচিত হয়। প্রকৃত মুমিন, ইসলাম অনুরাগীরা যেন সংখ্যালঘু অবস্থায় থাকে। ওরা আপ্রাণ চেষ্টায় রত ছিল দেশের ভবিষ্যত শিশু-কিশোর-যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে যেন ওরা ধর্মকে তথা ইসলামকে ঘৃণা করা এবং ধর্মের সাথে জড়িত লোকজন, বিশেষ করে আলেমদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকে। সেই সময় পাহলভী শাসকরা বলে বেড়াত যে, আলেমরা ব্রিটেনের দালাল এবং পুঁজিবাদী ও বৃহত ভূস্বামীদের পক্ষে কথা বলে এবং প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থক। পরে আলেমদের বিরুদ্ধে বদনাম ছড়ানো হলো যে, তারা প্রগতি ও সভ্যতার বিরোধী। একই সাথে ওই শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের ধূর্ত কূটকৌশলের মাধ্যমে আলেমদের নিয়ে নতুন ফন্দি আঁটলো। তারা কলেজছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকশ্রেণির মধ্যে আলেমদের প্রতি অহেতুক ভয়ের সৃষ্টি করলো। আর আলেমদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তানরা প্রচারণা চালালো যে, কলেজছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকম-লী অধার্মিক ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। এভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলে যারা আছে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম, আলেমসমাজ ও ধার্মিক লোকদের বিরোধী রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে। ইসলাম ও আলেমদের প্রতি অনুগত সাধারণ জনগণকে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে একটা বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। সরকার ও সাধারণ জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যকার এই বিরোধ শোষক-লুটেরাদের খায়েশ পুরো করার উপযোগী পথ তৈরি করে। ফলে সরকারের প্রতিটি ব্যাপারেই লুটোরারা নাক গলাত এবং আমাদের জাতির সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের পকেট ভর্তি করত। আপনারা যেমনটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এই মযলুম জাতির ভাগ্যে কী ঘটেছে এবং কী ঘটতে যাচ্ছিল।
সর্বশক্তিমান রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এবং আমাদের মহান জাতি তথা আমাদের আলেমসমাজ, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবী জনগণ, কৃষক-মজুর প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগণের প্রচেষ্টায় এখন সকল প্রকার গোলামির জিঞ্জির ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। প্রতিরোধের দেয়াল ভেঙে দেয়া হয়েছে। দেশকে পরাশক্তি ও তার দোসরদের হাত থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারা যেন প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে গাফেল না হোন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রিয় সাহসী যুবকদের প্রতি আমার আহ্বান, তাঁরা যেন ওলামা ও ধর্মীয় ছাত্রদের সাথে তাদের একতা ও ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করেন। বিপজ্জনক দুশমনদের কুপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রসমূহ থেকে যেন অনবহিত না থাকেন । কথা ও কাজের মাধ্যমে যে কেউ তাঁদের মাঝে বিভেদের বীজ বপন করতে চায় তাকে যেন সৎপথে আনার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে যদি সে সুপথে না আসে তাহলে তাকে অস্বীকার করে সমাজ থেকে যেন বহিষ্কার করে দেয়া হয় । যেন সে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শিকড় গাড়তে না পারে। কারণ, ঝরনার উৎসমুখেই স্রোতধারার গতিরোধ করা অধিকতর সহজ। বিশেষ করে কোন অধ্যাপককে যদি যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস দেখা যায় তাহলে সেই অধ্যাপককে ছাত্রদের উচিত নসিহত করা! এতে যদি কাজ না হয় তাহলে সেই অধ্যাপককে পরিত্যাগ করা। আমার এ নসিহত আলেমসমাজ ও ধর্মীয় ছাত্রদের প্রতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ষড়যন্ত্রের জাল অত্যন্ত মারাত্মক। এই জাল খুঁজে বের করা সমাজের সম্মানিত বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য।
ঙ. যেসব মারাত্মক চক্রান্ত দুর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রিয় দেশের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে, সে চক্রান্তের অনেকগুলোর প্রভাব এখনও বিদ্যামান। সেগুলোর মধ্যে একটা চক্রান্ত হলো ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়ে পরমুখাপেক্ষী করা। তাদেরকে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা করে তোলা। এই হীন চক্রান্ত এত বেশি পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেছে যে, ঐসব দেশ এমনকি তাদের নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাসটুকুও হারিয়ে বসেছে। নিজেরা উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তম প্রজন্মের অধিকারী হয়েও এখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই শিবিরকে দুই মূল শক্তিকেন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, তাদের দেশ এই দুই শক্তির যে কোন একটির উপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে পারবে না। সে এক সুদীর্ঘ দুঃখজনক কাহিনী । এই দুই পরাশক্তির কাছ থেকে যে আঘাত আমরা পাচ্ছি তা মারাত্মক এবং বেদনাদায়ক। এর চেয়ে দুঃখজনক হলো যে, দুই পরাশক্তি অধঃস্তন মযলুম জাতিসমূহকে সবদিকে থেকে পদানত রাখতে চায়। তারা চায় এইসব দেশ যেন উতপাদনমুখী না হয়ে ব্যয়মুখী দেশ হিসেবে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে থাকে। ওরা আমাদের স্বকীয়তকে পরখ করার মতো আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়েছে যেন আমাদের যা কিছু আছে তা ওদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা চুপচাপ অন্ধের মতো বসে থাকি এবং আমাদের দেশ, আমাদের ভাগ্য ওদের হাতে ছেড়ে দেই। এই অন্তঃসারশূন্যতা এবং জড় অনুভূতি বৃহত শক্তিগুলোকে আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে। এই কারণে সকল ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব জ্ঞান গরিমা ও ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করছি এবং অন্ধের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে চলেছি। এমনকি আমাদের নিজেদের পাশ্চাত্যঘেঁষা বা প্রাচ্যমুখী অসভ্য লেখক এবং বক্তারা আমাদের নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও স্বকীয়তাকে নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করত। বিদেশি রসম-রেওয়াজ যতই ধ্বংসাত্মক বা উত্তেজনাকর হোক না কেন, এসব লেখক, বক্তারা তাদের কথা, কাজ ও কলম দ্বারা সেগুলোর প্রচারণা চালিয়েছে এবং এই অপসংস্কৃতিকে জাতিসমূহের সামনে উপস্থাপন করার জন্য তারা ছিল প্রশংসা ও গুণগানে মুখর। আর এখনো তারা তাই করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোন একটা বইয়ে বা কোন একটা রচনায় কিংবা কোন বক্তৃতায় কতিপয় বিজাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে সেই বই, রচনা বা বক্তৃতা আকর্ষণীয় বলে দাবি করা হয়। আর লেখক বা বক্তাকে বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা হয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সব কিছুরই নাম যদি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য পরিভাষায় ব্যবহার করা হয় তবে জনগণ তাকে সাদরে বরণ করে নেয়, একে উন্নতি ও সভ্যতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে স্বগতম জানায়। স্বদেশী নামগুলোকে গণ্য করা হয় সেকেলে, পরিত্যক্ত এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতীক হিসেবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জন্য আকুতি সব জায়গায়ই বিদ্যমান। যদি আমাদের সন্তাদের পাশ্চাত্য নাম হয় তাহলে তারা গর্ব অনুভব করে, আর যদি তাদের দেশীয় নাম হয় তাহলে নিদারুণ লজ্জা এবং হীনমন্যতায় ভোগে। আমাদের নগরীর রাস্তাসমূহ, দোকানপাট, কোম্পানি, ঔষধের দোকান, লাইব্রেরিসহ যে কোন পণ্যসামগ্রী সবকিছুর লিখিত নাম অধিকতর আকর্ষণীয় এবং উপযুক্ত হয়, যদি তা হয় বিদেশি নাম। যদিও সেসব সামগ্রী দেশেই তৈরি। প্রতিটি আচার-আচরণে, সামাজিক কায়দা-কানুনে এবং প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ধাঁচের রীতির আধিক্য একটা গৌরবের ব্যাপার এবং সভ্য ও প্রগতিশীল হওয়ার পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। অপরদিরকে স্বদেশী সংস্কৃতির প্রয়োগ পশ্চাদপদতা ও প্রাচীনমুখী হওয়ার চিহ্ন। অসুখ ভালো করার জন্য- যে অসুখ স্বদেশে যদিওবা নিরাময়যোগ্য, তবুও সেজন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার। এভাবে নিজেদের অভিজ্ঞ চিকিতসকদের হেয় প্রতিপন্ন করে প্রত্যাখান করা হয়।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র্র এবং মস্কো সফর করা একটা গৌরব ও মূল্যবান বিষয়, কিন্তু হজ পালনার্থে মক্কায় বা অন্যান্য পবিত্র স্থানে গমন করা তাদের কাছে পশ্চাদপদতা ও প্রাচীনপূজারি হিসেবে আখ্যায়িত। এদের কাছে ধর্ম, ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ব্যাপারগুলোতে উদাসীন থাকাই বুদ্ধিবৃত্তি ও সভ্যতার পরিচায়ক।
আমি এটা দাবি করছি না যে, আমাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই আমাদের নিজেদের রয়েছে। সুস্পষ্টভাবে সত্য যে, সাম্প্রতিক শতাব্দীতে বিশেষ করে গত কয়েক শতাব্দীতে বিদেশি শক্তিগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের কোন অগ্রগতি সাধিত হতে দেয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক বা কর্ণধাররা, বিশেষ করে পাহলভী বংশের কুখ্যাত ব্যক্তিরা আমাদের স্বীয় সামর্থ্যরে বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালিয়ে ও সেই সাথে স্বীয় অযোগ্যতার অনুভূতি সৃষ্টি করে আমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। দুশমনের যে সকল ফন্দিফিকিরের কারণে আমাদের দেশ পিছিয়ে পড়েছে সেগুলো হলো, যে কোন ধরনের বিদেশি জিনিসের আমদানি, আমদানিকৃত বিবিধ প্রকার দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত প্রসাধনী, বিনোদনমূলক ও খেলনার সামগ্রী প্রতি নারী-পুরুষ বিশেষ করে যুবসমাজের আকর্ষণ, ভোগের প্রতিযোগিতায় জনগণ এবং পরিবারসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সমাজের সবচেয়ে কর্মক্ষম যে অংশ, সেই যুবসমাজকে রিপুর তাড়না চরিতার্থের জন্য বেশ্যাবৃত্তি ও পতিতালয়ে টেনে আনা হয়েছিল।
আমরা এখন যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐসব ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানের বঞ্চিত জনগণের নবীন বংশধররা আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য জেগে উঠেছে। আমাদের অনেক কারখানায় এখন এয়ারক্রাফটের মতো জিনিস তৈরি হচ্ছে। যেখানে প্রাথমিক ধারণা ছিল কারখানাগুলোর চাকা ঘুরবে না, সাহায্যের জন্য পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দিকে তাকাতে হবে- এ অবস্থায় আমাদের তরুণরা অর্থনৈতিক অবরোধ ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে মোকাবেলা করার জন্য এমনসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন, যেগুলো বিদেশি যন্ত্রাংশের চেয়ে অধিকতর সস্তায় সরবরাহ করে আমাদের উতপাদন ক্ষমতায় এক বাস্তব প্রমাণ রেখেছেন। আমার এই শেষ ইচ্ছা ও নির্দেশনার মাধ্যমে প্রিয় জাতির প্রতি আমার হৃদয়স্পর্শী ও সেবাব্রত মন নিয়ে নসিহত- আপনারা সজাগ দৃষ্টিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল রাজনীতিবিদরা যেন তাদের ইবলিসি কুপ্ররোচনার মাধ্যমে আপনাদেরকে এই আন্তর্জাতিক লুটেরাদের বশীভূত করে না ফেলে। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরাধীনতার অবশিষ্ট আলামতগুলোকে নির্মূল করার জন্য জেগে উঠুন। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হোন যে, আর্য এবং আরবরা ইউরোপীয়ান, আমেরিকান বা সোভিয়েতদের চেয়ে হীন প্রকৃতির নয়। আমি তাঁদেরকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, একবার যদি তাঁরা নিজেদের স্বরূপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, হতাশার চিহ্নটুকু ছুঁড়ে ফেলে দেন, আর অন্যের সাহায্য পাবার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করেন, তাহলে অবশেষে আপনারা আপনাদের কর্মক্ষমতা ও সকল কিছুর উতপাদন ক্ষমতার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন। এদের মতো অন্যদের সমপর্যায়েও আপনারা যেতে সক্ষম হবেন, কিন্তু তার শর্ত হলো যে, আপনারা মহাপ্রভু রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার প্রতি পরির্পূণ আস্থা আনবেন। নিজেদের আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে বিদেশি দেশগুলোর উপর প্রযুক্তিগত নির্ভরতার অবসান ঘটাবার লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্ত হবেন, বিদেশি মাতব্বরি থেকে নিজেদের মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারী হবার মানসে সব ধরনের কঠোরতার বোঝা সহ্য করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকবেন । বর্তমান এবং ভবিষ্যত সরকার ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব হলো, স্বদেশি বিজ্ঞানীদের মর্যাদা দেয়া, বস্তুগত ও নৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে তাদেরকে কাজকর্মে উতসাহ প্রদান করা যাতে দেশে অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়বহুল ও ধ্বংসাত্মক সামগ্রীর অনুপ্রবেশ রোধ হয়। যা আছে তা নিয়েই তৈরি করার কাজে হাত দিতে হবে। আর এভাবে একদিন নিজেরাই সমস্ত কিছু প্রস্তুত করতে সক্ষম হবেন। আমি ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা ভোগবিলাসের জিন্দেগি আর অশ্লীল ক্রিয়াকর্ম, যেমন পতিতালয়গুলোতে উপস্থিতির বিনিময়ে নিজেদের স্বাধীনতা, মুক্তি ও মানবিক গুনাবলিকে বিসর্জন দেবেন না। কারণ, এগুলো পাশ্চাত্য ও তাদের দুষ্ট চেলাদের কাছ থেকে এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। স্বাধীনতা, মুক্তি ও এসব মানবিক গুণের সংরক্ষণে যদিও বা সমস্ত দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে নিতে হয়। অতীত সকল অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ওরা শুধু আপনাদের ধ্বংস দেখতে চায়। তারা চায় আপনাদেরকে দেশের ভবিষ্যত সম্বন্ধে গাফেল রাখতে। যাতে ওরা আপনাদের ধনসম্পদ অবাধে লুণ্ঠন করতে পারে। আপনাদের পায়ে গোলামি ও উপনিবেশবাদের জিঞ্জির পরিয়ে দিয়ে একমাত্র বিদেশি পণ্যের ক্রেতা জাতি হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। এটা এমন এক অপকৌশল, যদ্বারা আপনাদেরকে ওরা পশ্চাদমুখীই রাখতে চায়, যা তাদের ভাষায় ‘অর্ধ-বর্বর’ হিসেবে পরিচিত।
চ. পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর চক্রান্তসমূহের মধ্যে একটা হলো শিক্ষাদীক্ষার কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়া। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণভার, যার কথা পূর্বে বলা হয়েছে এবং বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যেগুলো আসলে ভবিষ্যত রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার তৈরির জন্য জনগণকে গড়ে তোলার কেন্দ্রবিশেষ। আলেমবৃন্দ এবং দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে তাদের একটা আলাদা কৌশল রয়েছে, যা হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কৌশল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই চক্রান্তটি হলো তাদের পথের কাঁটা আলেমসমাজকে ধ্বংস করে দেয়া এবং তাদেরকে একাকী বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আর সরাসরি দমনমূলক নীতি-পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদেরকে অপমান করা। যেমনটি রেযা খানের আমলে করা হয়েছিল- যা তাদের প্রতি বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে এবং উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। আর নয়তো মিথ্যা বদনাম ছড়িয়ে এবং অন্যান্য ইবলিসি কৌশল খাটিয়ে আলেমসমাজকে শিক্ষিত ও তথাকথিত বুদ্বিজীবীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এ নীতিটিও রেযা খানের আমলে চালু ছিল। আর তা দমননীতির পরিবর্তে ধূর্তামির পন্থা অবলম্বনে একইভাবে চালু ছিল মুহাম্মাদ রেযা শাহের আমলেও। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিদেশি শক্তিগুলোর চক্রান্ত হলো স্বদেশি সংস্কৃতি ও স্বীয় মূল্যবোধ থেকে যুবকদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের প্রতি প্রলুব্ধ করা, আর এ ধরনের মতাদর্শে শিক্ষিত ব্যক্তিদের থেকেই সরকারি প্রশাসকদের মনোনীত করা। দেশের ভাগ্য নির্ধারণের কাজে তাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করা। যাতে তারা বিদেশি শক্তিগুলোর হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করতে পারে। আর এই শিক্ষিত সমাজ যেন এমনভাবে দেশ পরিচালনা করে যাতে বিদেশিদের শোষণ ও সম্পদ লুণ্ঠনের পথ সুগম থাকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি প্রবণতা বজায় থাকে। আর সমাজের আলেমশ্রেণি বিচ্ছিন্ন, ঘৃণিত এবং পরাজিত হবার কারণে তাদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা (আলেমগণ) যেন করতে না পারে। এটা হচ্ছে ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে পশ্চাদমুখী করে রেখে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চক্রান্ত। কেননা, এর মাধ্যমে বৃহত শক্তিগুলো বিনা বাধায় এবং বিনামূল্যে অব্যাহতভাবে নিরীহ অসহায় জাতিসমূহের বিষয়সম্পত্তি পকেটস্থ করার পথ নিশ্চিত করতে পারে।
তাই, এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সংস্কার প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক পরিবর্তন ও পরিশুদ্ধি আনা হচ্ছে আমাদের সকলের কর্তব্য এই দায়িত্বে নিয়োজিতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সবসময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিচ্যুতির হাত থেকে মুক্তি দেয়া, বিচ্যুতির কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিরস্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা। কোথাও বিপথগামিতার আলামত পরিলক্ষিত হওয়ামাত্রই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তা সংশোধনে সচেষ্ট হওয়া। এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকদের শক্তিশালী হাতেই সুসম্পন্ন হওয়া উচিত। শিক্ষাগত বিপর্যয় থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্ধার করা মানে দেশ ও জাতিকে বিপথগামিতার হাত থেকে উদ্ধার করা।
আমার অসিয়ত প্রথমত তরুণ ও যুবসমাজের প্রতি এবং দ্বিতীয়ত তাদের পিতামাতা ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কর্ণধার ও দেশের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। তাঁরা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বান্তঃকরণে তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন, যা দেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেন আগামীদিনের বংশধরদের জন্য আমানত হিসাবে রেখে যেতে পারেন। ভবিষ্যত সকল প্রজন্মের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন আত্মমুক্তি, প্রিয় দেশ ও মানুষ গড়ার ধর্ম ইসলামের মুক্তির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিপথগামিতা এবং পূর্ব ও পশ্চিমা শক্তির গুপ্ত ফাঁদ থেকে রক্ষা করেন। আপনাদের এই মানবতাবাদী ইসলামী প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উপর থেকে বৃহত শক্তিগুলোর হস্ত কর্তন করে তাদেরকে যেন হতাশাগ্রস্ত করে দেন। মহান আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন এবং আপনাদের হেফাজত করুন।
ছ. একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইসলামী পরামর্শ পরিষদ (মজলিশ) সদস্যদের একনিষ্ঠতা । আমরা স্বচক্ষে দেখেছি শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র্রের আবির্ভাবের পর থেকে বর্বর পাহলভী শাসন আমল পর্যন্ত অযোগ্য এবং পথভ্রষ্ট আইনসভাগুলোর কারণে ইসলাম ও ইরানী জাতির কি ভোগান্তিই না হয়েছে! আর তা সবচেয়ে জঘন্যভাবে হয়েছে চাপিয়ে দেয়া এই ফাসেদ সরকারের আমলে। আমাদের স্মরণ আছে, এই হীন অপরাধী সরকার ও তাদের দোসরদের দ্বারা দেশ ও জাতিকে কি অসহ্য যন্ত্রণাই না পোহাতে হয়েছে!
গত পঞ্চাশ বছরের সময়কালে জাতীয় পরিষদে একটা বিশ্বাসঘাতক নকল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মোকাবেলায় মযলুম জনগণের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো পরে আমেরিকার বাসনা পূরণ করতে এই সমস্ত খোদাবিমুখ বিপথগামী দল সদা সচেষ্ট ছিল। আর তারা দেশকে রসাতলে ডুবিয়ে দেয়ার বজ্জাতিতেও লিপ্ত ছিল।
শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশে সংবিধানের কোন গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। রেযাখানের পূর্বে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবর্তক বড় বড় জমিদার ও মুষ্টিমেয় খানেরা বিদেশি শক্তিগুলোর স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করত। পাহলভী শাসনামলেও এসব বদমাশ ও তাদের লেজুড়ে শ্রেণির রাজত্বই কায়েম ছিল।
এখন যেহেতু দেখা যাচ্ছে, মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্যে এবং গৌরবময় ইরানী জাতির হিম্মতের বদৌলতে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার আজ জনগণের হাতে অর্পিত, সংসদের প্রতিনিধিরা সরকার ও বিভিন্ন প্রদেশের খানদের প্রভাবমুক্ত ও প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে ‘মজলিসে শুরা-ই-ইসলামি’তে আগত, সেহেতু ইসলাম ও দেশের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এটা আশা করা যায় যে, সত্যপথ থেকে সকল ধরনের বিচ্যুতিকে বাধা দেয়া হবে। তাই জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন দৃঢ় মনোবল নিয়ে দেশ ও ইসলামী অনুশাসনের প্রতি ওয়াদাবদ্ধ হয়ে প্রতিবারের সংসদ নির্বাচনে এমন প্রার্থী নির্বাচন করেন, যাঁরা হবেন ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যাঁরা সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবার ও অবহেলিত শ্রেণি থেকেই আসবেন। সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্য অথবা অন্য কোন বিভ্রান্তিকর শয়তানি মতাদর্শের প্রতি যাঁদের অনীহা থাকবে, যাঁরা হবেন সুশিক্ষিত, সুযোগ্য, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলি এবং ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেবহাল।
শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের প্রতি আমার পরামর্শ, বিশেষ করে আমাদের সম্মানিত দ্বীনী উৎস মারজাদের২ প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন সমাজের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বর্পূণ বিষয়ের প্রতি উদাসীন না থাকেন। এ সবের সংস্পর্শকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবেন না। আপনারা সকলেই স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন, ভবিষ্যত বংশধররাও পড়বে এবং শুনবে যে, পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যপন্থী ঝানু রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক পটভূমি থেকে আলেমদের উতখাত করতে চেয়েছিল, অথচ এ সমস্ত আলেমই শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের শিকড়কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিপুল কষ্ট ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। অপরদিকে আলেমরাও এই সমস্ত ঝানু রাজনীতিবিদের ছল-চাতুর্যের খেলায় ধোঁকা খেয়েছিলেন আর রাষ্ট্রীয় ও সাধারণ মুসলমানদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত হওয়াকে তাঁদের জন্য মর্যাদাহানিকর কাজ বলে মনে করতে শুরু করলেন। আর এটাও দেখেছেন, রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে কিভাবে আলেমগণ বিদেশি পুতুলদের কাছে রাজনৈতিক ময়দানকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, সংবিধান, দেশ ও ইসলামের যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।
এখন যেহেতু সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে সকল বাধাবিপত্তি অপসারিত হয়েছে এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য ব্যক্তিগত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য আর কোন ওজর-আপত্তি থাকলো না, (তাই) আমি আপনাদেরকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তা হলো মুসলমানদের সমাজিক কাজকর্মের ব্যাপারকে অবহেলা করা একটা অমার্জনীয় অপরাধ- কবিরা গুনাহ। প্রত্যেককে অবশ্যই সাধ্যমতো সমাজে নিজ নিজ প্রভাব অনুযায়ী ইসলাম ও দেশের সেবা করতে হবে। মহান ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী পথভ্রষ্ট ব্যক্তিবর্গ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মতাদর্শের প্রতি আসক্ত লোকদের এবং দুই উপনিবেশবাদী পরাশক্তির দলালদের অনুপ্রবেশকে অবশ্যই কঠোরভাবে বাধা দিতে হবে। আপনাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, ইসলাম ও মুসলিম দেশসমূহের দুশমন তথা আন্তর্জাতিক লুটেরা পরাশক্তিগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশ ও অন্যান্য মুসলিম দেশে অনুপ্রবেশ করে সূক্ষ্মভাবে এবং খোদ দেশীয় লোকদের হাতেই ঐ সমস্ত দেশকে শোষণের জালে আবদ্ধ করে। আপনাদের অবশ্যই সজাগ দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আর এ ধরনের অনুপ্রবেশের ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন, তিনি আপনাদের হেফাযত করুন।
বর্তামান ও ভবিষ্যত ইসলামী সংসদ সদস্যবর্গের প্রতি আহ্বান, আল্লাহ না করুন, যদি কোন পথভ্রষ্ট লোক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক ধূর্ততার মাধ্যমে স্বীয় সদস্য পদ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে মজলিশ যেন এর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন যেন কোন একজন বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী লোকও মজলিশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সরকারিভাবে স্বীকৃত অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন পাহলভী সরকারের শাসনামল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং নিজেদের সংসদ প্রতিনিধিদেরকে এমন লোকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেন যাঁরা হবেন নিজেদের ধর্ম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যাঁরা বিশ্বগ্রাসী বিদেশি শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল হবেন না। আর যাঁরা হবেন খোদাবিরোধী পথভ্রষ্ট বা বিকৃত আদর্শের প্রতি অনাকৃষ্ট। মজলিশের সদস্যদের প্রতি আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে পরস্পরের সাথে পরিপূর্ণরূপে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। আর খোদা না করুন, মজলিশে পাশকৃত বিলসমূহ যেন ইসলামবিরোধী না হয় এবং আপনারা যেন ইসলাম ও তার আসমানি বিধিবিধানসমূহে অবিচল থাকেন। এর ফলে আপনারা দুনিয়া ও আখেরাতে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারবেন। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের (শুরা-ই-নেগাহবান) প্রতি আমার একান্ত নসিহত, তাঁরা যেন অত্যন্ত সতর্কতা ও শক্তিমত্তার সাথে তাঁদের ইসলামী ও জাতীয় কর্তব্যসমূহ সম্পাদন করেন। অন্য কোন শক্তির কাছে বশীভূত হয়ে না পড়েন। তাঁরা যেন পবিত্র শরিয়ত ও সংবিধানবিরোধী আইনকানুন প্রচলনের বিরুদ্ধে বিনা দ্বিধায় বাধা প্রদান করেন আর যেন দেশের বিবিধ চাহিদার প্রতিও তাঁরা সজাগ থাকেন। এগুলো কখনো দ্বিতীয় পর্যায়ের অধ্যাদেশমালার (আহকাম-ই-সানাভিয়াহ) দ্বারা, কখনো বেলায়াতে ফকীহর নির্দেশনামার মাধ্যমে কার্যে পরিণত হতে পারে।
রাষ্ট্রের সকল নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য আমি ইরানের মহান জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। তা সে মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামীর নির্বাচন বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অথবা নেতা বা নেতৃপরিষদ গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞ পরিষদের (Assembly of Experts) নির্বাচনই হোক। আর নির্ভরযোগ্য আইনের মাপকাঠিতে যেন ঐ সমস্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ নেতা নির্ধারণ বা নেতৃপরিষদ গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞদের নির্বাচনের বেলায় যেন যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়। আর যদি সতর্কভাবে বিশেষজ্ঞদের সাংবিধানিক ও ধর্মীয় বিধি মোতাবেক নির্বাচন করা না হয়, তাহলে এমনও হতে পারে যে, সেই নির্বাচনের ফলে তারা দেশ ও ইসলামের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করবে। যার কারণে প্রত্যেকেই আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন। সুতরাং এই অবস্থায় জাতির সর্বস্তরের জনগণ, তথা মারজা থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের আলেম, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ও সরকারি কর্মচারী সবার উচিত দেশের সমস্ত কাজকর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলা। আর যদি তাঁরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন তাহলে দেশ ও ইসলামের ভবিষ্যত অবস্থার জন্য তারাই দায়ী থাকবেন। এ ব্যাপারটা বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। অনেক সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণের অনুপস্থিতি ও অবহেলার বিষয়টি এমন একটি ব্যাপার হিসেবে গণ্য যা কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যেও সর্ববৃহত গোনাহ। সুতরাং কোনকিছু সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এর নিরাময়ের ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি সকলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর এটাই প্রকৃত অবস্থা, যা শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পর আমরা ও আপনারা সবাই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নিরাময় আর কি হতে পারে যে, একটা জাতি তার উপর অর্পিত সমস্ত কাজকর্ম ইসলামী আইনকানুন ও সংবিধান অনুসারে করবেন, রাষ্ট্রপতি ও মজলিশ সদস্যদের নির্বাচনের ব্যাপারে অনুগত শিক্ষিত সমাজ যাঁরা বর্তমান ঘটনাবলি সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত, যাঁরা বিদেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল নন এবং তাকওয়া, ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারের ব্যাপারে যাঁদের সুনাম রয়েছে এমন সব বুদ্ধিজীবীর সাথে পরামর্শ করবেন, আর খোদাভীরু ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অনুগত আলেমদের সাথেও পরামর্শ করবেন। এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট এবং মজলিশ প্রতিনিধিরা যেন এমন সব প্রার্থী থেকে নির্বাচিত হন, যাঁরা সমাজের অসহায় ও নির্যাতিত জনগণের প্রতি কৃত যুলুমকে উপলব্ধি করেছেন, আর যাঁরা জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণির কথা চিন্তা না করে দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণের ব্যাপারে সচেতন। কারণ, সেই পুঁজিবাদী জমিদার ও অভিজাতরা তো ইন্দ্রিয়াসক্তিতেই মশগুল, তারা তো বঞ্চনার তিক্ততা, ক্ষুধা ও নগ্নপদীদের কষ্ট-বেদনা সম্পর্কে মোটেই অবহিত নয়।
আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, যদি রাষ্ট্রপতি ও মজলিশ প্রতিনিধিবৃন্দ যোগ্য, ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং দেশ ও জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলে অনেক সমস্যাই আমাদের সামনে থাকবে না, আর থাকলেও তা খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। সেই একই বিবেচনায় ‘বিশেষজ্ঞদের’ নির্বাচনের বেলায়ও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত। কারণ, তাঁরা নেতা বা নেতৃপরিষদ গঠনের দায়িত্বে নিয়োজিত। যদি এই সকল জননির্বাচিত বিশেষজ্ঞ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সমসাময়িক মহামান্য মারজা ও সারা দেশের শ্রেষ্ঠ আলেম, দ্বীনী ব্যক্তিত্ব ও নিষ্ঠাবান জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সংসদে প্রবেশ করেন, তাহলে নেতা অথবা নেতৃপরিষদ নির্ধারণের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নির্বাচনের কারণে অনেক সমস্যাই আর সামনে উপস্থিত হবে না, আর সমস্যা থাকলেও তা খুবই যোগ্যতার সাথে সমাধান করা সম্ভব হবে। শাসনতন্ত্রের ১০৯ এবং ১১০ অনুচ্ছেদে বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের গুরুদায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর পর্যায়ক্রমে নেতা বা নেতৃপরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের কথা বলা হয়েছে। এ ধারা দু’টিতে একটি কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নির্বাচনের ব্যাপারে সামান্যতম অবহেলা বা অমনোযোগিতাও ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরাট ক্ষতি সাধন করতে পারে। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা তাঁদেরকে তাঁদের প্রতি অর্পিত খোদায়ী দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ যামানার রাহবার বা নেতৃপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত যে, এ যামানাটি হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর ও বাইরে পরাশক্তি ও তাদের দোসরদের আগ্রাসনের যামানা, যদিও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নামে (প্রকৃতপক্ষে তা ইসলামেরই বিরুদ্ধে)। পরবর্তী সকল যুগের নেতা এবং নেতৃপরিষদের প্রতি আমার সবিশেষ উপদেশ, তাঁরা যেন ইসলাম, ইসলামী প্রজতন্ত্র এবং বঞ্চিত ও নির্যাতিত জনগণের খেদমতে নিজেদেরকে ওয়াক্ফ করে দেন। তাঁরা যেন এটা মনে না করেন যে, নেতৃত্ব জিনিসটা নিজেই তাঁদের জন্য একটা পুরস্কার, মর্যাদাপূর্ণ পদ; বরং এটা হচ্ছে বিপজ্জনক একটি গুরুভার। এক্ষেত্রে যদি সামান্যতম ত্রুটিও হয় আর খোদা না করুন, সেটা যদি প্রবৃত্তির তাড়নায় হয়ে থাকে তাহলে তা এ দুনিয়ায় বয়ে নিয়ে আসবে এক অনন্ত লাঞ্ছনা এবং পরকালে রয়েছে পরম পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার ক্রোধের অগ্নিশিখা।
রাহমানুর রাহীম সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার কাছে আমার আকুল প্রার্থনা, তিনি যেন আপনাদেরকে ও আমাকে বিপদসঙ্কুল এই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তওফিক দান করেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর মহান দরবারে আমাদেরকে আশ্রয় দিয়ে নাজাতের সুবন্দোবস্ত করেন। প্রেসিডেন্ট, সরকার এবং দায়িত্বমাফিক নিচু স্তরের গণকর্মচারীদের বর্তমান ও ভবিষ্যতে এ বিপদ কিছুটা কম। তাঁরাও আজ বা আগামীকাল কর্তব্য পালনে অক্ষমতার গভীর খাদে নিমজ্জিত হতে পারেন। এই কারণে তাঁদের উচিত সর্বদা মহাপ্রভু আল্লাহর উপস্থিতি ও দৃষ্টির কথা স্মরণ রাখা এবং নিজেদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির বলে বিশ্বাস করা। আল্লাহ আপনাদের চলার পথকে সুগম করে দিন।
জ. বিচারব্যবস্থা হলো সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের সাথে জড়িত। নেতা বা নেতৃপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে কোন ব্যক্তিকে নিয়োগের বেলায় অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান, শরিয়তী আইন-কানুন, ইসলাম ও রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। সর্বোচ্চ বিচার পরিষদ (High Judiciary Council) এর প্রতি আমার আবেদন, তাঁরা যেন সাবেক সরকারের আমলের দুঃখজনক ও শোচনীয় বিচারকার্যগুলোকে একান্তভাবে সংশোধনের চেষ্টা করেন। আমার অনুরোধ, সেইসব বিচারককে যেন এই গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ করা হয়- যারা ইসলামী ন্যায়বিচারকে অবজ্ঞা করে জনগণের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এই বিচার বিভাগীয় প্রশাসনের যেন পরিবর্তন সাধন করা হয়, যেন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অযোগ্য ও অশিক্ষিত বিচারককের সরিয়ে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, যোগ্য ও মনোনীত বিশেষ করে আমাদের সুমহান কোমের দ্বীনী মাদ্রাসার মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। যাতে রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার রহমতে সারা দেশে ইসলামী ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
চৌদ্দ মাসুমীন (১৪ জন সম্মানিত নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব) সম্পর্কিত হাদীসের কথা স্মরণ করে বিচারকদের গুরুত্ব এবং দ-বিধিসমূহের নিদারুণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই শেষ অসিয়তের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্মানিত বিচারকদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ- তাঁরা যেন যথাযথ ওয়াদাসহকারে এই পবিত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক বিচার বিভাগীয় পদ গ্রহণকে বাধা দেন, যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শ প্রদান করেন এবং যেন বিচার কাজের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণকে প্রত্যাখান না করেন। তাঁদের জানতে দেন যে, এই পদের ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনি এর জন্য খোদায়ী প্রতিদানও বেশি। আর এটাও জানিয়ে দেন যে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের এই কাজে অংশগ্রহণ একটা দ্বীনী দায়িত্ব।
ঝ. আমাদের দ্বীনী শিক্ষালাভের ব্যাপারে আমার এই অসিয়ত ও নির্দেশনামার মাধ্যমে আমার কিছু কথার পুনরাবৃত্তির তাকিদ অনুভব করছি। যেমন আমাদের এই যুগ ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিরোধীদের ততপরতার দ্বারা চিহ্নিত। তারা চায় শয়তানি চক্রান্তের মাধ্যমে এই দ্বীনী শিক্ষালয়গুলোতে পথভ্রষ্ট দুষ্টলোকদের ঢুকিয়ে ইসলামের ধ্বংস সাধন করতে। তাদের তাতক্ষণিক কৌশল হলো তাদের অসদাচরণ ও পথভ্রষ্ট নিয়মনীতির মাধ্যমে দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর বদনাম ছড়িয়ে দেয়া। এর দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর ফল হবে উচ্চতর পদে এক বা একাধিক ভণ্ড-প্রতারকের অনুপ্রবেশ। তারা নিজেদের ভণ্ড ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের পাণ্ডিত্য জাহির করে সরলমতি জনগণের মন জয় করে এবং সুযোগ বুঝে প্রিয় ইসলাম, দ্বীনী শিক্ষালয়সমূহ ও আমাদের দেশের উপর মরণাঘাত হানে।
আমরা জানি, অন্যান্য দেশে মহা শোষক বিশ্ব-লুটেরাদের বিভন্ন ধরনের দালাল-গুপ্তচর রয়েছে। এ চরদের মধ্যে থাকে জাতীয়তাবাদী, ভ- বুদ্ধিজীবী এবং পাগড়িধারী মোনাফেকের দল। এই শেষোক্ত দলটিই সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে। অনেক সময় তারা জনগণের সাথে তিরিশ বা চল্লিশ বছর পর্যন্ত বসবাস করে আপাত ইসলামী একজন মৌলভী, একজন পবিত্র বুজুর্গ ব্যক্তির ছদ্মবেশে। এই মোনাফেকেরা ‘প্যান ইরানবাদের’ মুখোশ পরে কিংবা দেশপ্রেমিক সেজে জনগণের চোখে ধুলো দেয়। এড়িয়ে যাবার সম্ভাব্য সবরকম কৌশল ব্যবহার করে এরা সুযোগ বুঝে সমাজের বুকে তাদের মারাত্মক আঘাত হানে। ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠার পর অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের প্রিয় জাতি এই রকম বহু লোকজন দেখেছে। এদের অন্যতম হলো মুজাহিদিন খাল্ক (MKO), ফেদাইনে খাল্ক, তুদেহ পার্টি এবং আরো অন্যান্য সংগঠন। এই ধরনের চক্রান্তসমূহকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বানচাল করে দেয়া আমাদের সকলের জন্য জরুরি। তবে সবচেয়ে দরকারি বিষয় হচ্ছে আমাদের দ্বীনী শিক্ষালয়সমূহ। আমাদের সম্মানিত শিক্ষক ও অভিজ্ঞ আলেমগণের যৌথ প্রচেষ্টার সাহায্যে এবং যামানার মারজাদের অনুমোদন নিয়ে দ্বীনী শিক্ষালয়গুলোতে অবশ্যই শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। ‘বিশৃঙ্খলার’ মাঝে ‘শৃঙ্খলা’ কথাটা সম্ভবত একই চক্রান্তকারীদের একটা তথাকথিত শিক্ষা তত্ত্ববিশেষ। যাই হোক, আমার অসিয়ত হলো সব যুগের বিশেষ করে এ যুগের দুশমনদের নানা চক্রান্ত ও পরিকল্পনার কারণে আমাদের দ্বীনী মাদ্রাসাগুলোতে একটা লক্ষ্যভেদী অভিযান চালানো দরকার। যাতে সেই আঘাতের কারণে একটা কার্যকরী পদ্ধতি চালু হয়ে যায়। আর এটাও প্রয়োজনীয় যে, আমাদের শ্রদ্ধেয় দ্বীনী শিক্ষকগণ এই কাজের সহায়তায় নিজেদের সময় ও প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন। আর তাঁরা যেন সঠিক সূক্ষ্ম কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে কোমের দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহ ও অন্যান্য বড় বড় হাওযায়ে ইলমিয়াকে (মাদ্রাসা-শিক্ষাকেন্দ্র) শয়তানি চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেন। আলেম এবং দ্বীনী শিক্ষকদের উপর এটা একটা অর্পিত দায়িত্ব যে, তাঁরা ফিকাহ্গত ক্লাসসমূহে প্রধান প্রধান বিষয়ের প্রতি সতর্ক নযর রাখবেন, যেন কোন পরিবর্তন ছাড়াই ওগুলোর প্রয়োগ হয়। কারণ, ফিকাহ্র এসব নীতি বিখ্যাত সব ফকীহর মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। আর এটাই ইসলামী আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ্) হেফাযতের পথ। প্রতিদিন তাঁদের আলোচনা-পর্যালোচনা, নতুন মতামত ও গবেষণাতে তাঁরা যেন সর্তকতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। ঐতিহ্যময় ফিকাহ্শাস্ত্র আমাদের সম্মানিত পূর্বসূরিদের আমানত যা থেকে বিচ্যুতি মানে গবেষণা ও অনুসন্ধান ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়া। তাকে হেফাযত করা ও গবেষণার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। অবশ্য দেশ ও ইসলামের প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন হতে হবে এবং ঐসব শাখায়ও লোকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সর্ববৃহত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তব্য হলো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানবশিক্ষা পরিসরের সবচেয়ে মহিমান্বিত ক্ষেত্র হচ্ছে ইসলামের নৈতিক-আধ্যত্মিক জ্ঞান (রুহানীয়াত), যেমন নীতিবিজ্ঞানসমূহ (ইলমে আখলাক), আত্মিক পরিশুদ্ধতা এবং সেই মহান আল্লাহর (যিনি আমাদের সবার রিযিকদাতা) নৈকট্য লাভের সাধনা- যা ‘জিহাদে আকবর’ বা ‘শেষ্ঠ জিহাদ’ হিসেবে পরিগণিত।
ঞ. সরকারের নির্বাহী বিভাগকে সংস্কার, পরিশুদ্ধ এবং সুরক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। মাঝে মাঝে এমন হয় যে, আপাতঃদৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত বিলগুলো পাশ করল, অভিভাবক পরিষদ কর্তৃক তা অনুমোদনও লাভ করল, তারপর সেগুলো কার্যে পরিণত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের মাধ্যমে দায়িত্বশীল প্রশাসকের নিকট প্রেরিত হলো। কিন্তু এই প্রশাসক শ্রেণির হাতে আইন তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। এসবের প্রয়োগ সেই প্রথাগত লালফিতা ও আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়ে। এভাবে ন্যায় বিচারের গতিরোধ করা হয় এবং জনগণের মাঝে অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
বর্তমানকালের দায়িত্বশীল মন্ত্রীবর্গ এবং তাঁদের ভবিষ্যত উত্তরসূরিদের প্রতি আমার পরামর্শ- আপনারা এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীবৃন্দ যে বেতন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তা তো জনগণের সম্পদ থেকেই আসে। কাজেই আপনাদের সকলেরই উচিত জনগণ, বিশেষ করে মযলুম জনতার সেবা করা। অহেতুক জনগণকে অসুবিধায় ফেলা আর নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বের বিরুদ্ধে কাজ করা সম্পূর্ণ নিষেধ- এটা একটা হারাম কাজ। খোদা না করুন, এই কারণে অনেক সময় আল্লাহর গজবও নাযিল হতে পারে ।
আপনাদের সবারই জাতির সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের জন্য জনগণের সমর্থনের কাছে আমরা ঋণী। বিশেষ করে জনতার সমর্থনের প্রতি। তাঁদের কাছে এজন্যও আমরা ঋণী যে, তাঁরা আমাদের দেশ ও সম্পদকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদি আপনারা জনসমর্থন থেকে বঞ্চিত হন তাহলে তাঁরাই আপনাদের অপসারিত করবেন এবং যালেম শাহের আমলের মতো যুলুমবাজ লোকেরা আপনাদের সম্পদগুলো দখল করে ফেলবে। কাজেই এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের উচিত যথাসাধ্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনগণের মন জয় করা এবং অনৈসলামী আচরণগুলো পরিহার করা।
একই দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিগণের প্রতি আমার অসিয়ত যে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রাদেশিক গর্ভনর নিয়োগ করবেন। এ পদে যোগ্য, দ্বীনীদার, নিষ্ঠাবান, সুস্থ বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন এবং জনগণের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম লোকদের নিয়োগ করবেন যাতে দেশে যত বেশি সম্ভব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আপনাদের মনে রাখতে হবে, যদিও সকল মন্ত্রী ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমস্ত প্রশাসনিক ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তবুও কারো কারো উপর কিছুটা বেশি দায়িত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর পরিচালনায় নিয়োজিত। ইসলামী বিপ্লবের শুরুতেই মন্ত্রণালয়গুলোতে বিরাজমান তাণ্ডবি মনোবৃত্তি সম্পর্কে আমি ধারাবাহিক কিছু পরামর্শ রেখেছিলাম। কিন্তু সরকারের কতিপয় মন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রণালয়কে এ আলোকে সংস্কার করতে অস্বীকৃতি জানান। আবারো অনেক চেষ্টা করেও সে কাজে সফল হতে পারেন নি। আজ ইসলামী বিপ্লবের তিন বছর৩ পর এই সংস্কারের লক্ষ্যে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আমি আশা করি, এসকল গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা যথাসময়ে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্যমণ্ডিত হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তার ভবিষ্যত পদাধিকারদের প্রতি আমার অসিয়ত, আপনারা একটি গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। আপনাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর সংস্কার সাধন করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। জাতির স্বাধীনতা ও স্বার্থকে সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে যারা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যে কোন ধরনের পরনির্ভরশীলতার দোষে দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ আপনাদেরকে পরিহার করে চলতে হবে।
মনে রাখবেন, অনেক ক্ষেত্রে বিদেশের উপর নির্ভরশীলতাকে সঠিক এবং প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ক্ষণস্থায়ী এবং শেষ পর্যন্ত এটা দেশের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিম জাতিগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করুন। অন্যান্য মুসলিম দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জাগিয়ে তোলার জন্য ঐক্য ও সংহতির প্রতি তাদেরকে আহ্বান জানান। এটা নিশ্চিত যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায় হবেন।
মুসলিম জাতিগুলোর প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে তথা ইসলাম ও ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে কখনো বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা না করেন। এই জীবন সঞ্জীবনী কাজে আপনাদের নিজদেরকেই জেগে ওঠা উচিত, যা আপনাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে।
সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্রের আলেম ও ওয়ায়েজগণের কর্তব্য হলো তাঁদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো, তাঁরা যেন বৈদেশিক শক্তিগুলোর উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং দেশের জনগণের সাথে ঐক্যে উপনীত হন। এর মধ্যে তাঁদের জন্য সাফল্য নিহিত রয়েছে। ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী বর্ণপ্রথার বিলোপ সাধনের জন্য আলেম ও ওয়ায়েজগণ আহ্বান করুন। তাঁরা যেন বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসী ভাইয়ের সাথে হাত মেলান। কারণ, ইসলামের জন্য তাঁরা পরস্পরের ভাই।
যখন ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা একবার সকল মুসলিম সরকার ও জনগণের মাঝে বাস্তবে রূপলাভ করবে তখন আপনারাই দেখবেন, মুসলমানরাই দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইন শাআল্লাহ একদিন আমরা মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে এই ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্য স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করব, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বর্তমান ও আগামীদিনের ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের প্রসারে যথাসাধ্য সচেষ্ট হন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সত্যিকার রূপকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এখন আমরা যেহেতু আমাদের দেশ থেকে বৃহত শক্তিগুলোকে বিতাড়িত করেছি, তাই আজ আমরা বৃহত শক্তিগুলোর মদদপুষ্ট সকল প্রচারমাধ্যমের অপপ্রচারের শিকারে পরিণত হয়েছি। বৃহত শক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তিকারী লেখক ও মুখপাত্ররা সদ্য প্রস্ফুটিত এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের মিথ্যা অপবাদও দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অধিকতর পরিতাপের বিষয় এ এলাকার (ইমাম এখানে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝাচ্ছেন) অধিকাংশ মুসলিম সরকারই আমাদের ও ইসলামের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামী বিধি মোতাবেক তাদের উচিত ছিল আমাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়া। অথচ তারা সবাই বিশ্বগ্রাসী শয়তানদের সেবায় মগ্ন। তাই চতুর্দিক থেকে তারা আমাদের উপর হামলা চালাচ্ছে। এর মোকাবেলায় আমাদের প্রচারণাশক্তি খুবই দুর্বল এবং অপারগ।
