এজেন্সি
ইরানের জাতীয় সনদ ফেরদৌসির ‘শাহনামা’

ইরানের জাতীয় সনদ ফেরদৌসির ‘শাহনামা’

ইরানের জাতীয় সনদ ফেরদৌসির ‘শাহনামা’

ড. মো. কামাল উদ্দিন

মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি ইরানের জাতীয় কবি। ইরানের ঐতিহ্যমণ্ডিত জাতীয় ঘটনাবলি ও ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবন দান এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের নবদিগন্ত উন্মোচনে ফেরদৌসি ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য যখন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবে পশ্চাৎগামী হয়ে পড়ছিল এবং ইরানের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য মাত্র কয়েকটি যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে মানব জাতির ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল,ঠিক তখনই ফেরদৌসি ‘শাহনামা’ রচনার মাধ্যমে মাতৃভাষাকে পুনরুজ্জীবন দান করেন এবং জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্বপরিম-লে গৌরবময় আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ‘শাহনামা’ শুধু কলেবর ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ফারসি সাহিত্যের সর্ববৃহৎ কাব্যগ্রন্থ নয়; বরং তা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। ‘শাহনামা’র ভাষা ও সাহিত্য অতি উন্নত প্রকাশভঙ্গী ও মননশীলতার অধিকারী। এ ধারা অনুসরণে পরবর্তীকালে ইরানের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম রচনা করেন কালজয়ী ‘রুবাঈয়াত’,নিজামি ‘সিকান্দার নামা’ ও ‘ইউসুফ-জোলেখা’,শেখ সাদি ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ এবং জালাল উদ্দিন রুমি বিশ্ববিখ্যাত ‘মসনভি’। বিশ্বের অন্যতম অমর মহাকাব্য ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ ইরানের জাতীয় সনদ।

ফেরদৌসি (৯৪০-১০২০) সুলতান মাহমুদের নির্দেশে ‘শাহনামা’ রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ‘শাহনামা’ রচনার পরিসমাপ্তি ঘটে ১০১০ সালে। ত্রিশ বছর আগে ‘শাহনামা’ রচনার সূচনা হলে তা এসে দাঁড়ায় ৯৮০ সালের কোনো এক সময়ে। অথচ সুলতান মাহমুদ সিংহাসনে আরোহণ করেন ৯৯৮ সালে,তাই তাঁর নির্দেশে ৯৮০ সালে ‘শাহনামা’ রচনার কোন অবকাশ নেই। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘শাহনামা’ রচনার সময়কাল পঁয়ত্রিশ বছর বলে উল্লিখিত হয়েছে। কালজয়ী এ মহান কবি ১০২০ সালে স্বীয় জন্মভূমি তুস নগরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মহাকাব্য ‘শাহনামা’র সূচনা হয় আল্লাহ তাআলার প্রশংসাবাণীর মাধ্যমে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও আসহাবে রাসূলের প্রশংসা,জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গুরুত্ব, মানুষ ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য, ‘শাহনামা’ রচনার প্রেক্ষাপট এবং ইরানের পঞ্চাশ জন বাদশাহর গৌরবময় ইতিহাস ইত্যাকার বিষয়ের সমাহার ঘটে এতে। ‘শাহনামা’র শুরুতেই মহান আল্লাহর প্রশংসায় ফেরদৌসি বলেন,

