হাফিজের কবিতায় অধ্যাত্মবাদ
শাহনাজ আরফিন
এরফান বা আধ্যাত্মিকতা ফারসি সাহিত্যের একটি মূল্যবান উপাদান। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ‘এরফানে ইসলামি’ বা আধ্যাত্মিক বিষয়াদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গদ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে এরফানি চিন্তাধারা বিবৃত হয়েছে কাব্যাকারে বা পদ্যছন্দে। ফারসি ভাষায় এরফানে ইসলামি সম্পর্কিত কাব্যগুলোর মধ্যে মাওলানা রুমির মসনবী এবং শেখ মাহমুদ শাবেস্তারীর গুলশানে রায় অন্যতম। ফারসি ভাষী কবিদের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কবি আরেফ। তবে অনেক কবির লেখায় যেমন এরফান বা আধ্যাত্মিক চিন্তাদর্শন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, আবার অনেকের লেখায় কাব্য ও শিল্পই মুখ্য।
এ ভূমিকার আলোকে এবার আমরা দেখব ফারসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি হাফিজের কাব্য এবং চিন্তাদর্শনে এরফানের প্রভাব কতটুকু ছিল। তবে মূল আলোচনায় যাবার আগে এরফান ও সুফিবাদে বহুল আলোচিত ‘পীর’ শব্দটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক।
ফারসিভাষী বিশিষ্ট কথাশিল্পি আহমাদ আলী রাজায়ী বুখারায়ী পীর শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন- সুফিবাদী পরিভাষায় পীর হচ্ছেন এমন এক পথনির্দেশক বা রাহবার, যাঁর সাহায্য ছাড়া সালেক বা সত্যের পথযাত্রী মহাসত্যে উপনীত হতে অক্ষম। সুফিবাদীদের মধ্যে প্রচলিত কুতুব, শেখ, মোরাদ, ওলী, গাউস শব্দগুলো পীর শব্দেরই সমার্থক। সুফিবাদে পীর হচ্ছেন এ ইহ জগতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সালেক বা সত্যের পথযাত্রীদের প্রতিপালন ও পরিশুদ্ধকরণ এবং তাকে মহাসত্যে পৌঁছাবার দায়িত্ব তাঁর। এ জন্য পীরের প্রতিটি আদেশ নির্দেশ নিঃশর্তে মেনে চলেন তাঁর মুরিদ বা অনুসারীরা। একজন প্রকৃত পীর ও আল্লাহর ওলীর তত্ত্বাবধানে মানুষের আত্মা পূর্ণতা লাভ করে এবং ঐশী নূরে আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পীর সাধকদের সম্পর্কে কবি হাফিজের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে সাদামাটা ও সাধারণ লোকদের মত নয়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সচরাচর ও প্রচলিত ধারণার চেয়ে ভিন্ন। তিনি সমাজের প্রতিটি বিষয়কে প্রতিটি মূল্যবোধকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল মন দিয়ে বিচার ও মূল্যায়ন করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তাই হাফিজের কাব্যে পীর সাধকদের সম্পর্কে স্বতন্ত্র ও খণ্ডিত মূল্যায়ন চোখে পড়ে।
তাঁর কবিতার কিছু কিছু পঙ্ক্তিতে আমরা এক পথহারা যাত্রীকে দেখি, যে উদভ্রান্তের মত একজন নির্দেশককে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরম সত্যকে জানার উন্মাদনায় যার হৃদয় সদা ব্যাকুল। হাফিজের ভাষায়-
দার বিয়াবানে ফানা গুম শুদান অখার ত কেই
রাহ বেপুরছিম মাগার পেই বে মুহেম্মাত বারিম।
অর্থাৎ চির অস্তিত্বহীনতার প্রান্তরে নিঃশেষিত হওয়া আর কত কাল
ঠিকানা জানা নেই, হয়তো বা অভিষ্ট দিশা পাব।
অন্যত্র বলেছেন-
দার ইন শাবে সিয়াহাম গুম গাশত রাহে মাকসুদ
আজ গুশেই বিরুন অই এই কোকাবে হেদায়েত
অর্থাৎ এই তমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে, আমার গন্তব্যের ঠিকানা হারিয়ে গেছে
হে ত্রাণকর্তা! পর্দার অন্তরাল থেকে আবির্ভূত হও।
হাফিজের অনেক কবিতায় পীরের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত হয়েছে। ঐশী সাধকের দিকনির্দেশনা যে মানুষের প্রয়োজন তা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-
অনন কে খাকরা বে নাজার কিমিয়া কুনান্দ
আয়া বুদকে গুশেই চেশমি বেমা কুনান্দ?
অর্থাৎ যারা তাদের দৃষ্টির বরকতে মাটিকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেন
তাঁরা কি আমাদের দিকে এক পলক তাকাবেন?
হাফিজের কোন কোন গজলে আবার পীর বা আধ্যাত্মিক সাধকদের কঠোর সমালোচনা চোখে পড়ে।
তাঁর ভাষায়-
নেশানে মারদে খোদা আশেকিয়্যাত বা খুদ দর
কে দার মাশায়েখে শাহর ই নিশান নেমিবিনিম
অর্থাৎ এশক বা ঐশী প্রেমই হচ্ছে আল্লাহর বান্দার নিশানা অথচ
আমাদের শহরের শেখ বা পীরদের মধ্যে এ নিশানার অস্তিত্ব নেই।
পীর বা সাধক সম্পর্কে হাফিজের এ ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন থেকে আমরা অন্তত এটা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, তিনি পীর বা সুফি সাধকদের মান্য করতেন। তবে প্রচলিত পীর দরবেশদের নয়, তাঁর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন প্রকৃত ও আদর্শিক পীর ও সুফিসাধকরা।
হাফিজ যেহেতু একজন অসাধারণ কবি, তাই তিনি একজন সুচারু শিল্পীও বটে। তিনি তাঁর শিল্পমনা ও মননশীল হৃদয় দিয়ে কাক্সিক্ষত আদর্শ পীরের চিত্র এঁকেছেন। এই কাক্সিক্ষত পীর বা পীরে মোগান হাফিজের কবিতায় নানা শব্দ ও পরিভাষায় স্থান পেয়েছে। যেমন, পীর, পীরেমা, পীরে মেইকাদে, পীরে মেইখানে, পীরে খারাবাত, পীরে পেইমনে কেশ, পীরে দারদী কেশ ইত্যাদি। তাঁর বিভিন্ন কবিতা থেকে পীরে মোগানের স্বরূপ খানিকটা উপলব্ধি করা যায়। যেমন-
বে মেই সাজ্জাদে রাঙ্গিন কুন গারআত পীরে মোগান গুইয়াদ
অর্থাৎ শরাব বা মেই ঢেলে তোমার জায়নামাজ রঞ্জিত কর যদি তোমার পীরের নির্দেশ মেলে।
অন্যত্র তিনি লিখেছেন-
বান্দে ইয়ে পীরে মোগান আম কে যে জাহলাম বেরাহান্দ
পীরে মা হারচে কুনান্দ এইনে এনাইয়াত বশাদ
অর্থাৎ আমি সেই পীরের আজ্ঞাবহ যিনি আমার অজ্ঞতা দূর করেছেন, আমার পীর যাই করেন
তাতেই স্রষ্টার অনুগ্রহ রয়েছে।
হাফিজের এসব কবিতা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি মূলত এরফান বা ঐশী সাধনার পক্ষে ছিলেন এবং নিজেও ছিলেন একই পথের অনুসারী। কাজেই এরফান বা অধ্যত্ম জগতের প্রতিনিধি অর্থাৎ পীর, সুফি-সাধকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁকে দারুনভাবে পীড়া দিত। সুফি-সাধকদের দুনিয়াপ্রীতি, তাদের লোকদেখানো ধর্মাচার, জাগতিক সুখের আশায় ধর্মের লেবাস ধারণ কবির হৃদয়কে বেদনাক্লিষ্ট করে তুলত। হিজরি অষ্টম শতকের প্রথম দিকে পারস্যে তাসাউফ ও সুফিবাদের অধঃপতন ঘটে। এ সময় বাহ্যত সুফিবাদের আচার-অনুষ্ঠান অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠলেও এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা ম্লান হতে থাকে। সাধারণ মানুষ পার্থিব ও পারলৌকিক সুখের আশায় তথাকথিত সুফি ও পীরদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের খানকা ও দরবার শরীফকে সমৃদ্ধ করে তোলে। অতীতে সুফি এবং তাসাউফপন্থীরা একনিষ্ঠ সাধনা ও খোদায়ী এশকে উদ্দীপ্ত হয়ে মুর্শিদের পদ অলংকৃত করতেন, কিন্তু হিজরি অষ্টম শতকের প্রথম দিকে সুফিবাদের চরম অধঃপতনের যুগে পীর ও সুফি-সাধকরা জাগতিক স্বার্থকে তাঁদের অভিষ্ট লক্ষের সাথে গুলিয়ে ফেলেন, ফলে সুফিবাদ ও তাসাউফ ক্রমেই পারিবারিক সম্পদ ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
