ওমর খৈয়াম ও তার রুবাইয়াৎ
মুজতাহিদ ফারুকী
ওমর খৈয়ামের পুরো নাম গিয়াস উদ্দীন আবুল ফাতাহ ওমর ইবনে খৈয়াম নিশাপুরি। তাকে খাইয়ামী, খাইয়াম নিশাপুরি ও খাইয়ামী নিশাপুরি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। বলা হয়, তিনি ১৭ মে ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দে (আনুমানিক) ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও কবি হিসেবে চিরস্মরণীয় ওমর খৈয়ামের জন্ম ও মৃত্যুর নির্দিষ্ট তারিখ কারও জানা নেই। বেশিরভাগ ইউরোপীয়ান লেখক বলেছেন, খৈয়ামের মৃত্যু হয় ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে। কেউ কেউ বলেছেন ১১৪১ খ্রিস্টাব্দ। যাই হোক, ১০৪৮ থেকে ১১৪১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন ওমর খৈয়াম। তিনি মধ্যবয়সে ইমাম মুয়াফফাক নিশাপুরির কাছে ফিকাহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এ সময়ে তিনি হাদীস, তাফসীর, দর্শন, হিকমত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি সরাসরি গ্রিক ভাষা থেকে দর্শনশাস্ত্র আয়ত্ত করেন বলে কথিত আছে।
বর্ণিত আছে যে, উমর খৈয়ামের শিক্ষকতা বা গ্রন্থ রচনার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ ছিল না। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে, তেমন উপযুক্ত বিচক্ষণ শিক্ষার্থী তিনি খুঁজে পাননি। আবার এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়। তাঁর সময়কালটি ছিল সালজুকী বংশের রাজত্বকাল। আর সালজুকীরা দর্শনের প্রচণ্ড বিরোধী ছিল। সে জন্যে ওমর খৈয়াম সময়টিকে তাঁর মুক্ত ও সমুন্নত চিন্তাধারার প্রকাশের উপযোগী মনে করেননি। এরপরও তাঁর বেশ কিছু রচনা পাওয়া যায় যেগুলো মধ্যযুগে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপীয় বিদ্যৎসমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। খৈয়ামের রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মীযানুল হিকমত, লাওয়াযেমুল আমকানাত, নওরোযনামা, জাবার ও মোকাবিলা (অ্যালজেব্রা), রেসালা ফী শারহে মা আশকালা মিন মুসাদেরাতে ইকলিদুস, রিসালা মুশকিলাতুল হিসাব ইত্যাদি।
অ্যালজেব্রা সম্পর্কে তাঁর রেসালা এবং আরো কিছু পুস্তিকায় তিনি জ্যামিতির নানা জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এই রচনাটি তাঁর বিখ্যাত গাণিতিক রচনার একটি। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপরও তাঁর প্রচুর লেখালেখি আছে। সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় এসব রচনা লিপিবদ্ধ করেন।
ওমর খৈয়ামের কবিতার বৈশিষ্ট্য
খৈয়ামের কবিতা মূলত রুবাই যা চতুষ্পদী ও ছোট আকারের কবিতা। একেবারে সাদামাঠা ভাষায় লেখা হলেও এগুলি ছিলো বিশাল সৃষ্টিজগতের অনন্ত রহস্য সম্পর্কে চিন্তাশীলতা ও গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ।
ওমর খৈয়ামের জীবন দর্শনের অন্যতম কথা হচ্ছে ‘যা হয় হোক’। তাঁর রুবাইয়াতের প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে নানা সমস্যার মোকাবিলায় নির্বিকার থাকা ও জীবনকে উপভোগ করার আহ্বান। শরাব, মদ্যপান ও সময়-সুযোগকে উপভোগ করা সম্পর্কিত তাঁর বাচনিক অভিব্যক্তিকে অনেকে আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করেছেন। ফলে অনেকের মনে খৈয়াম একজন বল্গাহীন, মদ্যপ, ভোগবাদী জীবনের অভিলাষী বলে একটি বিরূপ চিত্র ফুটে ওঠে। অথচ বাস্তব সত্য ওই চিত্রের সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
এ বিষয়ে একজন ইরানি বিশ্লেষক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা এরকম:
‘মেয়’ বা মদ ফারসি সাহিত্যে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা রূপক বা প্রতীকী অর্থে মেয়-এর ব্যবহার করেছেন ব্যাপকভাবে। পূর্ববর্তী কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় মেয় অর্থ মদ নয়; বরং এটি এক বিমূর্ত ভাবধারা, যা কবিতার ভাষায় সৌন্দর্য আরোপ ও নান্দনিকতার বলয় তৈরির জন্য তাঁরা ব্যবহার করেন। কবি নিজামী গাঞ্জাবী তাঁর শরফনামা (ইসকান্দারনামার প্রথমার্ধ্ব) কাব্যে বলেন,
‘হে খিজির! মনে করো না আমার উচ্চারণে
মেয় (মদ) বলতে আমার উদ্দেশ্য শরাব বুঝানো
মেয় বলতে আমি আত্মহারা অবস্থা বুঝাতে চাই
সেই আত্মহারা অবস্থা দিয়ে জলশা আসর সাজাই।
আমার মদিরা পরিবেশক (সাকী) তো খোদায়ী প্রতিশ্রুতি
মদিরার নষ্টামির চুমুক তো আত্মহারা মত্ততা,
নচেত খোদার কসম যতদিন থেকে বেঁচে আছি
কখনোই মদিরায় কলুষিত করিনি আমার ঠোঁট দুটি।
যদি মদের চুমুকে রসনা কখনো কলুষিত করি
আল্লাহর যত হালাল, হারাম হবে আমার ওপর।’
এথেকে বোঝা যায়, শুরা বা মদ এবং মদের নেশায় মত্ত হওয়ার প্রসঙ্গটি কোনওভাবেই আক্ষরিক অর্থে নেয়ার সুযোগ নেই। বরং এটিকে একটি ভাবগত মানসিক তুড়িয়লোকে অবস্থিতির রূপক হিসাবেই বিবেচনায় নিতে হবে।
এই রূপকের আশ্রয়েই কবি ওমর খৈয়াম তাঁর কবিতার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে মনের প্রফুল্লতা আর জীবন উপভোগের মাধ্যমে উপস্থিত মুহূর্তকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। যদিও এই চিন্তাধারা খৈয়ামের একান্ত নিজস্ব নয় এবং ইসলামপূর্ব যুগেই এর উৎপত্তি হয়েছে। তবে এই চিন্তাধারাকে কবিতার আদলে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্ব খৈয়ামকেই দিতে হবে। সমকালীন ইরানের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক ড. আবদুল হুসাইন যাররীনকুব বলেন, ‘যদিও এ কথা সঠিক যে, আমাদের অনেক বিশ্বাস ও বিনোদনচিন্তা যুক্তিবুদ্ধির পরিপন্থী, কিন্তু এরপরও মনের সাক্ষ্য হচ্ছে, এসব ধারণা-কল্পনার মধ্যে প্রফুল্ল থাকার চিন্তাটি মনে সুখ দেয়। আর এই সুখের অনুভূতিই জীবনের দুঃখ-দুর্দশার পুরস্কার। জীবনে যদি আনন্দ ও স্ফুর্তির অবকাশ না থাকত তাহলে জীবন হতো কবরের মতো শীতল, নীরব এবং বেঁচে থাকার কষ্টের সাথে তুলনীয় হওয়ার অযোগ্য।’
তবে খৈয়াম অনর্থক আনন্দ-ফুর্তির কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য জানতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, এই জগৎ ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব সময়-সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যাবে।