প্রাণ ও প্রজ্ঞার প্রভুর নামে শুরু করি,

কল্পনা অতিক্রম করতে পারে না তাঁর নামের সীমা।

প্রভু তিনি নামের, প্রভু তিনি স্থানের,

তিনিই আহার্য দান করেন, তিনিই পথ দেখান।

তিনি প্রভু পৃথিবীর ও ঘূর্ণমান আকাশের,

চন্দ্র-সূর্য ও শুকতারা আলো পায় তাঁর থেকে।

বর্ণনা, ইঙ্গিত ও ধারণার ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান,

চিত্রকরের সৃষ্টির তিনি মূলতত্ত্ব।

জ্ঞানের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি বলেন,

জ্ঞান যে আহরণ করেছে সেই হয়েছে ক্ষমতাবান

জ্ঞানের দ্বারা জরাগ্রস্ত প্রাণ ফিরে পেয়েছে তার যৌবন।

বিশ্ব-প্রভুর দানের মধ্যে জ্ঞান সবচাইতে মূল্যবান,

জ্ঞানের গুণ-কীর্তন বদান্যতার পথে শ্রেষ্ঠ উপায়ন।

জ্ঞান সম্রাটদেরও সম্রাট,

জ্ঞান সম্মানিতগণের অলঙ্কার।

জেনে রাখ,জ্ঞান জীবন্ত ও চিরঞ্জীব,

জেনে রাখ,জ্ঞান জীবনের পুঁজি।

জ্ঞান পথের দিশারী ও হৃদয়-মুক্তকারী,

জ্ঞান হস্তধারণকারী বর্তমানে ও ভবিষ্যতে।

জ্ঞান অন্ধকার ও জড়ত্বকে দান করে আলো ও চলমানতা,

কাল প্রফুল্ল হয় না জ্ঞানের স্পর্শ না পেলে।

‘শাহনামা’র ঘটনা পরিক্রমা পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় এসে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। গবেষকগণ ‘শাহনামা’র ঘটনা প্রবাহকে তিনটি যুগে বিভক্ত করেন। পৌরাণিক বা রূপকথার যুগ: ইরানের প্রথম সম্রাট কিউমারস থেকে এ যুগের সূচনা। তারপর হোশাঙ্গ, তাহমুরস, জামশিদ এবং জোহাকের বর্ণনার পর ফারীদুনের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে এ যুগ সমাপ্ত হয়। এ সময়কালে মানুষ খাদ্য ও বস্ত্র অনুসন্ধান, অগ্নি উদ্ভাবন এবং কৃষিকাজ সহ অন্যান্য পেশা উদ্ঘাটনের মাধ্যমে সাফল্যের দ্বার উন্মোচিত করেন। বীরত্বপূর্ণ যুগ: ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে এ যুগের সূত্রপাত হয়। সম্রাট কাভের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে এর সূচনা হয় এবং ইতিহাসের মহাবীর রুস্তমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। ‘শাহনামা’র এ অংশটুকুই ইরানিদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের বীরত্বগাথা কাহিনীসমূহ অতি চমৎকারভাবে এতে বর্ণিত হয়েছে। ঐতিহাসিক যুগ: সম্রাট বাহমানের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে এ যুগের সূচনা হয় এবং সর্বশেষ সাসানী সম্রাট তৃতীয় ‘ইয়াযদেগারদ’ এর পতনের মধ্য দিয়ে ‘শাহনামা’ মহাকাব্যের ঘটনা প্রবাহ সমাপ্ত হয়। এ যুগে এসে বীরত্বপূর্ণ কল্পকাহিনী,অলৌকিক ব্যক্তিবর্গ এবং অস্বাভাবিক কার্যাবলির পরিবর্তে ঐতিহাসিক ও বাস্তব ঘটনাবলি ‘শাহনামা’য় স্থান দখল করে নেয়।

ফেরদৌসি তাঁর ‘শাহনামা’য় ইরানের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারাবাহিকভাবে কাব্যাকারে সন্নিবেশিত করেন। পাহলভি ভাষার সাথে সাথে ইরানিদের ইতিহাস যখন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মহাকবি ফেরদৌসি ‘শাহনামা’ রচনার মাধ্যমে মাতৃভাষা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সুসংহত ও যুগপদভাবে সংরক্ষিত করেন।

শা‎হ্নামা পৃথিবীর শেষ্ঠ মহাকাব্যগুলোর অন্যতম। প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আরবদের ইরান বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইরানের গৌরবময় ইতিহাস এতে কাব্যাকারে বর্ণিত হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থ শুধু কল্পকাহিনীতে পরিপূর্ণ নয়, বরং এর অর্থের বৈচিত্র্যময় মানবীয় আবেদন হৃদয়কে আন্দোলিত করে। ইরানের বীরত্বগাথা কাহিনীসমূহ সাহসিকতা, সৌজন্য, স্বদেশ প্রেম এবং আত্মোৎসর্গ করার মানসিকতায় পরিপূর্ণ। ‘শাহনামা’য় ইরানের প্রাচীন সম্রাটদের কীর্তি-কলাপ, আচার-ব্যবহার, সমাজ-সভ্যতা, সমর-কৌশল, শাসন প্রণালি, বিদ্যা-বদান্যতা এবং তৎকালীন লোক-চরিত্র, খেলাধুলা, শিল্প-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া তাওহিদ, দর্শন, মানব সভ্যতার ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তন ও নৈতিকতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলিও এতে স্থান পেয়েছে। এ সম্পর্কে A. J. Arberry বলেন: ‘Firdausi'sShahnamah, considered both quantitatively and qualitatively, is the greatest work in Persian literature and poetry; indeed, one can say that it's one of the world's literary masterpieces.’