কবি হাফিজের যুগে অধিকাংশ সুফি ও তরীকতপন্থী এ ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। তাঁরা বাহ্যিকভাবে ধর্মের কথা উচ্চারণ করলেও ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তাঁদের জীবনে পরিলক্ষিত হতো না। কাজেই কবি, ধর্মের দেহে বিষ ফোঁড়াস্বরূপ এসব তথাকথিত সুফি-সাধকের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করার তাগিদ অনুভব করলেন। তিনি এসব পীর ও সুফির তীব্র সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হন নি, ভাষার তীক্ষ্ণ ফলায় বার বার তাঁদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। সমাজ ও জনমানুষকে তাঁদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এখানে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, এরফান ও তাসাউফ এ দুটি পরিভাষা ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে অনেক ক্ষেত্রেই সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকে শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে এই দুইয়ের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা ও বিস্তর ফারাক দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে এতে কারো দ্বিমত নেই যে, তাসাউফ মূলত সুফিবাদ থেকে নেয়া হয়েছে এবং এরফান পরিভাষাটি মূলত মারেফাত থেকে উৎসারিত।
আগেই বলা হয়েছে, হিজরি অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত তাসাউফ ও এরফান নিঃষ্কলুষ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল। ঐ সময় পবিত্র কোরআনের আধ্যাত্মিক শিক্ষা, আত্মশুদ্ধির আবেদন এবং এবাদত-বন্দেগিই ছিল তাসাউফ ও এরফানের মূলমন্ত্র। তখন শরিয়তি আচার-অনুষ্ঠানের সাথে তাসাউফ ও এরফানের কোন দ্বন্দ্ব বা সংঘাত ছিল না। কালের পরিক্রমায় এসব পরিভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং ক্রমেই তাতে নানা বিভ্রান্তি অনুপ্রবেশ করে।
পরবর্তীকালে হাল্লাজ,বায়েজীদ বোস্তামী, আবুল হাসান খারকানি ও জুনায়দীর মত বিশিষ্ট সুফি-সাধকদের আবির্ভাব এবং সানায়ী, আত্তার ও মাওলানা রুমীর মত বিশিষ্ট সাধক কবিদের কল্যাণে এরফান ও তাসাউফ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। হাফিজের সময়ে তাসাউফ বা সুফিবাদে নানা বিচ্যুতি দেখা দিতে থাকে। তখন নানা মত, তরিকা ও পদ্ধতি সুফিবাদে অনুপ্রবেশ করে।
হাফিজ শুধু একজন কবি ও শিল্পিই ছিলেন না, বরং তিনি একজন সমাজ সংস্কারক ও শ্রেষ্ঠ সমালোচক হিসেবেও সমাদৃত হয়েছেন। ফলে সমাজের এসব বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও সুনিপুণ ভাষায় কটাক্ষ করেছেন এবং পাশাপাশি সমালোচনা করেছেন খানকা, মসজিদ, পীর-দরবেশ ও সাধকদের। কারণ, বাহ্যত সুফি-দরবেশরাই এসব পবিত্র স্থানকে নিজেদের আখরায় পরিণত করেছিলেন। এসবের বিপরীতে কবি তাঁর মন ও মানসে এমন এক পবিত্র স্থান খুঁজে ফিরেছেন যেখানে লোকদেখানো ধর্মপালন ও পোশাকি ধর্মের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। যেখানে শুধু ঐশী সুধা পান করে খোদার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে তাঁরই মিলন প্রত্যাশা করা হবে।
হাফিজের কবিতায় খারাবাত বা পানশালা, মেইখানা, শুড়িখানা ইত্যাদি শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কবির কাঙ্ক্ষিত ও কল্পনার সেই পবিত্র স্থানকে বোঝাবার জন্যই তিনি এসব শব্দের দারস্থ হয়েছেন।
এ থেকে বোঝা যায় কবি হাফিজ সুফিবাদের তীক্ষ্ণ সামালোচক হলেও এরফান বা মারেফাতে বিশ্বাসী ছিলেন। এমনকি তাঁকে একজন আরেফ বা অধ্যাত্মবাদী সাধক বললেও ভুল হবে না। তবে সাধক কবিদের পুরোধা মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির সাথে হাফিজের পার্থক্য এখানেই যে কবি হাফিজের কবিতায় এরফান বা আধ্যাত্মিকতা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে তাঁর শৈল্পিক ও কাব্যিক মননশীলতা। এরফান ও এরফানি শব্দমালাকে তিনি তাঁর শিল্প ও কাব্যের সেবায় নিয়োগ করেছেন। অর্থাৎ কবিপ্রতিভা ও সুচারু শিল্পী ও কবি হিসেবেই হাফিজের খ্যাতি জগতময়, আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে নয়।
হাফিজের কবিতায় অধ্যাত্মবাদ | |
দিওয়ানে হাফিজ |