খৈয়াম বিশ্বাস করতেন, আমাদের জীবন গতানুগতিক হলে চলবে না। যেহেতু মৃত্যু কখন আসবে কারও জানা নেই, তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতে হবে। মৃত্যুর কথা স্মরণে রেখে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন। জীবনটাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। কখনও হতাশায় ভোগেননি। লিখেছেন,
‘এসো হে বন্ধু কালকের চিন্তায় বসে না থাকি
জীবনের এই একটি মুহূর্তকে মূল্যবান ভাবি
আগামীকাল চলে যাব জীর্ণ শুঁড়িখানা ছেড়ে
সাত হাজার বছরীদের সাথে থাকব মিলেমিশে।’
কবি বিশ্বাস করেন, যে মুহূর্তগুলো আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি সেগুলোই আমাদের নিজস্ব। একদিন পর বা এক মিনিট পরের যে সময় তা আমাদের এখতেয়ারে নেই। কাজেই আগামীর যে মুহূর্তটি আদৌ আমার জীবনে আসবে কিনা জানা নেই, তা নিয়ে চিন্তা করা নিরর্থক।
‘কতকাল তার চিন্তা করব, জানি না যা আছে কি নেই
এ জীবন আনন্দে কাটাতে পারব, নাকি না, জানা নেই।
ভরে দাও এই জামবাটি, কারণ, আমি তো জানি না
এই নিশ্বাস যে নিচ্ছি তা নির্গত হবে, নাকি হবে না?’
খৈয়াম তাঁর কবিতায় ইঙ্গিত করেন যে, সাধকগণ বেহেশতের লোভে বা দোযখের ভয়ে আল্লাহর ইবাদত ইবাদত করেন না। করেন এজন্য যে, আল্লাহকে ইবাদতের যোগ্য মনে করেন বলেই। আদির রহস্যাবলি, সৃষ্টির গুঢ়তত্ত্ব, পরকাল, কিয়ামত কারো জানার আওতায় নেই। আল্লাহ ছাড়া তা কেউ জানে না। খৈয়ামও তাই বলেন,
সৃষ্টির রহস্য না তুমি জান, আর না জানি আমি
এ এক এমন জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমার ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন না থাকবে তুমি, না আমি।’
অনুরূপভাবে খৈয়াম অন্যত্র আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের এই চিন্তাধারার বিস্তার ঘটান। তিনি বলেন, এই জগৎ, আকাশ প্রকৃতি আল্লাহর কুদরতের আজ্ঞাবহ। এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ও সাধ্য কারো নেই।
খৈয়ামের চিন্তা ও চেতনা সেই চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা, যা মানুষ প্রাচীনকাল থেকে লালন করে এসেছে। মানুষ কোত্থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, কেন এসেছে, জীবন কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, জীবনের সময় ও মেয়াদের কতটুকু তার অধিকারের আওতায় আছে, তা নিয়ে মানবমন সর্বদা চিন্তামগ্ন ছিল এবং নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে আসছে। এসব চিন্তা খৈয়ামকে অভিভূত ও হতবাক করেছে। সেই চিন্তাধারা নিয়ে তিনি জগৎ-সংসারের দিকে তাকান এবং নিজের দিশেহারা চিন্তাগুলোকে ছোট ছোট বাক্যে গুঞ্জরিত করেন।
খৈয়ামের আগেও ফেরদৌসি এই চিন্তাধারাটির পুনরাবৃত্তি করেছেন শাহনামায় বহুবার। রুদাকী এবং সামানি আমলের কবিদের চিন্তায়ও এ ধরনের ভাবধারা ছিল। তবে এই চিন্তাধারাটি খৈয়ামের রচনায় সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে, আর যাঁরা তাঁর অনুকরণ করেছেন তাঁদের সংখ্যাও অনেক। সত্যিই পরবর্তী কবিদের ওপর খৈয়ামের চিন্তাধারার প্রভাব বিস্ময়কর।
ওমর খৈয়াম ও তার রুবাইয়াৎ | |
রুবাইয়াৎ | |
Template | Organized |