‘সোহরাব ও রুস্তমের কাহিনী ‘শাহনামা’র সর্বাপেক্ষা আবেগময় অনুভূতির চিত্র, যা দেশ কাল ও ভৌগোলিক সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে মানুষের হৃদয়ে গভীর সহানুভূতির সঞ্চার করে। এমন হৃদয় বিদারক বিয়োগান্ত দৃশ্য বিশ্বসাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘শাহনামা’র মহানায়ক রুস্তম। কবি তাঁকে শৌর্যে-বীর্যে,শক্তিমত্তায়,সুবিবেচনায় ও আড়ম্বরে মহিমান্বিত করে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু যুবক বীর সোহরাবের শৌর্যের সামনে তিনি আতঙ্কিত হয়েছেন,অহংকারে জ্বলে উঠে গোপন করেছেন আত্মপরিচয়। এ পাপের শাস্তি বড় নির্মম, বড় হৃদয় বিদারক; রুস্তম পুত্রহন্তা ও আত্মনীপিড়ক হয়ে তাঁর দায়ভার চিরদিন নিজের শিরে বহন করেছেন। সোহরাব রুস্তমের কাহিনী বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে ডি.এল. রায় তাঁর ‘সোহরাব-রুস্তম’ নাটকে হৃদয় বিদারক কাহিনী বেশ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নিয়তির উপকরণ হিসেবে এখানে যা ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে রুস্তমের আত্মমর্যাদাবোধ ও সোহরাবের অনুসন্ধিৎসা।

ফেরদৌসি বহুমুখী চরিত্র চিত্রণে ছিলেন দক্ষশিল্পী। পৃথিবীর যে কোন মহাকবির সৃষ্ট চরিত্রের চেয়ে তা সংখ্যায় কম নয়; মানবিক দোষে-গুণে হীন নয়, শৌর্য-বীর্যে খাটো নয় এবং প্রেমে ও সহানুভূতিতে অনুজ্জ্বল নয়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের পতন এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে তিনি এসব চরিত্রের গতিতে মানব জীবনকে সম্পর্ণরূপে আবর্তিত করেছেন। কোন চরিত্রের প্রতিই কবির কোন পক্ষপাতিত্ব নেই; স্রষ্টার মমত্ববোধ ও সহানুভূতি নিয়েই তিনি তাদের অনুসরণ করেছেন। এই অমর সৃষ্টিই ফেরদৌসিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের সমমর্যাদা দান করেছে। বিশেষত তিনি ‘শাহনামা’র অন্যতম চরিত্র তাহমিনার জন্য পাঠক হৃদয়ে সহানুভুতির অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলিত করেছেন।

বীরত্বগাথা কাহিনীতে ভরপুর ‘শাহনামা’র রণক্ষেত্রগুলো বিপুল প্রসার। বড় ভয়াবহ সেই রণক্ষেত্র, সেখানে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। সৈন্যদের পদতাড়িত ধুলায় আকাশে মেঘ জমে যায়, তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকাতে থাকে, তীর ও বর্শার বারি বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। ‘শাহনামা’র প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। সেখানে উপত্যকায় ও উপবনে হরিণদল বিচরণ করে। কোথাও কোথাও স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হয়, যা হৃদয় মনকে উচ্ছ্বাসে নাচিয়ে তোলে। অবসানকালে সেনাপতিগণ বিশেষত রুস্তম সেখানে শিকারে মত্ত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে মহাকবি ফেরদৌসি স্বীয় সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তাঁর মহাকাব্যকে কাব্যরসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন।