আপনারা ভালো করেই জানেন, বর্তমান দুনিয়া প্রচারণার ঘূর্ণাবর্তেই হচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, দুই পরাশক্তির যে কোন একটির প্রতি আকৃষ্ট তথাকথিত বুদ্ধিজীবী লেখকগণ দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা চিন্তা করার পরিবর্তে পরাশক্তির স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও একচেটিয়া আধিপত্যের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন । আর এ কাজ তাঁদেরকে দেশ ও জাতির কোন মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে দিচ্ছে না। তাঁরা সাবেক যালেমশাহীর প্রশাসন-প্রকৃতির সাথে বর্তমান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ও মুক্তির অবস্থাটি তুলনা করতে অক্ষম।
বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রের নিছক বস্তুগত প্রাচুর্য ও মাত্রাতিরিক্ত আরাম-আয়েশ না থাকলেও তাঁরা যে সম্মানিত জীবন যাপন করছেন তা অতীতের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের আমলে কখনো করতে পারতেন না। তখন তো তাঁরা ঘৃণ্য আনুগত্য ও গোলামির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির আখড়া, স্বৈরাচারের উৎস এবং বেশ্যাবৃত্তির প্রশংসা করে সেগুলোকে উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। (উপরে বর্ণিত এই জঘন্য প্রকৃতির লেখকদের প্রতি ইমামের আহ্বান) তাঁরা যেন এই সদ্যপ্রসূত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও অন্যায় অভিযোগ উত্থাপন থেকে বিরত থাকেন এবং জনগণ ও সরকারের সাথে একই কাতারে মিশে বিশ্বব্যাপী সকল যালেম ও তাগুতের বিরুদ্ধে তাঁদের কথা ও লেখনিকে কাজে লাগান।
প্রচারের দায়িত্ব কেবল ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের একারই নয়; বরং সকল জ্ঞানী-গুণী, বক্তা, লেখক, শিল্পীরও দায়িত্ব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেষ্টা করা উচিত যাতে দূতাবাসসমূহ প্রচারমূলক সাময়িকী সংরক্ষণ করে এবং ইসলামের জ্যোতির্ময় চেহারাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। কোরআন ও সুন্নাহ ইসলামের যে সকল জ্যোতির্ময় দিকের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে তার সে জ্যোতির্ময় চেহারার উপর থেকে যদি ইসলামবিরোধীদের ও বিচ্যুত চিন্তার অধিকারী বন্ধুদের দ্বারা সৃষ্ট অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তা ইসলামের বিশ্বজনীন রূপকেই প্রকাশ করবে এবং তার গৌরবময় পতাকা সর্বত্র উড্ডীন হবে। বড়ই মুছিবত ও দুঃখজনক অবস্থা যে, মুসলমানদের অধিকারে অদ্বিতীয় ও অমূল্য এক রত্ম (ইসলামী আদর্শ, মানুষ স্বাভাবিকভাবে যে আর্দশের প্রয়োজন অনুভব করে) থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যদের তা উপহার দিতে শুধু ব্যর্থ হয়নি, বরং একে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এর গুরুত্ব সম্পর্কে তারা অজ্ঞ এবং অনেক সময় তারা এই কাজ থেকে পালিয়ে থাকে।
ট. আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্যনির্ধারক বিষয় হলো বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শ্রেণির প্রতিষ্ঠানের অবস্থা। যার অপরিসীম গুরুত্বের কারণে এ সম্পর্কে আমি সংক্ষিপ্তকারে পুনরায় কিছু কথা বলতে চাই। ইরানী জাতির অবশ্যই জানা থাকা উচিত যে, বিগত পঞ্চাশ বছরে ইরান এবং ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে যত মারাত্মক আঘাত পেয়েছে অন্য কিছু হতে ততটা পায়নি। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশীয় স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ ইসলামী ও জাতীয় পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিশু, নওজোয়ান ও যুবকদের শিক্ষা-দীক্ষা ও মানসিক পরিশুদ্ধির কাজে ব্যস্ত থাকত তাহলে আমাদের দেশ ইংল্যান্ড এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কখনো কুক্ষিগত হতো না। সেক্ষেত্রে কখনও ধ্বংসাত্মক চুক্তিসমূহ আমাদের এই মযলুম ও লুণ্ঠিত জাতির ঘাড়ে চাপানো যেত না; বিদেশি উপদেষ্টারা কখনো ইরানে আসার পথ খুঁজে পেত না; কষ্টভোগী এই জাতির সম্পদ ও কালো সোনা (তেল) কখনো বিশ্ব শয়তানি শক্তিগুলোর পকেটস্থ হতো না। পাহলভী বংশ এবং তার চেলা-চামুণ্ডারা কখনো জনগণের ধনদৌলত হরণ করে তা দিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে নির্যাতিত জনগণেরই কবরের উপর বিলাসী প্রাসাদ তৈরী করার সুযোগ পেত না । মযলুম জনতার কষ্টার্জিত অর্থসম্পদ দিয়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর উদর পূর্তি করতে এবং নানা প্রকার ইবলিসি আমোদ-প্রমোদ এবং নিজের ও তার আত্মীয়-স্বজনদের লাম্পট্যের পেছনে অর্থকড়ি ব্যয় করতেও পারত না।
যদি আমাদের মজলিশ, মন্ত্রীসভা, বিচারবিভাগ এবং অন্য সংগঠনগুলোকে ইসলামী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত লোকদের দ্বারা পূর্ণ করা যেত, তাহলে আজ আমাদের জাতিকে এই ধরনের ধ্বংসাত্মক সম্যস্যাবলির মোকাবেলা করতে হতো না। যদি চরিত্রবান, ইসলাম ও খাঁটি জাতীয়তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট (সেই জাতীয়তাবাদ নয় যা আজকের যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়) ব্যক্তিবর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে সরকারের তিনটি বিভাগে নিজেদের পদচারণা করত তাহলে আজ অবস্থা অন্যরকম হতো। আজ আমরা একটা আলাদা জাতিকে দেখতে পেতাম। আমাদের বঞ্চিত জনগণ আজ বঞ্চনার বন্দিত্ব থেকে নিজেরা মুক্ত হয়ে আসত এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, বেশ্যাবৃত্তি, নেশাগ্রস্ততা এবং অন্যান্য দুষ্কর্মের সামান্যতম নির্দশনও সমাজ থেকে নির্মূল করে ফেলত। এসব দূষিত প্রভাবের প্রতিটিই এককভাবে আমাদের মূল্যবান কর্মক্ষম যুবশক্তিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে যথেষ্ট। আর পরিস্থিতি যদি অন্যরকম হতো তাহলে আজ আমাদের জনগণ আত্মবিনাশী এবং জাতীয়ভাবে ধ্বংসাত্মক উত্তরসূরিতে পরিণত হতো না। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসলামী আদর্শ, মানবীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো তাহলে তারা এই সমাজকে হাজার হাজার শিক্ষাবিদ উপহার দিতে পারত। কিন্তু এটা দুঃখজনক ও পরিতাপের ব্যাপার যে, আমাদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তত্ত্বাবধানে এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার কাজে (কতিপয় নির্যাতিত সংখ্যালঘু ছাড়া) এমনসব লোকজন নিয়োজিত ছিল, যাদের সবাই ছিল পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্যপন্থী এবং সুপরিকল্পিতভাবে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের আসন বজায় রাখত। আর কোন বিকল্প না থাকায় আমাদের যুবসমাজ পরাশক্তির উপর নির্ভরশীল নেকড়েগুলোর বদ-সংসর্গে লালিত হয়েছিল। তারা আইনসভা, সরকার ও বিচারবিভাগের বিভিন্ন পদলোভী হয়ে স্বৈরাচারী পাহলভী শাসনের নির্দেশমতো কাজ করত।
রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার শোকর, এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতিবাজদের থাবামুক্ত হয়েছে। সর্বযুগে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার ও জনগণের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব হলো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভ্রষ্ট নষ্ট মতবাদ ও দুই পরাশক্তির মতাদর্শের অনুপ্রবেশকে বাধা দেয়া। প্রথমেই যেন তাদেরকে বাধা দেয়া হয়, যাতে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয় এবং পরিস্থিতি হাতের মুঠোর বাইরে চলে না যায়। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় যুবকদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন তাঁদের নিজেদের এবং দেশ ও জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে নিজেরাই সাহসের সাথে এই সমস্ত ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
ঠ. দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীসহ (সশস্ত্র পুলিশ) রাষ্ট্রীয় পুলিশ, বিপ্লবী কমিটিসমূহ, বসিজ (গণবাহিনী) এবং উপজাতীয়রা। তাঁরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শক্তিশালী বাহু এবং দেশের সীমান্ত এলাকা, সড়ক, শহর, নগর ও গ্রামসহ সর্বত্র নিরাপত্তা বিধান করে জাতির অন্তরে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেন। এদেরকেও মজলিশের সামনে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে সমাসীন করানো উচিত। তাদের (সরকার ও জনগণের) সকলেরই খেয়াল রাখা দরকার যে, বৃহত শক্তিগুলো ও তাদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অন্য দেশের সেনাবাহিনীকে অন্য যে কোন গোষ্ঠী বা সংস্থার তুলনায় বেশি ব্যবহার করতে চায়। সশস্ত্রবাহিনীই তো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটায় এবং সরকার ও প্রশাসনের পরিবর্তন করে থাকে। প্রতারক ও বদমাশ লোকেরা সেনাবাহিনীর প্রধানদের কিনে নিতে চায় এবং সেই স্থানীয় প্রধানদের মাধ্যমে কোন দেশের উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। প্রতারিত সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা প্রাধান্য বিস্তার করে এবং মযলুম জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা হরণ করে নেয়। কিন্তু সেনাপতিগণ যদি ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হন তাহলে জাতিসমূহের শত্রুরা অন্য দেশে অভ্যুত্থান ঘটাতে বা তা দখল করতে সক্ষম হবে না। আর যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে সেসব দেশের নিবেদিতপ্রাণ সেনাপতিরা তাদের ঘৃণ্য প্রত্যাশাকে নিরাশার ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবেন।
ইরানেও- যেখানে জনগণের দ্বারা যুগান্তকারী এক অলৌকিক ঘটনা (ইসলামী বিপ্লব) সংঘটিত হয়েছে সেখানেও নিষ্ঠাবান সশস্ত্রবাহিনী এবং চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক সেনানায়কদের ছিল এক বিরাট ভূমিকা। আজ সাদ্দাম আমাদের উপর যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিশ্বশক্তির নির্দেশে এক অভিশপ্ত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এ যুদ্ধ শুরু হবার দু’বছর পরে আজ ইরাকের বাথপন্থী সেনাবাহিনীর জন্য এসেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরাজয়। এটা আমাদের জন্য একটা বিজয় যা আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (সেপাহ পাসদারান), গণবাহিনী ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন দানের ফলে অর্জিত হয়েছে এবং যুদ্ধের ময়দানে ও তার বাইরে সর্বসাধারণের অমূল্য অবদানের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। এরাই তো সেই জনগণ যাঁরা ইরানকে মহা গৌরবান্বিত করেছেন, যাঁরা বিশ্বে ইরানের খ্যাতি ছড়িয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিবিরভুক্ত দেশগুলোর চেলা-চামুণ্ডারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ সংঘটনের মাধ্যমেও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূলোৎপাটনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবী কমিটি, রক্ষীগার্ড, গণবাহিনী, পুলিশবাহিনীর শক্তিশালী যুবকদের দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে আর সাহসী জনগণের সাহায্যে এ সমস্ত ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করা হয়েছে। এরাই সেই প্রিয় উৎসর্গী যুবক, যারা তাদের পরিবারসমূহকে নিশ্চিন্তে রাখার জন্য রাত্রি জাগরণ করে। মহান প্রভু তাদের সহায় হোন।
কাজেই আমার জীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি সাধারণভাবে ভ্রাতৃসুলভ অসিয়ত- ‘হে আমার প্রিয় ভাইয়েরা! তোমরা যারা ইসলামকে প্রিয় করে নিয়েছ, জিহাদের ময়দানে তোমাদের জান কুরবান করে দিয়েছ এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আত্মনিবেদিত হয়েছ, শুধু আল্লাহর খাতিরে আর পরকালে আল্লাহ পাকের দীদার লাভের উদ্দেশ্যে, তোমরা হুঁশিয়ার! বেঈমানী ও গুপ্তহত্যার শাণিত অস্ত্রের ধার তোমাদের প্রতি উদ্যত। চুতর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যঘেঁষা রাজনীতিকরা এবং দৃশ্যান্তরালে শয়তানদের গোপন হাত অন্যদের চেয়ে তোমাদের প্রতিই বেশি নিবদ্ধ। তারা তোমাদের ক্ষতিসাধন করতে চায়। কারণ, তোমরাই তো নিজেদের জান কুরবানের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়কে এগিয়ে নিয়েছ এবং ইসলামকে পুনর্জীবিত করেছ। ওরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে উপড়ে ফেলতে চায়, জাতির কাছ থেকে তোমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে যে কোন একটা পরাশক্তির খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করতে ওরা বদ্ধপরিকর। ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদের প্রতি মেকি আনুগত্য দেখিয়ে ওরা রাজনৈতিক চালবাজির সাহায্যে তোমাদের প্রচেষ্টা ও জান কুরবানিকে বানচাল করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় রত।
জোরালো কণ্ঠে আমি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অসিয়ত করছি কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্রব না রাখতে এবং সকল প্রকার রাজনৈতিক চালবাজি থেকে দূরে থেকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবিচল থাকতে। এ নির্দেশ নির্বিশেষে সশস্ত্র বাহিনীর সকল বিভাগের প্রতি প্রযোজ্য। যেমন : সাধারণ সৈনিক, নিরাপত্তা বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীগার্ড, গণবাহিনী এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রভৃতি। শুধু এভাবেই তাঁরা তাঁদের সামরিক শক্তি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন। সেনানায়কদেরও দায়িত্ব রয়েছে, তাঁদের অধীনস্থ সৈনিকদের কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের সংশ্রবে যাওয়া থেকে বিরত রাখা।
যেহেতু এই বিপ্লবের হকদার হলো সর্বস্তরের জনগণ, আর তাই এর সংরক্ষণের দায়িত্বও সকলের উপর ন্যস্ত। তাই সরকার, জনগণ, প্রতিরক্ষা পরিষদ এবং ইসলামী পরামর্শ পরিষদ প্রভৃতি সকলেরই এটা একটা শরীয়তী ও জাতীয় দায়িত্ব যে, সশস্ত্র বাহিনী ও এর সেনানায়কদের দ্বারা ইসলাম ও দেশের স্বার্থবিরোধী যে কোন ততপরতার বিরোধিতা করা। সেই সাথে এই খেয়ালও রাখতে হবে তাঁরা যেন কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মকা- কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িয়ে না পড়েন। কারণ, এগুলো তাঁদের জন্য ধ্বংসই ডেকে আনবে। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতা বা নেতৃপরিষদের সকলেরই ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য যাতে জাতি অনিষ্ট থেকে রক্ষা পায়। পার্থিব জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি সব ধরনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আন্তরিকতার সাথে অসিয়ত করছি- আপনারা আজকে যেমন একমাত্র স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী আদর্শ- যার হেদায়াতের আলোয় আল্লাহ তাআলা সকল মানুষকে মানবতার সবচেয়ে সমুন্নত স্তরে উন্নীত হবার জন্য দাওয়াত করেছেন, সেই ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান রয়েছেন, সে নিষ্ঠাকে দৃঢ়তর করুন। কেননা, তা আপনাদেরকে এবং আপনাদের দেশ ও জনগণকে লজ্জা, অপমান এবং সেই সব শক্তির- যারা শুধু আপনাদের সবাইকে গোলামে পরিণত করে রাখতে, আপনাদের দেশ ও জনগণকে পশ্চাদপদ রাখতে, তাদের দেশের পণ্যের বাজারে পরিণত করতে অপমানজনক যুলুম সইয়ে নিতে চায়- তাদের তাঁবেদারি থেকে মুক্তি দেবে। দুঃখ-কষ্ট সহকারে হলেও সম্মানজনক জীবনকে জৈবিক পাশবিক আরাম-আয়েশযুক্ত লাঞ্ছিত গোলামির জীবনের উপর অগ্রাধিকার দিন। মনে রাখবেন, উন্নততর শিল্পের প্রয়োজনে যতদিন অন্যদের কাছে হস্ত প্রসারিত করবেন এবং তাদের দুয়ারে ধর্ণা দিবেন ততদিন আপনাদের আবিষ্কার, উদ্ভাবনক্ষমতা বিকশিত হবে না। আপনারা ইতিমধ্যেই অত্যন্ত ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন যে, ইতিপূর্বে যাঁরা কোন কিছু তৈরির ব্যাপারে নিজেদের অক্ষম বলে মনে করতেন এবং কল-কারখানা চালানোর প্রশ্নে হতাশায় নিমজ্জিত থাকতেন তাঁরাই অর্থনৈতিক বয়কটের পর এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নিজেদের চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্রবাহিনী ও কল-কারখানাসমূহের বহু প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হয়েছেন। বস্তুত এই যুদ্ধ, অর্থনৈতিক বয়কট ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বহিষ্কার হচ্ছে এক খোদায়ী উপঢৌকন যে সম্পর্কে আমরা উদাসীন ছিলাম। এখন যদি স্বয়ং সরকার ও সশস্ত্রবাহিনী বিশ্বগ্রাসীদের উৎপাদিত পণ্য বয়কট করে আর আবিষ্কার, উদ্ভাবনের পেছনে শ্রম সাধনা বৃদ্ধি করে তাহলে আশা করা যায় যে, দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর হবে এবং দুশমনদের দ্বারে ধর্ণা দেয়া থেকে পরিত্রাণ পাবে। এখানে আরও কিছু কথা যোগ করছি যে, এতসব কৃত্রিম পশ্চাদপদতা সত্ত্বেও বিদেশি বৃহত শিল্পের প্রতি আমাদের মুখোপেক্ষিতা এক অনস্বীকার্য সত্য । কিন্তু তার মানে এই নয় যে, উন্নততর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জন্য আমাদেরকে দুই পরাশক্তির কোন একটির উপর নির্ভর করতে হবে। বরং যেসব দেশ উন্নততর বৃহত শিল্পের অধিকারী অথচ সাম্রাজ্যবাদী শোষক নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্ঠাবান ছাত্রদেরকে সেসব দেশে প্রেরণের জন্য সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর সচেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু আমেরিকা ও রাশিয়া এবং এই শক্তির বলয়ে অবস্থানরত অন্যান্য দেশে প্রেরণকে পরিহার করতে হবে। যতদিন না এই দুইশক্তি ইনশাআল্লাহ স্বীয় ভুল বুঝতে পারে এবং মানবিক, মানবপ্রেমিক ও অন্যদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ধারা গ্রহণ করে। অথবা বিশ্বের মুস্তাযআফ (নির্যাতিত) জনগণ ও সচেতন, নিষ্ঠাবান মুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহ তাদেরকে ইনশাআল্লাহ স্বীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়। সে দিনটারই আমরা প্রত্যাশা করছি।
ড. রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সিনেমা ও থিয়েটার বিশ্বের জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে যুবসমাজকে ধ্বংস ও অচেতন করার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে বিশেষ করে এর দ্বিতীয়ার্ধ্বে ইসলাম ও জনগণের খাদেম ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে প্রচারণার ক্ষেত্রে এসব প্রচারমাধ্যমের দ্বারা বিরাট ভূমিকা পালন করানো হয়েছে। পণ্যের বাজার তৈরির জন্য, বিশেষ করে রূপচর্চার ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস, গৃহনির্মাণ ও গৃহের ডিজাইন-সাজসজ্জার ক্ষেত্রে এবং পানীয়, পরিধেয় সামগ্রী ও তার ডিজাইনের ব্যাপারে অন্ধ অনুকণের ক্ষেত্রে এসব প্রচারমাধ্যমকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও তার ডিজাইন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশেষেত বিলাসী ও অর্ধবিলাসী নারীদের জন্য এই পাশ্চাত্য-সংস্কৃতি এক বিরাট গৌরবের ব্যাপার বলে গণ্য হতো। আর পারস্পরিক মেলামেশা, আদব-কায়দা, কথা বলার ধরন এবং কথায় ও লিখায় পশ্চিমা শব্দাবলির ব্যবহার প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল যে, অধিকাংশ জনগণের পক্ষেই তা অনুধাবন করা সম্ভব হতো না। এমনকি সমপর্যায়ের লোকদের জন্যও বুঝে ওঠা কঠিন হতো। টেলিভিশনে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে নির্মিত ছায়াছবি দেখানো হতো যা তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদেরকে তাদের স্বাভাবিক জীবনধারা, কাজকর্ম, শিল্প, উতপাদন ও জ্ঞানার্জন থেকে বিচ্যুত করে নিজের ও নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন করে তুলতো। অথবা নিজের ও নিজ দেশের সবকিছু সম্পর্কে, এমনকি স্বীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মহামূল্য শৈল্পিক অবদানসমূহ- যার অনেকাংশই স্বার্থসন্ধানী, বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীদের মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গ্রন্থাগার ও যাদুঘরসমূহে স্থানান্তরিত হয়েছে, এসব সম্পর্কে পর্যন্ত সন্ধিগ্ধ করে তুলতো। সাময়িকীসমূহ অশ্লীলতাপূর্ণ, কলঙ্কময় প্রবন্ধ ও ছবি প্রকাশ করে এবং দৈনিক পত্রিকাসমূহ স্বকীয় সংস্কৃতি ও ইসলামবিরোধী প্রবন্ধ প্রকাশের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সগৌরবে জনগণকে, বিশেষ করে আবেগপ্রবণ যুবসমাজকে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এছাড়া অশ্লীলতার কেন্দ্র, প্রমোদাগার, জুয়ার আড্ডা, লটারি, বিলাস-সামগ্রী বিক্রয়ের দোকান, প্রসাধনী, খেলাধুলার সরঞ্জাম, মাদকদ্রব্য বিশেষ করে পশ্চিমা মাদ্রকদ্রব্য এবং তেল, গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদ রপ্তানির বিনিময়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত খেলার পুতুল ও অন্যান্য খেলাধুলা ও বিলাস সামগ্রী, আর এ ধরনের আরো শতশত জিনিস যে সম্পর্কে আমার মতো ব্যক্তিগণ খবর রাখেন না, এসব প্রচলনের জন্য যে ব্যাপক প্রচার চালানো হতো তাও এর সাথে যোগ করুন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা যদি এরূপ হতো যে, বহিঃশক্তির তাঁবেদার দুর্বৃত্ত পাহলভী সরকারের আয়ু অব্যাহত থাকত তাহলে দুর্নীতিপরায়ণ সরকার, প্রচারমাধ্যমসমূহ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবীদের নানাবিধ শয়তানি ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের মাধ্যমে ইসলাম ও দেশের মহান সন্তানগণ যুবসমাজকে-জনগণের আশাপূর্ণ দৃষ্টি যাদের প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে-জনগণ ও ইসলামের নিকট থেকে চিরবিদায় নিতে হতো। অথবা নিজেদের যৌবনকে পাপাচারের কেন্দ্রসমূহে নিঃশেষ করে দিতে হতো। কিংবা বিশ্বগ্রাসী শক্তিসমূহের সেবায় লিপ্ত হয়ে দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিত। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ও তাদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদের সকলকেই পাপিষ্ঠ ও লুটেরাদের অনিষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছেন।
এখন, বর্তমান ও ভবিষ্যত মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টগণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল অভিভাবক পরিষদ, বিচারপরিষদ ও মন্ত্রীপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন এই সংবাদ সংস্থা, সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহকে ইসলাম ও দেশের কল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত হতে না দেন। আর আমাদের সকলেরই জেনে রাখা উচিত যে, পশ্চিমা ধরনের স্বাধীনতা যা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, সে ধরনের স্বাধীনতা ইসলাম ও বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ইসলাম শালীনতাবোধ ও জাতীয় কল্যাণের পরিপন্থী যে কোন ধরনের প্রচারণা, প্রবন্ধ রচনা, বক্তব্য, গ্রন্থ-রচনা ও সাময়িকীসমূহের প্রকাশনা হারাম করেছে। তাই আমাদের সকলের এবং সকল মুসলমানের জন্যই ফরজ হলো এ সবের প্রতিরোধ করা। এহেন ধ্বংসাত্মক স্বাধীনতাকে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে যা কিছু হারাম আর যা কিছু জনমত ও ইসলামী রাষ্ট্রের পরিপন্থী এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা হানিকর, তা অবশ্যই অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যথায় সকলকেই এ জন্য দায়ী থাকতে হবে। হিযবুল্লাহী (আল্লাহর দলের) জনতা ও যুবসমাজ যদি উপরোল্লিখিত যে কোন বিষয়েরও সম্মুখীন হন, তাহলে তাঁরা তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করবেন, যদি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে অগ্রসর না হন তাহলে উক্ত বিষয়ের প্রতিরোধের দায়িত্ব তাঁদের নিজেদেরই। আল্লাহ তাআলা এ পথে সকলেরই জন্য সহায়ক হোন।
ঢ. জনগণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে ততপর এমনসব দল, উপদল ও ব্যক্তির প্রতি বিশেষ করে দেশের ভিতরে ও বাইরে অবস্থানরত তাদের নেতাদের প্রতি আমার অসিয়ত ও নসিয়ত- এ পর্যন্ত আপনারা যত পন্থায়ই পদক্ষেপ নিয়েছেন, যত ষড়যন্ত্রেরই আশ্রয় নিয়েছেন, যত দেশ ও বড় বড় কর্তাব্যক্তির নিকটই আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা- যাঁরা নিজেদেরকে জ্ঞানী ও সুস্থ-বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন বলে দাবি করেন নিশ্চয়ই বুঝে থাকবেন যে, সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ, বোমাবাজি এবং অবাস্তব ও উদ্ভট মিথ্যা বেসাতির দ্বারা একটি আত্মোৎসর্গী জাতিকে পথভ্রষ্ট করা সম্ভব নয়। এহেন অমানবিক ও অযৌক্তিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে কোনদিনই কোন হুকুমত ও সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে ইরানের মতো কোন দেশ- যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাঁদের জীবনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র, কোরআন ও ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আপনাদের তো জানাই আছে (আর যদি জানা না থকে, তাহলে বলব, আপনাদের চিন্তা অত্যন্ত অগভীর ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ) যে, জনগণ আপনাদের সাথে নেই এবং সশস্ত্র বাহিনী আপনাদের শত্রু। আর আপনারা যদি ধরে নেন যে, এরা আপনাদের সাথে ছিলেন, আপনাদের বন্ধু ছিলেন তাহলেও আপনাদের ধ্বংসাত্মক ততপরতা ও উস্কানিতে সংঘটিত অপরাধসমূহ তাঁদেরকে আপনাদের থেকে পৃথক করে ফেলেছে। বস্তুত দুশমন সৃষ্টি ছাড়া আপনারা কিছুই করতে পারেননি। জীবনের এ শেষ লগ্নে আমি আপনাদের প্রতি কল্যাণময় অসিয়ত করছি যে, প্রথমত, দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের যুলুমশাহীর পর খোদাদ্রোহীদের দ্বারা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত এই জনগণ যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠতম সন্তান ও যুবকদের উৎসর্গ করে নিজেদেরকে পাহলভী সরকারের ন্যায় দুর্বৃত্তদের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশ্বগ্রাসী শক্তির কবল থেকে মুক্ত করেছে তখন কেমন করে আপনারা সে সমস্ত জনগণের বিরুদ্ধে লড়ছেন? একজন মানুষের বিবেক- তা যতই কালিমালিপ্ত হোক না কেন কোন সম্ভাব্য পদ হস্তগত কারার আশায় স্বীয় দেশ ও জনগণের সাথে এহেন আচরণ করতে এবং ছোট-বড় কাউকেই রেহাই না দিতে কি করে রাজি হতে পারে? আপনাদের প্রতি আমার নসিহত এ ধরনের অর্থহীন ও বিবেকবিরোধী কাজ বন্ধ করুন। বিশ্বগ্রাসীদের প্রতারণার শিকার হবেন না। আর যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, যদি কোন অপরাধে অংশ না নিয়ে থাকেন তাহলে স্বীয় দেশ ও ইসলামের কোলে ফিরে আসুন এবং তাওবা করুন। কেননা, আল্লাহ তাআলা অতীব দয়াময় ও দয়ালু (আরহামুর রাহিমীন)। এর ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও তার জনগণও ইন শাআল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি কোন অপরাধ সংঘটিত করে থাকেন- যে সম্পর্কে আল্লাহর আইনের ফয়সালা রয়েছে, তাহলেও মাঝপথ থেকেই ফিরে এসে তাওবা করুন। আর যদি সৎসাহস থাকে তাহলে শাস্তি মাথা পেতে নিন। এভাবে নিজেকে আল্লাহ তাআলার কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। নচেৎ যেখানেই থাকুন না কেন জীবনের সময়কে আর অপচয় না করে অন্য কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখুন। কেননা, এতেই আপনাদের কল্যাণ নিহিত। এতঃপর দেশে-বিদেশে অবস্থানরত এদের সমর্থক ও অনুসারীদের উদ্দেশে আমার অসিয়ত- যেসব লোক বিশ্বগ্রাসী শক্তিধরদের সেবায় রত রয়েছে ও তাদেরই পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়িত করে চলছে এবং না জেনে-শুনে তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছে বলে এখন প্রমাণিত হয়েছে, তোমরা কোন্ চিন্তায় তাদের জন্য নিজেদের যৌবনকে বরবাদ করে দিচ্ছ? কার পথে স্বীয় জনগণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? তোমরা তাদের ক্রীড়নক হয়ে আছ। যদি তোমরা ইরানে অবস্থান করে থাক, তাহলে তা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছ যে, কোটি কোটি জনতা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নিষ্ঠাবান সমর্থক। তারা এজন্য আত্মোৎসর্গপ্রাণ। তোমরা স্বচক্ষে অবলোকন করছ যে, বর্তমান হুকুমত ও সরকার প্রাণপণে নিঃস্ব মানবতার খেদমতেই রত রয়েছে। আর যারা জনদরদি, মুজাহিদ বা গণমানুষের জন্য উৎসর্গপ্রাণ (ফেদাইনে খাল্ক) হবার দাবি করছে তারা জনগণের বিরুদ্ধে শত্রুতায় উঠেপড়ে লেগেছে। স্বীয় উদ্দেশ্য ও দুই বিশ্বগ্রাসী শক্তিবলয়ের কোন একটির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে তোমাদের মতো সরলমনা ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। অথচ তারা নিজেরা বিদেশে থেকে দুই অপরাধী শক্তির কোন একটির কোলে আশ্রয় নিয়ে আরাম-আয়েশ ও আনন্দ-আহ্লাদে নিমগ্ন রয়েছে অথবা দেশের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল বালাখানায় থেকে বিলাসী জীবন যাপন করছে এবং হতভাগা অপরাধীদের অপরাধকেন্দ্রসমূহের ন্যায় নিজেদের অপরাধী ততপরতা অব্যাহত রেখেছে। আর তোমাদের ন্যায় যুবকদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
দেশে-বিদেশে অবস্থানরত তোমাদের (তরুণ ও যুবকদের) প্রতি আমার আন্তরিক অসিয়ত- তোমরা ভুল পথ থেকে ফিরে এস। সমাজের বঞ্চিত জনগণ, যারা মনপ্রাণ দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খেদমত করে চলছে তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হও ও স্বাধীন-সার্বভৌম ইরান গড়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাও যাতে দেশ ও জাতি বিরোধীদের অনিষ্ট থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে। সবাই মিলে সম্মানজনক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখ। যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়েই চিন্তা করছে, পরাশক্তিবর্গের কোলে আশ্রয় নিয়ে স্বীয় দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে লড়ছে আর নিজেদের অশুভ লক্ষ্য ও ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য তোমাদেরকে বলি দিচ্ছে- তোমরা আর কতদিন এবং কিসের জন্য ঐসব লোকের আদেশ পালনে সদাপ্রস্তুত থাকবে? ইসলামী বিপ্লবের বিজয় পরবর্তী গত কয়েক বছরে তোমরা অবলোকন করেছ যে, তাদের দাবি, কর্ম ও আচরণসমূহ পরস্পর বিরোধী। তাদের বড় বড় বুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু সরলমনা যুবকদের প্রতারণা করা। আরো অবগত আছ যে, জনগণের দুর্বার প্লাবনের মোকাবেলায় তোমাদের কোন শক্তিই নেই। নিজেদের ক্ষতিসাধন ও জীবনের অপচয় ছাড়া তোমাদের কাজের আর কোন ফলাফল নেই। আমার উপর অর্পিত পথনির্দেশনার দায়িত্বটুকু আমি পালন করলাম। আশা করা যায়, আমার এই নসিহত- যা আমার মৃত্যুর পর তোমাদের নিকট পৌঁছবে তাতে যেহেতু ক্ষমতালিপ্সার কোন গন্ধ নেই, সেহেতু তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং নিজেদেরকে কঠিন খোদায়ী শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে। মহান দয়াময় আল্লাহ তাআলা তোমাদের হেদায়াত করুন এবং সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।
কম্যুনিস্ট ও ফেদাইনে খাল্কের বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠন এবং বামপন্থী অন্যান্য দল-উপদলসহ সকল বামপন্থীর প্রতি আমার অসিয়ত- বিভিন্ন মতাদর্শের সঠিক পর্যালোচনা ব্যতিরেকে এবং বিভিন্ন মতাদর্শ বিশেষ করে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন ব্যতিরেকে কোন্ চিন্তায় আপনারা এমন এক মতাদর্শকে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন যা আজকের বিশ্বে পরাজয়ের গ্লানি বরণ করে নিয়েছে? কি হলো যে, আপনারা এমন কয়েকটি মতবাদ দ্বারা নিজেদের অন্তঃকরণকে পরিতৃপ্ত করলেন- যেসব মতাদর্শের বিষয়বস্তু গবেষক ও বিশ্লেষকদের কাছে আন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়েছে? আর কোন্ চেতনা আপনাদের বাধ্য করেছে যে, যার জন্য নিজেদের দেশকে রাশিয়া বা চীনের কোলে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন? জগগণের প্রতি ভালোবাসার নামে স্বীয় দেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছেন? বহিঃশক্তির স্বার্থে নিজের দেশ ও নিপীড়িত জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছেন? আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, কম্যুনিজমের জন্মলগ্ন থেকেই এর দাবিদাররা বিশ্বের সবচেয়ে বড় একনায়ক, ক্ষমতালোভী ও আত্মকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। জনগণের সমর্থক হবার দাবিদার রাশিয়ার দ্বারা কত জাতি ও জনগোষ্ঠীই না ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছে এবং স্বীয় অস্তিত্ব হারিয়েছে। রুশ মুসলিম ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহ এখনও কম্যুনিস্ট পার্টির নিষ্পেষণের যাঁতাকলে ছটফট করছে। তারা সবরকমের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিশ্বের একনায়ক সরকারসমূহের সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির তুলনায়ও অধিকতর কঠিন ও ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছে। কম্যুনিস্ট পার্টির তথাকথিত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বসমূহের অন্যতম স্টালিনের আগমন-প্রত্যাগমন, আনুষ্ঠানিকতা ও বিলাসিতা আমরা দেখেছি। আর এখন যে আপনারা-যারা প্রতারণার শিকার-রুশ সরকারের জন্য জীবন দিচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই রাশিয়ার মযলুম জনগণ ও তার (রাশিয়ার) উপনিবেশসমূহের, যেমন আফগানিস্তানের জনগণ কম্যুনিস্টদের অত্যাচারে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে, অথচ আপনারা-জনদরদি হবার দাবিদাররা যেখানেই পেরেছেন বঞ্চিত জনতার বিরুদ্ধে কি অপরাধেরই না আশ্রয় নিয়েছেন!
আর আমোলবাসীদেরকে৪ আপনারা নিজেদের কট্টর সমর্থক বলে যে ভিত্তিহীন দাবি করতেন এবং বিভিন্ন প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তাদেরকে জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে দিতেন তাদেরই বিরুদ্ধে কি জঘন্য অপরাধই না সংঘটন করলেন? আপনারা বঞ্চিত জনতার সমর্থক হবার ভুয়া দাবিদার। ইরানের মযলুম ও বঞ্চিত জনগণকে রুশ একনায়কতন্ত্রের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন? আপনারা ফেদাইনে খাল্ক ও বঞ্চিতদের সমর্থকের আবরণে বর্তমানে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। সর্বোপরি তুদেহ পার্টি ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমর্থকের ছদ্মাবরণে ষড়যন্ত্রকারী বন্ধুরা এবং অন্যান্য দল-উপদল সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ ও সশস্ত্র পন্থায় এ কাজে লিপ্ত রয়েছে।
বিভিন্ন নিদর্শন ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বামপন্থী দল-উপদলগুলো হচ্ছে আমেরিকান কম্যুনিস্ট। আপনারা যাঁরা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত, বিভিন্ন দল-উপদল যাঁরা পাশ্চাত্য থেকে বেতন-ভাতা, প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেয়ে থাকেন, যাঁরা স্বায়ত্তশাসন এবং কুর্দি ও বালুচদের সমর্থক হবার ভান করে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন, কুর্দিস্থান ও অন্যান্য এলাকার বঞ্চিত জনতাকে নিশ্চিহ্ন করছেন এবং ঐসব প্রাদেশিক সরকারের সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য, পুনঃনির্মাণ ও অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতায় বাধা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে যেমন ‘কুর্দি গণতান্ত্রিক দল’ ও ‘কুমেলাহ’ দল- আপনাদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনারা জনগণের সাথে যোগ দিন।
এতদিনে নিশ্চয়ই এদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, তারা ঐসব এলাকার অধিবাসীদের জন্য দুর্দশা ডেকে আনা ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারেনি এবং কিছু করতেও সক্ষম হবে না। অতএব, তাদের নিজেদের, নিজ জনগণ ও এলাকার কল্যাণের দাবি হচ্ছে তারা সরকারের প্রচেষ্টার সাথে শরিক হোক। বিদ্রোহ, বহিঃশক্তির গোলামি ও দেশদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকুক। আর দেশ গড়ার কাজে অংশ নিক। তাদের নিশ্চিত থাকা উচিত যে, ইসলামী আদর্শ তাদের জন্য অপরাধী পাশ্চাত্য এবং একনায়কতান্ত্রিক প্রাচ্য শক্তির চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠ। ইসলামই জনগণের মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বোত্তম বাস্তব রূপ।
আর যেসব মুসলিম দল-উপদল ভুলবশত পাশ্চাত্য অথবা প্রাচ্যের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করছে এবং যারা কখনো কখনো মুনাফেকদের সমর্থন করত (ঐসমস্ত মুনাফেকের বিশ্বাসঘাতকতা বর্তমানে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে), যারা ভুলবশত ইসলামের কট্টর দুশমনদের বিরোধিতাকারীদেরকে অভিশাপ দিত, তাদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- তারা যেন নিজেদের ভুলের উপর অবিচল না থাকে, বরং ইসলামী সৎসাহসের সাথে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করে নেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সরকার, মজলিশ ও মযলুম জনগণের সাথে অভিন্ন কণ্ঠ ও অভিন্ন পথাবলম্বী হয়ে ইতিহাসের এই নির্যাতিত মানুষদেরকে নিপীড়কদের দুর্বৃত্তপনা থেকে মুক্ত করে। তারা যেন পবিত্র পথ ও নির্মল চিন্তার অধিকারী নিষ্ঠাবান আলেম মরহুম আয়াতুল্লাহ মুদাররেসের কথা স্মরণ করে, যিনি ততকালীন পরিত্যক্ত মজলিশে বলেছিলেন : ‘এখন আমরা তো ধ্বংস হয়েই যাব, তাহলে নিজেদের হাতে কেন ধ্বংস হব?’ আমিও আজ উক্ত শহীদের স্মরণে আপনাদের মতো ঈমানদার ভাইদের প্রতি নিবেদন করতে চাই, আমরা যদি আমেরিকা ও রাশিয়ার অপরাধী হস্তের দ্বারা জীবনপট থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাই, আর সম্মানের সাথে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় স্বীয় খোদাতাআলার সাথে সাক্ষাত করি, তাহলে তা হবে প্রাচ্যের লাল বাহিনীর পতাকা ও পাশ্চাত্যের কাল পতাকার নিচে বিলাসবহুল ও স্বচ্ছল জীবন যাপনের তুলনায় অধিকতর উত্তম। আর এটাই হচ্ছে মহান আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.), মুসলমানদের ইমামগণ (আ.), বুজুর্গানে দ্বীনের অনুসৃত কর্মপন্থা। আমাদেরকে এই পথ অনুসরণ করতে হবে। নিজেদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, কোন জাতি পরনির্ভরশীলতা থেকে বাঁচতে চাইলে তা সে পারবেই। আর বিশ্বের পরাশক্তিগুলো কোন জাতির উপর সেই জাতির আর্দশের বিপরীত কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। আফগানিস্তান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। সেদেশের জবরদখলকারী সরকার ও অন্যান্য বামপন্থী দল রাশিয়ার সাথে থাকা সত্ত্বেও এখনও তারা সেখানকার জনগণকে দমন করতে সক্ষম হয়নি।
এছাড়া বর্তমান বিশ্বের বঞ্চিত জাতিসমূহ জাগ্রত হয়ে উঠেছে। এই জাগরণ-সংগ্রাম গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবে রূপান্তরিত হতে খুব বেশি দিন লাগবে না, যার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে যালেম-নিপীড়কদের আধিপত্য থেকে মুক্তি দেবে। আর আপনারা-যাঁরা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মুসলমান-এখন দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্কহীনতা তার সুফল প্রদর্শন করছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের চিন্তাশীল মগজগুলো কাজ করতে শুরু করেছে ও আত্মনির্ভরশীলতার পানে এগিয়ে চলছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যপন্থী বিশ্বাসঘাতক বিশেষজ্ঞরা যেসব আমাদের জাতির পক্ষে অসম্ভব বলে প্রদর্শন করত সেগুলো আজ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমাদের জনগণের হাতে ও তাদেরই চিন্তার ফলশ্রুতিতে সম্পাদিত হয়েছে। ইন শাআল্লাহ সুদীর্ঘ মেয়াদে তা সম্পাদিত হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এই বিপ্লব বিলম্বে সংঘটিত হয়েছে। অন্তত মুহাম্মাদ রেযার নোংরা স্বৈরাচারী শাহীশাসনের শুরুতে যদি এ বিপ্লব সংঘটিত হতো তাহলে আজকের এই লুণ্ঠিত ইরান অন্য এক ইরানে পরিণত হতো।
লেখক, বক্তা, বুদ্ধিজীবী ও সমালোচকগণের প্রতি আমার অসিয়ত- ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিপরীত ধারায় সময়ের অপচয় না করে এবং সাধ্যাতীতভাবে মজলিশ, সরকার ও অন্য জনসেবকদের দুর্নাম রটনা, অকল্যাণ কামনা করা ও এসব কাজের মাধ্যমে গোটা দেশটাকে পরাশক্তিবর্গের দিকে ঠেলে দেয়ার পরিবর্তে অন্তত একটি রাত একান্তে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হোন। আর যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী না হয়ে থাকেন, তাহলে স্বীয় বিবেকের মুখোমুখি হোন এবং স্বীয় অন্তঃকরণের গোপন প্রকোষ্ঠনিহিত প্রবণতা-যে সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন-নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখুন। কোন্ মানদণ্ডের ভিত্তিতে, কোন্ ইনসাফ নীতির অনুসরণে রণাঙ্গনে ও বিভিন্ন শহরে এই যুবকদের রক্ত ঝরার বিষয়টি উপেক্ষা করছেন? যে জাতি দেশি-বিদেশি যালেম ও লুটেরাদের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে, আর নিজেদের ও তাদের প্রিয় সন্তানদের জীবনের বিনিময়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে তার হেফাযত করতে চাচ্ছে, কোন্ মানদণ্ডের ভিত্তিতে সে জাতির বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন? তাদের মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন? দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন? যালেম ও নিপীড়কদের জন্য পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন? এটাই কি উত্তম নয় যে, স্বীয় চিন্তা, কণ্ঠ ও লেখনির সাহায্যে সরকার, মজলিশ ও জাতিকে স্বদেশের হেফাযতে পথনির্দেশনা দান করবেন? আর এটাই কি উচিত নয় যে, এই বঞ্চিত-মযলুম জাতিকে সাহায্য করবেন এবং স্বীয় সহযোগিতা দ্বারা ইসলামী হুকুমতের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবেন? আপনারা কি বর্তমান মজলিশ, প্রেসিডেন্ট, সরকার ও বিচার বিভাগকে সাবেক সরকারের আমলের চেয়েও নিকৃষ্টতর মনে করেন? উক্ত অভিশপ্ত সরকারের আমলে এই নিরাশ্রয় মযলুম জাতির উপরে যে নির্যাতন-নিপীড়ন চলত তা কি আপনারা ভুলে গেছেন? আপনারা কি অবগত নন, ঐ যুগে এ দেশটি আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল? আর এর সাথে তারা একটি উপনিবেশের ন্যায় আচরণ করত? মজলিশ থেকে শুরু করে সরকার ও সামরিক বাহিনী তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল? এছাড়া তাদের উপদেষ্টাগণ, শিল্পকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা এ জাতি ও তাদের সম্পদ নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলত তা কি জানেন না? সারাদেশে নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার বিস্তার, প্রমোদকেন্দ্র, জুয়ার আড্ডা, পানশালা, মদের দোকান, সিনেমা ও চরিত্রহানিকর অন্যান্য কেন্দ্র-যার প্রতিটিই ছিল দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার এক একটি বড় হাতিয়ার-এগুলো কি আপনাদের স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে? ঐ সরকারের প্রচারমাধ্যম, অশ্লীল সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকাসমূহের কথা কি একেবারেই ভুলে গেছেন? এখন তো সে দুর্নীতিগুলোর লেশমাত্র নেই। তাথাপি বিভিন্ন বিকৃত ও পথভ্রষ্ট দল-উপদল থেকে অনুপ্রবেশকৃত এবং ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দুর্নাম সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজে লিপ্ত কতিপয় যুবক ও কয়েকটি আদালতকে দেখে আর কতিপয় দুর্নীতিবাজ এবং ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীকে হত্যার কারণে আপনারা হৈ-চৈ করছেন? যারা সুস্পষ্ট ভাষায় ইসলামের নিন্দা করছে, আর তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম অথবা এর চেয়েও দুঃখজনক লেখনি ও বাকযুদ্ধে নেমেছে, আপনারা তাদের সাথেই যোগ দিয়েছেন? তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন? আর আল্লাহ তাআলা যাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে নয়নের মণিরূপে আখ্যায়িত করছেন? যারা ১৪ই ইসফান্দ এর সেই লোমহর্ষক ঘটনার নায়ক, যারা নিরীহ যুবকদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে তাদের পাশে বসে এ লড়াইয়ের দর্শক সেজেছেন? সরকার ও বিচার বিভাগ ইসলামের অন্ধ দুশমন, বিকৃত, পথভ্রষ্ট ও নাস্তিকদেরকে তাদের অপরাধসযজ্ঞের যে উপযুক্ত শাস্তি দিচ্ছে-সেটি একটি ইসলামী কাজ এবং নৈতিক দায়িত্ব পালন বৈ নয়-তা আপনাদের মুখে আর্তচিতকার ও নির্যাতিতের ধ্বনি সৃষ্টি করেছে।
প্রিয় ভাইয়েরা, আপনাদের যাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অবগত আছি এবং যাদের কতককে আমি পছন্দও করি তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তবে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশী সেই দুর্বৃত্তদের জন্য নয়। তারা রাখালবেশে নেকড়েতুল্য। এসব খেলোয়াড় সবাইকে নিয়ে খেলতে ও উপহাসের পাত্রে পরিণত করতে অভ্যস্ত। তারা দেশ, জাতি ও তার সেবকদেরকে দুই লুটেরা শক্তির কোন একটির কোলে ঠেলে দিয়ে ধ্বংস করার লক্ষ্য পোষণ করছে। যারা তাদের নোংরা হাতে দেশের যুবক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং সমাজের শিক্ষক ওলামায়ে কেরামকে শহীদ করছে। এমনকি তারা মযলুম মুসলিম শিশুদের পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। এরা সমাজের কাছে নিজেদেরকে অপমানিত করে ফেলেছে, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে লাঞ্ছিত করেছে। এদের প্রত্যাবর্তনের আর কোন পথ নেই। শয়তানি নাফ্সে আম্মারা এদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।
প্রিয় মুমিন ভাইয়েরা, আপনারা কেন্ বঞ্চিত মযলুম ও সর্বহারা জনগণের, যারা জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের খেদমতে প্রচেষ্টারত সরকার ও মজলিশের সাথে সহযোগিতা করছেন না? অথচ অভিযোগ করছেন? এতসব সমস্যা-সংকট যা যে কোন বিপ্লবের সাথেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং এতো বিরাট ক্ষয়ক্ষতিসহ চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও দেশি-বিদেশি কয়েক লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ আর সীমাহীন নাশকতা সত্ত্বেও এ সংক্ষিপ্ত সময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী সরকার ও তার দেশের বিভিন্ন সংস্থা যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে, সাবেক সরকারের আমলে সম্পাদিত উন্নয়ন ততপরতার সাথে তার তুলনা করে দেখেছেন কি? আপনাদের কি জানা নেই যে, সে যুগের উন্নয়ন ততপরতা বলতে গেলে শুধু শহরগুলোতেই আর তা ধনী এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল? দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগণ তা থেকে অতি সামান্যই লাভবান হতো অথবা আদৌ লাভবান হতো না। অথচ বর্তমান সরকার ও ইসলামী সংস্থাসমূহ মনপ্রাণ দিয়ে সমাজের এই বঞ্চিত শ্রেণির খেদমত করে যাচ্ছে। প্রিয় মুমিন ভাইয়েরা, আপনারাও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করুন যাতে এসব কাজ আরও দ্রুতগতিতে এগিয় যেতে পারে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মহান প্রভু আল্লাহ তাআলার কাছে আপনাদেরকে ফিরে যেতে হবেই। তাঁর বান্দাদের খেদমতের চিহ্ন সহকারে তাঁর দরবারে উপস্থিত হোন। (এই বাদ দেয়া অংশটুকু আমি নিজেই আঞ্জাম দিয়েছি) ।৫
ণ. উপদেশমূলক ও স্মরণযোগ্য আর একটি অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে, ইসলাম অত্যাচারপূর্ণ, অবাধ ও বল্গাহীনভাবে সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং মযুলম-নিপীড়ত জনতাকে বঞ্চনার কবলে নিক্ষেপকারী পুঁজিবাদের সমর্থক নয়; বরং কোরআন ও সুন্নায় দৃঢ়তার সাথে এর বিরোধিতা করা হয়েছে এবং একে সামাজিক সুবিচারের পরিপন্থী বলে গণ্য করা হয়েছে। যদিও ইসলামী রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা ও ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ বক্রচিন্তার অধিকারী কিছু লোক তাদের কথা ও লেখনির মাধ্যমে যা বুঝাতে চেয়েছে (এখনও তারা একাজ থেকে বিরত হয়নি) তা হচ্ছে, ইসলাম অবাধ পুঁজিবাদ ও মালিকানার সমর্থক। এভাবে তারা স্বীয় বক্রচিন্তার কারণে ইসলামের এ অর্থ গ্রহণ করে ইসলামের উজ্জ্বল চেহারাকে আবৃত করে দিয়েছে। ইসলামের দুশমন মতলববাজদের জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে আঘাত হানার পথ খুলে দিয়েছে। এর ফলে শত্রুরা ইসলামকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যেমন আমেরিকা, ব্রিটেন ও অন্যান্য লুটেরা ব্যবস্থার অনুরূপ বলে গণ্য করতে পারছে। এই অজ্ঞদের কথার উপর ভিত্তি করে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই হোক আর অজ্ঞতাবশতই হোক, প্রকৃত ইসলামী বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা ব্যতিরেকেই ইসলামের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে ইসলাম মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, কম্যুনিস্ট ব্যবস্থারও অনুরূপ নয়। যে ব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানার বিরোধী, কিন্তু যৌথ মালিকানার প্রবক্তা, যে মতবাদে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহু মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি নারীর উপর যৌথ অধিকার ও সমকামিতার অধিকারের কথা পর্যন্ত বলা হয়েছে। আর সেই সাথে রয়েছে এক কঠোর স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের কথা।
এ দুয়ের বিপরীতে ইসলামে রয়েছে এক ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সীমিত পর্যায়ে তার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। এ ব্যবস্থায় মালিকানা সৃষ্টি, সম্পদের ভোগ-ব্যবহার- যা সঠিক পন্থায় হলে সুস্থ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করবে, একটি স্থিতিশীল সরকারের জন্য অপরিহার্য সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও কতিপয় বক্র চিন্তার অধিকারী এবং ইসলামের সুস্থ অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ উপরিউক্ত প্রথম দলের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা কোরআন মজিদের কিছু আয়াত অথবা নাহজুল বালাগার কতিপয় বাক্যের আশ্রয় নিয়ে ইসলামকে মার্ক্স ও অনুরূপ অন্যান্য ব্যক্তির উপস্থাপিত বিকৃত পথভ্রষ্ট আদর্শের সমর্থক বলে দাবি করে থাকে। এরা কোরআন পাকের অন্যান্য আয়াত ও নাহজুল বালাগার অন্যান্য অংশের প্রতি দৃষ্টি না দিয়েই নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ অনুধাবন ক্ষমতার ভিত্তিতেই দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করছে ও যৌথ তত্ত্বের৬ মতবাদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মাঝে নিহিত কুফ্রী, একনায়কতন্ত্র ও শ্বাসরুদ্ধকর আত্মকেন্দ্রিক ব্যবস্থা যা সমগ্র মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে, সেসবকে এড়িয়ে সাধারণ জনগণের সাথে পশুসুলভ আচরণকারী একটি সংখ্যালঘু দলের শাসনের সমর্থন করছে।
মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামী, অভিভাবক পরিষদ, সরকার, প্রেসিডেন্ট ও বিচার পরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকামের সামনে বিনয়াবনত ও অনুগত থাকুন। আর যালেম লুটেরা পুঁজিবাদী ব্লক এবং নাস্তিক্যবাদী সামজতন্ত্র ও কম্যুনিস্ট ব্লকের অন্তঃসারশূন্য প্রচারণায় প্রভাবিত হবেন না। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ব্যক্তিমালিকানা ও পুঁজির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। জগগণকে নিশ্চিন্ত করুন যাতে তারা গঠনমূলক পুঁজি ও শ্রমততপরতাকে কাজে লাগায় এবং হাল্কা ও ভারী শিল্পে দেশ ও সরকারেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভরতায় উপনীত করে। আর বৈধ অর্থ-সম্পদের অধিকারীদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন তাঁদের বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদকে কাজে খাটান এবং কৃষি ক্ষেত্রে, গ্রামাঞ্চল ও কলকারখানায় গঠনমূলক ততপরতায় সচেষ্ট হন। কারণ, এটি একটি মূল্যবান ইবাদত।
আর সবাইকে বঞ্চিত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হওয়ার জন্য অসিয়ত করছি। কেননা, তাদের সেবায় আত্মনিয়োগের মাঝেই ইহ ও পরকালের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তারা যালেমশাহী ও জমিদারদের দীর্ঘ শাসনামলে চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কতই না উত্তম কাজ হতো যদি সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছিন্নমূল বস্তিবাসীদের জন্য বাড়িঘরের ব্যবস্থা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতো। আপনারা নিশ্চতভাবে জেনে রাখুন যে, ইহ ও পরকালের কল্যাণ এতেই নিহিত রয়েছে। আর এটা আদৌ ইনসাফসম্মত নয় যে, কেউ গৃহহীন থাকবে, আর কেউ অনেক ঘরবাড়ির মালিক হবে।
ত. সেই সকল আলেম ও আলেম বেশধারী যাঁরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও এর প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরোধিতা করছেন, এর উৎখাতে নিজেদের সময় ও শ্রম ব্যয় করছেন, সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী ও রাজনৈতিক চালবাজদের সাহায্য করছেন, এমনকি যেরূপ বলতে শোনা যায়, একাজে তারা খোদাবিমুখ পুঁজিপতিদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ গ্রহণ করছেন এবং তার বিনিময়ে তাদেরকে ব্যাপক সহযোগিতা প্রদান করছেন, তাঁদের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনারা এই ভ্রান্ত কর্মকাণ্ডগুলো পরিত্যাগ করুন যা এখনও পরিত্যাগ করেননি এবং এরপরও ত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না। আপনারা যদি পার্থিব স্বার্থে এ কাজে হাত বাড়িয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে এ ঘৃণ্য লক্ষ্যে উপনীত হবার কোন সুযোগই যেন না দেন। এটাই উত্তম যে, তাওবার দুয়ার খোলা থাকতেই তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। মযলুম অসহায় জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করুন। জনগণের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি আপনাদের সমর্থন ঘোষণা করুন। কারণ, এতেই আপনাদের ইহ ও পরকালের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যদিও আমি মনে করি না যে, আপনারা তাওবা করতে সমর্থ হবেন। অপরদিকে, আলেমদের যে অংশটি বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইসলামী অনুশাসনের বিপরীত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি ও অপরাধযজ্ঞ দেখে স্বয়ং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও তার সরকারের তীব্র বিরোধিতায় মেতে ওঠেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অজর্নের আশায় এ সরকার উৎখাতে অংশ নিচ্ছেন, আর নিজেদের কল্পিত ধারণা অনুযায়ী এ ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে শাহী ব্যবস্থার চেয়েও নিকৃষ্টতর বা তার অনুরূপ বলে মনে করছেন, তাঁদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন এ ব্যাপারে একান্তে বসে গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং ন্যায়নীতি সহকারে সাবেক সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের তুলনা করেন। আর সেই সাথে এ বিষয়টির প্রতিও লক্ষ্য রাখবেন যে, বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, ভুল-ভ্রান্তি, দোষ-ত্রুটি ও সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্য ছিল এক অনিবার্য ও অপরিহার্য বিষয়। আপনারা যদি উক্ত বিষয়টি স্মরণ রাখেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র যেসব সমস্যার মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন, তাহলে দেখতে পাবেন এসবের মধ্যে রয়েছে ষড়যন্ত্র, মিথ্যা প্রচারণা, সীমান্তের অভ্যন্তরে ও বাইরে সশস্ত্র হামলা, ইসলাম ও ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে জনগণকে অসন্তুষ্ট করে তোলার লক্ষ্যে সকল সরকারি সংস্থায় দুর্নীতিপরায়ণ ও ইসলামবিরোধী উপদলসমূহের পক্ষ থেকে অপ্রতিরোধ্য অনুপ্রবেশ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অধিকাংশেরই কিংবা অনেকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা, পুঞ্জিভূত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের ভোগ ব্যবহারে সুযোগ থেকে বঞ্চিত অথবা এর সুযোগ কম পাচ্ছে এমন ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে মিথ্যা গুজব রটনা ও প্রচার, ইসলামী বিচারকদের সংখ্যাল্পতা, মেরুদণ্ড ভঙ্গকারী অর্থনৈতিক সমস্যাবলি, কয়েক লক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা ও সংস্কার সাধনের পথে বিরাট বিরাট সমস্যা, সৎ ও যোগ্য কর্মক্ষম লোকের অভাব এবং এরূপ আরো ডজন ডজন সমস্যা- যে সম্পর্কে এর অভ্যন্তরে প্রবেশ ব্যতীত বোঝা অসম্ভব। এর পাশাপাশি রয়েছে মতলববাজ ও আধিপত্যবাদী বিপুল অর্থের মালিকেরা- যারা সুদ, মুনাফাখোরী, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, নাভিশ্বাস সৃষ্টিকারী উচ্চমূল্যে বিক্রি, চোরাচালান, মজুদদারী ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের অসহায় ও বঞ্চিত জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলছে এবং সমাজে অনাচার সৃষ্টি করছে। এরাই আবার আপনাদের সামনে গিয়ে প্রতারণামূলক অভিযোগ করে থাকে। অনেক সময় নিজেদেরকে নিষ্ঠাবান মুসলমান বলে দেখানো ও তাদের কথা আপনাদের বিশ্বাস করানোর লক্ষ্যে খোমসের৭ নামে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করে এবং কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে আপনাদেরকে ব্যথিত ও অসন্তুষ্ট করে তুলে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতায় অনুপ্রাণিত করে। অথচ এদের অনেকেই অবৈধভাবে জনগণের রক্ত শোষণ করছে এবং দেশের অর্থনীতিক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সম্মানিত আলেমদের প্রতি আমার বিনীত ও ভ্রাতৃসুলভ নসিহত- তাঁরা যেন এ ধরনের তৈরি গুজবের দ্বারা প্রভাবিত না হন। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও ইসলামের হেফাযতের উদ্দেশ্যে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী করুন। আর তাঁরা যেন মনে রাখেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের যদি পতন ঘটে তাহলে তার পরিবর্তে হযরত ইমাম মাহদী (আ.) (আমার আত্মা তাঁর জন্য উৎসর্গিত)-এর পছন্দনীয় কোনো ইসলামী সরকার অথবা আপনাদের পরিচালনাধীন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং বিশ্বের দুই শক্তিবলয়ের কোনো একটির ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার ক্ষমতাসীন হবে। আর তাহলে বিশ্বের বঞ্চিত জনগণ- যারা ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তারা হতাশাগ্রস্ত হবে, ইসলাম চিরদিনের তরে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এমন একদিন আসবে যখন আপনারা স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবেন, যখন আপনাদের অতীত কর্ম ও অনুতাপ কোনটিই কাজে আসবে না।
আপনারা যদি এই আশা করে থাকেন যে, রাতারাতিই সবকিছু ইসলাম এবং আল্লাহ তাআলার আহকাম অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে যাবে তাহলে বিরাট ভুল করবেন। কেননা, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে কখনই এহেন অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়নি এবং হবে না। আর ইন শাআল্লাহ যেদিন বিশ্ব সংস্কারক (ইমাম মাহদী আ.) আত্মপ্রকাশ করবেন, মনে করবেন না যে, সেদিন এক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হবে। আর একদিনের মধ্যেই সারা বিশ্বের সংশোধনী ও সংস্কার সাধিত হবে। বরং বহু চেষ্টা-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই যালেম-নিপীড়কদের পতন ঘটানো ও তাদেরকে কোণঠাসা করা সম্ভব হবে। আর আপনাদের ধারণা যদি সেই অজ্ঞ-মূর্খ ও পথভ্রষ্ট লোকদের অনুরূপ হয়ে থাকে, যারা মনে করে উক্ত মহিমান্বিত ব্যক্তির আগমনের জন্য কুফরী ও যুলুম প্রবর্তনের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সারা বিশ্ব যুলুম-অত্যাচারে ভরপুর হয়ে যায় ও তাঁর আবির্ভবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তাহলে শুধু বলব, ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’।
থ. বিশ্বের সকল মুসলমান ও নির্যাতিত জনগণের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনাদের স্ব-স্ব দেশের শাসকবর্গ ও কর্তাব্যক্তিরা বা বিদেশি শক্তিবর্গ নিজেরা এসে আপনাদেরকে মুক্তি ও স্বাধীনতা উপহার দেবে- এ আশায় বসে থাকবেন না। আমরা ও আপনারা অন্তত বিগত একশ’ বছরের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেছি বা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে তা অধ্যয়ন করেছি, যে সময়টিতে বিশ্বগ্রাসী বৃহৎ শক্তিবর্গ পর্যায়ক্রমে সকল মুসলিম দেশে এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছিল। তৎকালীন সময়ের এসব দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি সরকারও নিজ দেশের জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা ও কল্যাণ নিয়ে মাথা ঘামাতো না এবং এখনও নয়; বরং অধিকাংশ সরকার, বলা যায় প্রায় সকলেই জনগণের ওপর যুলুম-নির্যাতন ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল, আর যা কিছু করেছিল তা ছিল শুধু ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীবিশেষ অথবা প্রাসাদ-অট্টালিকার বিলাসী শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের স্বার্থেই। অন্যদিকে ছিন্নমূল বস্তিবাসী মযলুম শ্রেণি তাদের জীবন ধারণের সব রকম উপকরণ, এমনকি পানি, রুটি ও কোনমতে বেঁচে থাকার শক্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। এই হতভাগাদেরকে বিলাসী ধনীক শ্রেণির স্বার্থে কাজে লাগানো হয়। আর বৃহত শক্তিবর্গের হাতের পুতুলরা স্ব-স্ব দেশ ও জনগণকে ঐসব শক্তির তাঁবেদারে পরিণত করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে স্ব-স্ব দেশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অবাধ বাজারে পরিণত করেছে। এর ফলে শুধু তাদের স্বার্থই নিশ্চিত হয়েছে। তারা জতিসমূহের পশ্চাদপদতা ও বিলাসভোগিতার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। আর এখনো তারা এসব পরিকল্পনা সহকারেই অগ্রসর হচ্ছে।
হে বিশ্বের নির্যাতিত (মুস্তাযাফ) জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ!! হে বিশ্বের মুসলমানগণ!!! উঠে দাঁড়ান, সত্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং পরাশক্তিবর্গ ও তাদের পদলেহী দালালদের প্রচারণামূলক হৈ-চৈ এ ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না। আর অপরাধী শাসকগোষ্ঠী আপনাদের কষ্টার্জিত সম্পদকে আপনাদের ও ইসলামের দুশমনদের হাতে তুলে দেয়ার কারণে তাদেরকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করুন। আপনারা নিজেরাই এবং নিষ্ঠাবান জনসেবকগণ দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করুন। আর সবাই ইসলামের গৌরবময় পতাকাতলে সমবেত হয়ে ইসলাম ও বিশ্বে বঞ্চিত জনগণের দুশমনদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় উঠে দাঁড়ান এবং এক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান- যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আপনারা বিশ্বের সমস্ত দাম্ভিক পরাশক্তির আধিপত্যকে খর্ব করে দিতে আর মুস্তাযাফ জনগণকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করতে ও ধরণীর উত্তরাধিকারিতে পরিণত করতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রতিশ্রুত সে দিবসের প্রতীক্ষায় রইলাম।
দ. অত্র অসিয়তনামার শেষ পর্যায়ে এসে পুনরায় সম্মানিত ইরানী জাতির উদ্দেশে অসিয়ত করছি- এ বিশ্বে দুঃখ-কষ্টকে সয়ে নেয়া শ্রমসাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বঞ্চনার ব্যাপকতা এর বিরাট লক্ষ্য, মর্যাদা ও চরম উতকর্ষের ব্যাপকতারই অনিবার্য দাবি। হে সম্মানিত ও মুজাহিদ ইরানী জাতি! আপনারা যে জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং যার পেছনে এখনও চলছেন, যার জন্য জানমাল কোরবান করে দিচ্ছেন তা হচ্ছে সৃষ্টি শুরুর পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকে শুরু করে সৃষ্টি শুরুর পরবর্তী অনন্তকাল পর্যন্ত উপস্থাপিত ও উপস্থাপিতব্য লক্ষ্যস্থল ও লক্ষ্যবস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ, সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সর্বাধিক মূল্যবান লক্ষ্যস্থল ও লক্ষ্যবস্তু। আর এটা ব্যাপকতম অর্থে খোদীয় এক আদর্শ এবং তার সকল সমুন্নত দিক সহকারে এক তাওহিদী মতাদর্শ- যার বৈশিষ্ট্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য সুবিশাল সৃষ্টিলোক এবং প্রকাশ্য ও গুপ্তজগতের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত। এ আদর্শ তার সর্বস্তর ও সর্বপর্যায়ে সকল দিক পূর্ণাঙ্গ তাতপর্য সহকারে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শে প্রকাশ লাভ করেছে। মহান নবী-রাসূলগণ (আ.) ও সম্মানিত আল্লাহর অলিগণ (তাঁদের সকলের ওপরে সালাম) সকলেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। আর এ আদর্শ ব্যতীত পরম পূর্ণতা এবং সীমাহীন মহিমা ও সৌন্দর্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা, এ আদর্শ মাটির মানুষকে অতীন্দ্রিয় জগতের অধিবাসীদের ওপর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে। এ আদর্শ অনুসরণের ফলে মৃত্তিকাবাসীর পক্ষে যা অর্জন করা সম্ভব সমগ্র সৃষ্টিলোকের প্রকাশ্য ও গুপ্ত কোন সৃষ্টির পক্ষেই তা সম্ভব নয়।
হে মুজাহিদগণ! আপনারা এমন এক পাতাকাতলে সমবেত হচ্ছেন যা সমগ্র বস্তু ও আধ্যাত্মিক জগতে উড্ডীন রয়েছে। সফল হোন বা না-ই হোন, আপনারা এমন এক পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন যা নবী রাসূলদের (আ.) একমাত্র পথ, চরম ও পরম সৌভাগ্যের অদ্বিতীয় পথ। এ পথে আল্লাহর প্রিয় বন্ধুগণ শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেন এবং রক্তাক্ত মৃত্যুকে মধুর চেয়েও সুমিষ্ট গণ্য করেন। আর আপনাদের যুবকরা রণাঙ্গনগুলোতে এ থেকে শুধু এক চুমুকই পান করেছে। ফলে মহাশক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। তাদের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের মাঝেও এ শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাই যথার্থই বলতে হয়-
يا ليتنا كنّا معكم فنفوز فوزاً عظيماً
হায়! আমরাও যদি তোমাদের সাথে থাকতাম তাহলে আমরাও বিরাট সাফল্যের অধিকারী হতাম!
হৃদয় আপ্লুতকারী বসন্ত সমীরণ ও তার চাঞ্চল্যকর বহিঃপ্রকাশ তাদের জন্য উপভোগ্য হোক!!
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই চাঞ্চল্যকর বহিঃপ্রকাশের একটি দিক সেই রৌদ্রতপ্ত উন্মুক্ত মাঠের কৃষিকাজে, উতপাদনক্ষম কলকারখানাগুলোতে, আবিষ্কার-উদ্ভাবন কেন্দ্রসমূহে এবং হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে ও গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ জনসাধারণের মাঝে, আর যারা ইসলাম, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও দেশের অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এসব কাজের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাঁদের সকলের মাঝেই প্রকাশিত। সমাজে যতদিন এ সহযোগিতা ও নিষ্ঠার মনোভাব বহাল থাকবে ততদিন এদেশ কালের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে ইন শাআল্লাহ। আর আল্লাহর রহমতে দীনী শিক্ষাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের যুবসমাজ এ গায়েবী খোদায়ী উপঢৌকনের অধিকারী। এই কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি তাদেরই করতলগত। আর আল্লাহর রহমতে এদের ওপর থেকে নাশকতা ও বিকৃতির নায়কদের নিয়ন্ত্রণের বিলুপ্তি ঘটেছে।
সকলের প্রতি আমার অন্তিম আবেদন, সদাসর্বদা আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রেখে নিজকে চেনা এবং সকল ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায়ক হবেন। আপনারা যদি সর্বদা আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে ইসলামী রাষ্ট্রের উন্নিত ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবকে ধরে রাখেন, আর আমি যেভাবে প্রিয় দেশবাসীর মাঝে জাগরণ, সতর্কতা, একনিষ্ঠতা, আত্মোৎসর্গ-মনোভাব, প্রতিরোধ চেতনা ও দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছি তারই ভিত্তিতে এ আশা পোষণ করছি, আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহে এ মানবিক ভাবধারা বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকবে। এমনকি পরবর্তী বংশধরদের মাঝে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
প্রশান্ত হৃদয়, পরিতৃপ্ত অন্তঃকরণ, আনন্দিত আত্মা ও আশাভরা মন নিয়ে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় ভ্রাতা ও ভগ্নীদের খেদমত থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং চিরন্তন আবাসপানে যাত্রা করছি। আর এ ক্ষেত্রে আপনাদের দোয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করছি। অসীম দয়াময় ও দয়ালু আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন খেদমতের ভুলত্রুটির ক্ষেত্রে আমার ওজরসমূহ কবুল করেন। আর আশা করছি, জনগণও আমার ভুলত্রুটির ওজরসমূহ কবুল করে নিবেন। আপনারা শক্তিমত্তা ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সহকারে সম্মুখপানে এগিয়ে যান। সবাই যেন মনে রাখেন, একজন খাদেমের প্রস্থানের ফলে এ জাতির ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় কোনো ফাটল দেখা দেবে না। কেননা, মহা সম্মানিত খাদেমগণ এ জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছেন। আল্লাহই এ জাতি ও বিশ্ব মযলুমদের রক্ষাকর্তা।
السلام عليكم و على عباد الله الصالحين و رحمت الله و بركاته
আপনাদের ওপর সালাম। আরো সালাম আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর এবং তাঁর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।
২৬শে বাহমান, ১৩৬১ সন, পহেলা জমাদিউল আউয়াল ১৪০৩ হিজরি।
রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।
মহান প্রভু আল্লাহর নামে
আমার মৃত্যুর পর এই অসিয়তনামা আহমদ খোমেইনী জনগণকে পড়ে শোনাবেন। যদি তিনি না পারেন তাহলে সম্মানিত রাষ্ট্রপতি অথবা সম্মানিত মজলিশ স্পিকার অথবা সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত প্রধান বিচারপতি এই কষ্টটুকু বরণ করবেন। আর তাঁরাও যদি অক্ষম হন তাহলে সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের কোনো ফকিহ এই কষ্টটুকু কবুল করবেন।
রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।
মহান প্রভু আল্লাহর নামে
ভূমিকাসহ ২৯ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এই অসিয়তনামা শেষে কয়েকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই :
১. এখন আমার জীবিতাবস্থাতেই আমার নামে অনেক অবাস্তব কথা বলা হচ্ছে। সম্ভবত আমার মৃত্যুর পর এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে বলতে চাই, আমার কণ্ঠ ও বিশেষজ্ঞগণ বা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের টেলিভিশনের সত্যায়ন অনুযায়ী আমার হস্তাক্ষর ও স্বাক্ষর দ্বারা যা আমার বক্তব্যরূপে প্রমাণিত হবে তার বাইরে আমার নামে যা কিছু বলা হচ্ছে তা সবই মিথ্যা।
২. আমার জীবদ্দশায়ই কিছু লোক দাবি করছে যে, তারা আমার বিভিন্ন বিবৃতি লিখে দিয়েছিলেন। আমি এ দাবি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করছি, কেননা, এ পর্যন্ত কোন বিবৃতিই আমি নিজে ছাড়া অন্য কেউ লিখে দেয়নি।
৩. উপরিউক্ত দাবিসমূহের পাশাপাশি কেউ কেউ দাবি করছেন যে, আমি তাঁদের সহায়তায় প্যারিসে গমন করেছিলাম। এটা একটা মিথ্যা কথা। আমাকে কুয়েত থেকে ফেরত দেবার পর আহমদ (খোমেইনীর)-এর পরামর্শক্রমে গন্তব্যস্থল হিসেবে প্যারিসকে বেছে নেই। কারণ, মুসলিম দেশসমূহে প্রবেশের সুযোগ না দেয়ারই সম্ভাবনা ছিল। তাদের ওপর শাহের প্রভাব ছিল। কিন্তু প্যারিসে সে সম্ভবনা ছিল না।
৪. আন্দোলন ও বিপ্লবের এই দীর্ঘ সময় আমি কিছু লোকের প্রতারণাময় বাহ্যিকতা ও ইসলামী বেশের কারণে তাদের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি, আমি তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছি। ঐসব প্রশংসা তখনই হয়েছে যখন তারা নিজেদেরকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক রূপে প্রদর্শন করেছে। অতএব, এসব কিছুর অপব্যবহার করা উচিত হবে না; বরং প্রত্যেককে তার বর্তমান অবস্থা দ্বারাই বিচার করতে হবে।
রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।
টীকা
১. উপরে উদ্ধৃত বাণীটি নবীপাক (সা.)-এর একটি হাদীস। এটি একটি বিখ্যাত হাদীস। এটি ‘হাদীসে সাকলাইন’ নামে সুপরিচিত, যা বহু নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। দেখুন : সহিহ্ তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৩৮৭৪, সহিহ্ মুসলিম, ২য় খণ্ড, মুসনাদে আহমদ, ৩য় খণ্ড, নাসাঈ শরীফ, কানযুল উম্মাল, ১ম খণ্ড, তাফসীর ইবনে কাছির, ৪র্থ খণ্ড, মিশকাতুল মাছাহিব, ৩য় খণ্ড, তাফসীর আল কাবীর, ফখরুদ্দিন রাযী, ৩য় খণ্ড।
২. যাঁরা জনগণের সকল দ্বীনী কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীল। যাঁরা আলেমসমাজের সর্বোচ্চ স্তরের ব্যক্তিত্ব। দ্বীনী মাদ্রাসাগুলোতে সর্বোচ্চ শিক্ষালাভের পর তাঁরা নিজেরা অব্যাহতভাবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করে জনগণের দৈনন্দিন জীবন থেকে সর্বস্তরের মসলা-মাসায়েলের উত্তর দিয়ে থাকেন।
৩. ইরানে ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয় ১৯৭৯ সালে। আর ইমাম খোমেইনী (রহ.) এই অসিয়তনামা লেখেন ১৯৮২ সালে।
৪. উত্তর ইরানের একটি শহরের নাম
৫. এই বাক্যটি ইমাম অত্র পৃষ্ঠার শেষে উল্লেখ করেছেন বিধায় আমরাও উল্লেখ করলাম।
৬. যৌথমালিকানার ভিত্তিতে যে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত।
৭. খোমসের শাব্দিক অর্থ এক পঞ্চমাংশ। ইসলামী পরিভাষায় বাৎসরিক ব্যয়ের পর অবশিষ্ট থেকে এক পঞ্চমাংশ অর্থ বা অন্যান্য সকল কিছু (ব্যবহারিক জিনিস ছাড়া) আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা.) এবং এর পরে তাঁর আহলে বাইতের নিকট অর্পণ করাকে খোমস বলে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অসিয়তনামা | |