সাহিত্যের এক বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে নারীর সৌন্দর্য, প্রেমময় অনুভূতি, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি। ‘শাহনামা’য় বর্ণিত নারী চরিত্র খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছেন তাঁর মহাকাব্যে। ইরানের রাজকন্যা ও অভিজাত কন্যাগণ প্রায়শই প্রেমময়ী ও পবিত্র হতেন। কুটিল ও দুশ্চরিত্রা নারীরা অবশ্যই তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করত। কুমারী কন্যাগণ গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করতেন। লজ্জাশীলতা ও ধর্মভীরুতা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ চিরায়ত ফারসি সাহিত্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কোরআন, হাদিস ও ইসলামি সাহিত্যের প্রভাব বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। রূপক উপমা-উৎপ্রেক্ষার সার্থক প্রয়োগ কাব্যশৈলীকে করেছে উন্নত। তিনি দুর্বোধ্য ফারসি শব্দাবলি পরিহার করে সহজ সরল ভাষার প্রয়োগে কাব্যকে আকর্ষণীয় ও সর্বজনীন করে তোলেন। ফলে অন্যান্য কাব্যের তুলনায় ‘শাহনামা’ অধ্যয়নকালে খুব বেশি অভিধানের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। আল্লামা ইবনুল আসির তাঁর মাসালুশ শা‘য়ের গ্রন্থের শেষাংশে উল্লেখ করেন,‘আরবি ভাষা ‘শাহনামা’র ন্যায় ভাবের বিশালতা ও প্রচুর শাব্দিক বিন্যাস উপস্থাপন করতে পারবে না।’ ফেরদৌসি ছিলেন উন্নত নৈতিক চিন্তাচেতনার অধিকারী। বলা যায় ফারসি কাব্যসাহিত্যে ফেরদৌসি হচ্ছেন প্রথম কবি যিনি কাব্য চর্চায় অশালীন শব্দাবলি পরিহার করে একান্ত প্রয়োজনে মার্জিত ভাষার প্রয়োগে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ফারসি ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ভাষা অনেকাংশে বর্জন করেন। ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, তিনি সম্পূর্ণ ‘শাহনামা’য় মাত্র শতকরা চার কিংবা পাঁচ ভাগ আরবি শব্দের প্রয়োগ করেছেন। এমনকি শতকরা দু’ভাগের অধিক আরবি শব্দের সমাহার তাঁর ‘শাহনামা’র ভূমিকায় পরিলক্ষিত হয় না। ফেরদৌসি ‘শাহনামা’ রচনার মাধ্যমে ইরানের ইতিহাস ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

কবি নিজেই বলেন,

দীর্ঘ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে

এ ফারসিগ্রন্থ দ্বারা ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।

‘শাহনামা’ এক বিশ্ববিশ্রুত মহাকাব্য। ‘শাহনামা’র শব্দ ও ছন্দ মাধুর্য সাহিত্যানুরাগী মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ফারসি ভাষায় চমৎকার শব্দ সম্ভার প্রয়োগের মাধ্যমে কাব্য রচনা করে সাহিত্য জগতে এক নবদিগন্ত উন্মোচিত করেন। ‘শাহনামা’র ভাষা ও সাহিত্য মান এত উন্নত যে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়াতে ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ খুবই জনপ্রিয়। পাশ্চাত্য গবেষকদের কাছে আজো মহাকাব্য শাহনামা এক বিস্ময়কর শিল্পকর্ম। এ অনবদ্য মহাকীর্তি ‘শাহনামা’র জন্য তাঁকে হোমারের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। Sir William Jones এর মতে, ‘(Shahnama) a glorious monument of Eastern genius and learning which if ever it should be generally understood in its original language, will contest the merit of invention with Homer himself.’

ইরানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে মহাকবি ফেরদৌসির অবদান অপরিসীম। সুনিপুণ শব্দচয়ন, বক্তব্যের গাঁথুনি, প্রবাদ প্রবচন এবং অন্তর্নিহিত অর্থের সমন্বয়ে ‘শাহনামা’ উঁচুমানের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ফারসি ভাষাকে সহজ, গতিশীল ও অবিমিশ্র ভাষারূপে উপস্থাপন করে ভাবীকালের কাব্য সাধকগণের জন্য কাব্যচর্চার একটি বিশাল রাজপথ নির্মাণ করেন গিয়েছেন। ঘটনার চিত্র উপস্থাপনায়, দৃশ্য বর্ণনায় এবং অনুভূতি-কল্পণা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি যে অনবদ্য অবদান রেখেছেন তা পরবর্তীকালের কবিসাহিত্যিকদের জন্য অনুসরণীয়। এ ধারা অনুসরণে পরবর্তীকালে ইরানের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক নিজেদেরকে বিশ্বসাহিত্যের গৌরবময় আসনে সমাসীন করতে সক্ষম হন। পৃথিবীতে যতদিন ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি টিকে থাকবে ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ও ততদিন বিশ্ববাসীর নিকট এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। ‘শাহনামা’ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য,ইরানের জাতীয় সনদ।

ইরানের জাতীয় সনদ ফেরদৌসির ‘শাহনামা’
শাহনামা
TemplateOrganized

:

:

:

: