‘হায়দার বাবার কবি’ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার
আবদুস সবুর খান
বিশ শতকের গোড়ার দিকেই ফারসি সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা ঘটে। তবে উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই এ লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কাচার শাসক নাসিরউদ্দিন শাহ্ (শাসনকাল ১৮৪৮১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনামলে ইরানে নবজাগরণের সূচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানে মাশরুতিয়াত বা সংবিধান আন্দোলনের সূচনা হয়,যা ইরানের সমাজ, রাজনীতি এবং সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এ সময় ইউরোপীয় ধারার অনুসরণে ইরানি সাহিত্যেও নবতর ধারার সূচনা ঘটে। নিমা ইউশিজের (১৮৯৭-১৯৬০) মাধ্যমে ফারসি কবিতা পূর্ণাঙ্গ আধুনিক রূপ পায়।
এই যুগে ইরানে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং পত্রপত্রিকার বিকাশ সাহিত্যের বিকাশ ও সর্বজনীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যার ফলে ফারসি সাহিত্য পূর্বের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং সহজপ্রাপ্যতার কারণে সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, চিন্তক শ্রেণি এবং সংকলকদের মধ্যে পূর্বের তুলনায় সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাবলি ও সংকলন প্রকাশের প্রতি অধিক ঝোঁক লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে পশ্চিমা সাহিত্য অনুবাদ এবং পূর্ববর্তী ইরানি কবি-সাহিত্যিকগণের রচনাবলি সম্পাদনা করে প্রকাশের প্রতিও বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়।
এই যুগে বিষয়বস্তু, লক্ষ্য ও বর্ণনধারার দিক থেকে ফারসি সাহিত্য ছিল বিবর্তন ও বিপ্লবমুখী। প্রাচীন ছন্দরীতি একেবারে ভেঙ্গেও পড়েনি আবার নতুন ধারার ছন্দরীতিও পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করেনি। আধুনিক ফারসি সাহিত্য সম্পূর্ণরূপে পরিপূর্ণতার দিকে পরিক্রমণ করছে, এরকম একটি অবস্থা। মাশরুতিয়াত যুগে ফারসি কাব্যসাহিত্য ক্রমবিকাশের যে কয়টি পর্যায় অতিক্রম করে ইতঃপূর্বের ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে তা ছিল নজিরবিহীন। এই যুগের ফারসি কবিতা নির্দিষ্ট শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাত শ্রেণির রুচি ও জৌলুসপূর্ণ ঘটনাবলির বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বজনীন বিষয়াবলি এবং সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীর মুখপাত্রে পরিণত হয়। দরবার ও সমাজের অভিজাত শ্রেণির সাথে সরাসরি সম্পর্কের পরিবর্তে অসংখ্য পত্র-পত্রিকার সাহায্যে রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক বিষয় ও বক্তব্যের মাধ্যমে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। শহর ও গ্রামের আনাচে-কানাচের সাধারণ জনগোষ্ঠীই হয়ে ওঠে কবিতার পাঠক বা অন্বিষ্ট। পুনর্জাগরণী বা আধুনিক যুগের ফারসি কবিতা কার্যকারিতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে সর্বজনীনতা লাভ করে এবং পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনা আন্দোলনের তীক্ষ্ণ ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে।
বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আধুনিক যুগের ফারসি কবিদেরকে প্রধানত তিনটি দলে বিভক্ত করা যায়। প্রথম দল হচ্ছে সনাতনী কাব্যধারার অনুসারী। দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে যোগসূত্রকারী কবি।এই শ্রেণিভুক্ত কবিদের অধিকাংশই ছিলেন ফর্মালিস্ট। তবে তাঁদের কবিতায় এরফানি বা আধ্যাত্মিক বিষয়াবলিও, বিশেষ করে বিভিন্ন এরফানি পরিভাষা ও উক্তি উল্লিখিত হয়েছে। তৃতীয় দল হচ্ছে মেহনতি মানুষের কবি। যাঁরা অভিজাত উচ্চবিত্ত ও রাজদরবার থেকে কবিতা ও সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান এবং তাঁদের কবিতায় সমাজের অধিকার-বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক দুঃখ-বেদনা ও বঞ্চনা প্রতিধ্বনিত হয়।
তবে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সামাজিক অভ্যুত্থান, আধাসামন্ত কাচার রাজবংশের ক্রমাবলুপ্তি এবং পরবর্তীকালে পাহলভী রাজবংশের উত্থান, প্রভৃতি ঘটনাবলি ফারসি সাহিত্যের আধুনিকতার স্রোতধারাকে এতটাই বেগবান করে তুলে যে, মাশরুতিয়াত যুগের রক্ষণশীল কবিতায় যে বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারা সূচিত হয়েছিল তা আর কোনোমতেই রোধ করা যায় না বরং এই বিবর্তনধারা এমন একজন কবির প্রতীক্ষায় ছিল, যে চূড়ান্তভাবে ফারসি কবিতাকে পাল্টে দিতে পারে। ফারসি কবিতার প্রাচীন অবয়ব, বহুকাল ধরে যে রীতি ও সীমাবদ্ধ ফর্মে আটকে ছিল তা আর সমকালীন সামাজিক সমস্যাবলির পূর্ণপ্রকাশ করতে সমর্থ হতে পারে না। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ফারসি কাব্যসাহিত্যে যে বিষয়টি বাঞ্ছিত ছিল তা হচ্ছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন শব্দাবলি এবং আধুনিক জীবনানুভূতি। ঠিক এই সময়েই আধুনিক ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে নিমা ইউশিজের আবির্ভাব ঘটে। যিনি ফারসি কাব্যের বিষয়বস্তু ও কবি-কল্পনার আধুনিকায়নের পাশাপাশি ফারসি কবিতার সনাতনী ধারার ছন্দ এবং পঙ্ক্তির সমতা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে কবিতার ছন্দ, তাল ও পঙ্্ক্তিতে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক নির্মাণ করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগ পর্যন্ত যে ধারা তাঁর পরবর্তী তরুণ ও প্রতিভাবান কবিরা সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের কাব্যকর্মে এই ধারার অবলম্বন করেন। যার ফলে এ ধারার কবিতাকে ‘নিমায়ী ধারার কবিতা’ এবং এই যুগকে ‘নিমায়ী যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। নিমায়ী যুগের যেসব প্রতিভাবান কবি ফারসি সাহিত্যের চিরায়ত ধারায় কার্বচর্চা করে স্বীয় প্রতিভাগুণে আধুনিক ফারসি কাব্যভা-ারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার তাঁদের অন্যতম।
ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবরিজে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মির্জা আগা খোশক্নাবি পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তাঁর বাল্যকাল ছিল ইরানের মাশরুতিয়াত বা সংবিধান আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ কারণে তাঁর শৈশবের দিনগুলো নানা অর্থকষ্টে কাটাতে হয়। ওস্তাদ শাহরিয়ার তাঁর শৈশব ও কৈশোর জীবন তাবরিজ শহরেই অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তেহরান গমন করেন এবং তেহরানে এসে মালেকুশ শোয়ারা বাহার, কারখি ইয়াজদি, আমিরি ফিরোজ কুহি, আরেফ কাজভিনি, মিরজাদে এশকি, ইরাজ মির্জা প্রমুখ বিখ্যাত কবিদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তেহরানে অবস্থানের প্রথম বছরগুলোতেই সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দারুল ফুনুন’-এ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর মেডিক্যালে ভর্তি হন। এসময় সুরাইয়া নাম্মী এক তরুণীর সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুরাইয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের মেয়ে। অসাধারণ রূপবতী ছিলেন তিনি। সে কারণে শাহরিয়ার তাঁকে ‘পরি’ বলে ডাকতেন। পরিকে তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে মধুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সুরাইয়ার বাবা-মাও তাঁদের এই সম্পর্কের কথা জানতেন। সুরাইয়াকে নিয়ে শাহরিয়ারের জীবনে বহু স্মৃতিও রয়েছে। যার কিছু কিছু শাহরিয়ার তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখও করেছেন। প্রায় প্রতিটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর অনেক কবিতাও রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের এই প্রণয় আর পরিণতিতে পৌঁছেনি। শেষের দিকে সুরাইয়া কেমন যেন বদলে যান। কবিকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। শাহরিয়ারও তাঁর কবি-সম্পদ অভিমানের কারণে নিজ থেকে আর সুরাইয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন নি। বাকি জীবন এই প্রেমের স্মৃতি শাহরিয়ারকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে এবং এই স্মৃতি নিয়ে তিনি বহু কবিতাও রচনা করেছেন।
একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন অপরদিকে সুরাইয়ার সাথে প্রণয়ের ইতি হওয়ার কারণে মেডিক্যালে পড়াশোনা শেষ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। ফলে পড়াশোনা ত্যাগ করে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন এবং বেশ কয়েকটি চাকরি বদল করে শেষ পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকের চাকরিতে স্থিত হন। যদিও তিনি এই চাকরিও পছন্দ করতেন না তবুও অবসর পর্যন্ত এই চাকরিতেই বহাল ছিলেন। এই সময় থেকেই তিনি পূর্ণোদ্যমে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে শাহরিয়ার ইরানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামালুল মুলকের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে খোরাসানে ছুটে যান এবং এ উপলক্ষে ‘জিয়ারাতে কামালুল মুলক’ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং তাবরিজের সারখাব কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শাহরিয়ার তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কবিতা এবং সাহিত্যচর্চায় কাটিয়েছেন। মাত্র চার বছর বয়সে গৃহ পরিচারিকা রোকেয়া খানমের উদ্দেশ্যে আজারবায়জানীয় তুর্কি ভাষায় মুখে মুখে নিম্নোক্ত শ্লোকটি রচনা করেন :
روقیه باجی باشمین تاجی
آتی آت ایته منه ویرکته
[রোকেয়া বুবু,তুমি আমার মাথার তাজ
গোশতগুলো কুকুরকে দিয়ে আমায় দাও সেদ্ধ ভাত]
মাত্র নয় বছর বয়সে একবার তাঁর মা তাঁর ওপর রাগ করলে তিনি মাকে খুশি করার জন্য ফারসি ভাষায় প্রথম কবিতা রচনা করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মালেকুশ শোয়ারা বাহার, সাইদ নাফিসি এবং পাজমান বাখতিয়ারের ভূমিকাসমেত শাহরিয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কাব্যচর্চার শুরুর দিকে শাহরিয়ার তাঁর কাব্যনাম ব্যবহার করতেন ‘বেহজাত’। কিন্তু পরবর্তীকালে কাব্যনাম ব্যবহারের জন্য তিনি হাফিজের গজলের শরণাপন্ন হন এবং হফিজের দিওয়ান থেকে ‘ফাল গ্রহণ’ বা ভাগ্য গণনার মাধ্যমে ‘শাহরিয়ার’ কাব্যনাম ব্যবহার করেন।
শাহরিয়ার ফেরদৌসি, সাদি, রুমি এবং হাফিজের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বিশেষ করে হাফিজের কবিতা ও চিন্তাধারার প্রতি তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী। এই অনুরাগের ফলেই তিনি হাফিজকে উদ্দেশ্য করে ‘ভেদা বা হাফেজ’ এবং ‘হাফেজে জাবেদান’ শিরোনামে পৃথক দুটি গজল রচনা করে তাঁর সেই অনুরাগ-অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। গজল কবিতার মাধ্যমেই তিনি তাঁর বেশিরভাগ অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এগুলো তাঁর যৌবনকাল এবং বেড়ে ওঠার সময়কালের অনুভূতিসমূহের এমন বাক্সময় প্রকাশ, যেগুলোকে ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠ তিন গজলকার রুমি, সাদি এবং হাফিজের গজল-প্রভাবিত বলে মনে হয়। উদাহারণ হিসেবে তাঁর ‘حالا چرا’ (এখন কেন) গজলটির উদ্ধৃত করা যায়। যেটি শুরু হয়েছে এভাবে-
آمدی، جانم به قربانت ولی حالا چرا
بی وفا حالا که من افتاده¬ام از پا چرا
نوشدارويی و بعد از مرگ سهراب آمدی
سنگدل اين زودتر می¬خواستی، حالا چرا
عمر ما را مهلت امروز و فردای تو نيست
من که يک امروز مهمان توام، فردا چرا
نازنينا ما به¬ناز تو جوانی داده¬ايم
ديگر اکنون با جوانان ناز کن با ما چرا
وه که با اين عمرهای کوته بی¬اعتبار
اين¬همه غافل شده از چون منی شيدا چرا
شور فرهادم بپرسش سر به¬زير افکنده بود
ای لب شيرين جواب تلخ سربالا چرا
ای¬ شب ¬هجران ¬که ¬يکدم در تو چشم من نخفت
اينقدر با بخت خواب آلود من، لالا چرا
آسمان چون جمع مشتاقان پريشان می کند
در شگفتم من نمی¬پاشد ز هم دنيا چرا
در خزان هجر گل ای بلبل طبع حزين
خامشی شرط وفاداری بود، غوغا چرا
شهريارا بی حبيب خود نمی¬کردی سفر
اين سفر راه قيامت می¬روی، تنها چرا
[এসেছ, জান আমার তোমার জন্য উৎসর্গিত তবে এখন কেন
অবিশ্বস্ত এখন তো আমি নিরুপায় হয়ে গেছি তবে কেন
সেই প্রতিষেধক যে সোহরাবের মৃত্যুর পরে এলে
পাষাণ-হৃদয় এমন দ্রুততর চাচ্ছিলে,এখন কেন
আমার জীবন তো তোমার আজ এবং আগামীর অবকাশ নয়
আমি তো তোমার আজকের অতিথি,আগামীকাল কেন
আদরণীয়া আমার তোমার অনুরাগে যৌবন দিয়েছি
এখন অন্য তরুণদের সাথে কর ছলাকলা আমার সাথে কেন
হায় এই ছোট্ট জীবনের সাথে এতটা আস্থাহীন
উদাসীন হলে আমার মতো প্রেমে মত্তর বিষয়ে
ফরহাদের আবেগ আমি প্রশ্নে মাথা নুয়ানো ছিলো
হে মিষ্টি ঠোঁট তিক্ত জবাবে শির উঁচু কেন
হে বিরহের রাত যাতে এক মুহূর্ত তোমাতে আমার চোখ ঘুমায়নি
এতটা আমার নিদ্রালু ভাগ্যের সাথে, বিদায় বিদায় কেন
আকাশ যেন সকল আগ্রহীকে অস্থির করে তুলছে
বিস্মিত আমি জগৎ আমার জনহীন হয় না কেন
ফুলের বিচ্ছেদের শরতে হে ব্যথিত প্রকৃতির বুলবুল
নিশ্চুপতা ছিল বিশ্বস্ততার শর্ত, শোরগোল কেন
হে শাহরিয়ার নিজ বন্ধুহীন করনি ভ্রমণ
এই কেয়ামতের ভ্রমণে যাচ্ছ,একাকী কেন]
শাহরিয়ারের কবিতায় ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ইসলামি বিপ্লবের আন্দোলনের দিনগুলোতে এবং তার পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় ও চারিত্রিক বিষয়াবলি নিয়ে কাব্যচর্চা করেন তিনি। ইসলামি ঐতিহ্য, ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং এই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারীদের প্রশংসায়ও কবিতা রচনা করেছেন তিনি। তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারা প্রভাবিত কবিতাসমূহে তিনি হযরত আলী (রা.)-এর প্রতি তাঁর অনুরাগ ও প্রেমাসক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর পবিত্র কালাম কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর হাদীস ও ওলী-বুজুর্গদের বাণীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর কবিতায় নবী-পরিবার তথা আহলে বাইতের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার স্মৃতি তাঁর ‘داغ حسين’ (হোসাইনের শোকচিহ্ন) কবিতায় এভাবেই বিবৃত হয়েছে-
محرم آمد و نو کرد درد و داغ حسين
گريست ابر خزان هم به باغ و راغ حسين
هزار و سيصد و اندی گذشت سال و هنوز
چو لاله بر دل خونین شيعه داغ حسین
به هر چمن که بتازد سموم باد خزان
زمانه یاد کند از خزان باغ حسین
هنوز ساقی عطشان کربلا گویی
کنار علقمه افتاده با ایاغ حسین
اگر چراغ حسینی به خیمه شد خاموش
منور است مساجد به چلچراغ حسین
[মোহাররম এসেছে আর হোসাইনের শোককে করেছে নবায়ন
শরতের মেঘও হোসাইনের বাগান আর সবুজ প্রান্তরে করেছে ক্রন্দন
তেরশ বছরেরও অধিক পার হলো তবুও এখনো
শিয়াদের রক্তাক্ত হৃদয়ে হোসাইনের শোকচিহ্ন টিউলিপ ফুলের মতন
যে তৃণভূমিতেই শরত-বায়ুর বিষ বয়ে যায়
হোসাইনের বাগানের শরতকালের কথাই স্মরণ করে যায়
এখন কারবালার তৃষ্ণার্ত সাকী যেন মনে হয়
‘আলকামা’র পাশে পড়ে আছে হোসাইনের পানপাত্রসহ
যদিও তাঁবুতে হোসাইন-প্রদীপ নিভে গেছে
তবুও মসজিদগুলো আলোকিত হোসাইনের চল্লিশ প্রদীপে]
শাহরিয়ার চিরায়ত ধারার ফারসি কবিতা, যথা : কাসিদা, মাসনাভি, গজল, কেতআ, রুবাই ইত্যাকার সব ধারায়ই কবিতা রচনা করেছেন। এছাড়া নিমায়ী ধারার কবিতায়ও নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি এবং ‘এই ভায়ে মাদারাম’, ‘দো মুরগে বেহেশতি’, ‘মুমিয়ায়ী’, ‘পায়াম বে আনশাতিন’ প্রভৃতির ন্যায় উল্লেখযোগ্য কেতআ রচনা করেছেন। নিমায়ী ধারার তাঁর এই কবিতায় শিল্পের নাগপাশে বন্দি অসহায় মানুষদের প্রতি তাঁর সমবেদনা ও সহমর্মিতা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এসবের পাশাপাশি শাহরিয়ার তাঁর নিজের মাতৃভাষা অর্থাৎ আজারবাইজানীয় তুর্কী ভাষায় এমন কিছু মনোমুগ্ধকর কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলো ফারসি-ভাষী পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাঁর ‘সালাম বে হায়দার বাবা’র কথা উল্লেখ করা যায়; যেটি আযারবাইজানীয় তুর্কী ভাষার শ্রেষ্ঠকর্ম হিসেবে বিবেচিত এবং ফারসি ভাষাতেও এর অনুবাদ হয়েছে। এই কবিতায় তিনি গ্রাম এবং গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর যে প্রেমাসক্তি এবং তাদের মৌলিকত্ব ও সৌন্দর্যের কথা ব্যক্ত করেছেন। এই কাহিনি-কাব্যে কবির আবেগ-অনুভূতি, জীবন-প্রাণ এমনভাবে একাকার হয়ে গেছে, মনে হবে যেন কবির সমস্ত জীবনের অনুভূতি-কল্পনা তিনি তাঁর এই কবিতায় ঢেলে দিয়েছেন। এ কারণেই শাহরিয়ারকে ‘হায়দার বাবার কবি’ এবং ‘গ্রামের সম্মানের কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর এই কাহিনি-কাব্য প্রথমবার ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তাবরিজ থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রথমে আযারবাইজানীয়দের মধ্যে এবং পরবর্তীতে সমস্ত ইরানে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। হায়দার বাবা মূলত শাহরিয়ার জন্ম-গ্রামের একটি পাহাড়ের নাম, যাকে সম্বোধন করে কবি তাঁর গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ প্রকৃতি, গ্রামের মানুষের জীবনাচার এবং গ্রামীণ ইতিহাস-ঐতিহ্য এক এক করে বর্ণনা করেছেন। যার শুরু হয়েছে এভাবে- ‘হায়দার বাবা, যখন ঝড়-ঝঞ্ঝা শুরু হয় আর বন্যা ও বৃষ্টির পানি পাহাড় ও উপত্যকা হয়ে গড়িয়ে পড়ে, সুন্দরী বালিকারা দলে দলে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে, তোমার শক্তিমত্তা আর বিশালতার প্রতি সালাম এবং অভিভাদন, তখন আমাকেও স্মরণ করো।’
শাহরিয়ারের সমস্ত কাব্যকর্মকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ক. আজারবাইজানীয় তুর্কি ভাষায় রচিত কবিতা এবং খ. ফারসি ভাষায় রচিত কাবিতা। আজারবাইজানীয় তুর্কি ভাষায় রচিত বিখ্যাত কাহিনিকাব্য ‘হায়দার বাবায়ে সালাম’ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। যা পরবর্তীতে ফারসি ভাষায়ও অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। অপর দিকে ফারসি ভাষায় তিনি ৫৪৭টি গজল, ১০০টি কাসিদা, ২৫টি মাসনাভি, ১৫০টি ক্বেতআ, ১২৩টি খণ্ড কবিতা এবং ইসলামি বিপ্লব নিয়ে রচিত ৩৯ টি কবিতা। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দিওয়ান (কাব্যসংকলন)-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবং চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে তেহরানের এন্তেশারাতে নেগাহ ‘দিওয়ানে শাহরিয়ার’ শিরোনামে দুই খণ্ডে শাহরিয়ারের কাব্যসমগ্র প্রকাশ করে। যা এ পর্যন্ত একাধিকবার পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
ফারসি সাহিত্যের চিরায়ত কবি ফেরদৌসি, সাদি, রুমি এবং হাফিজের প্রতি শাহরিয়ারের বিশেষ অনুরাগ ছিল। বিশেষ করে হাফিজের কবিতা এবং তাঁর কাব্যদর্শনের তিনি খুবই প্রশংসা করতেন। মূলত হাফিজের প্রতিই তাঁর টান ছিল সবচেয়ে অধিক। যা তিনি তাঁর ‘বেদা বে হাফেজ, এবং ‘হাফেজে জাবেদান’ শিরোনামের পৃথক দুটি গজলে ভাবনার নিবিড়তায় প্রকাশ করেছেন। শাহরিয়ার তাঁর কাব্যানুভূতির বেশিরভাগই প্রকাশ করেছেন ‘গজল’ কাব্যের মাধ্যমে। তাঁর এসব গজল তাঁর যৌবন ও পূর্ণ বয়সের স্মৃতির স্মরণ। ভাষা ও কাব্যানুভূতির দিক থেকে এসব গজল এতটাই সমৃদ্ধ এবং শিল্পমান উত্তীর্ণ যে, এতে প্রতীয়মান হয় ফারসি কাব্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তিন গজল রচয়িতা রুমি, সাদি এবং হাফিজের গজলের সব কাব্যকলাই শাহরিয়ার রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যেমন বিশ্লেষণধর্মী তেমনি কাব্যদৃষ্টি, কবি-কল্পনা এবংচিত্রকল্পের দিক থেকেও সনাতনী ধারার পরিবর্তন প্রকাশের নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছে। ‘زندان زندگی’ (জীবনের কারাগার) তাঁর এধারারই একটি কবিতা। এর কয়েকটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমরা আমাদের আলোচনার সমাপ্তি টানছি-যেসব কবিতা তিনি নিমার জন্য এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন-শাহরিয়ার ছিলেন অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার অধিকারী। তাঁর সমগ্র কাব্যে মনস্তাত্ত্বিকতা, সংবেদশীলতা ও কবি-কল্পনা এতটাই প্রবল যে, নিমায়ী যুগে বসবাস করে ও নিমায়ী কাব্য-বলয়ের বাইরে ফারসি সাহিত্যের সনাতনী ধারায় কাব্য রচনা করেও স্বীয় প্রতিভা এবং কাব্যগুণেই শাহরিয়ার অনন্য হয়ে উঠেছেন এবং আধুনিক ফারসি কাব্যে আপন আসন পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বলে তিনি যে নিমায়ী ধারায় কোনো কবিতা রচনা করেন নি, এমনটা নয়। তবে তাঁর নিমায়ী ধারায় রচিত কবিতাগুলোও
تا هستم ای رفیق ندانی که کیستم
روزی سراغ وقت من آیی که نیستم
در آستان مرگ که زندان زندگیست
تهمت به خویشتن نتوان زد که زیستم
پیداست از گلاب سرشکم که من چو گل
یک روز خنده کردم و عمری گریستم
[যতক্ষণ আছি হে বন্ধু জানবে না যে আমি কে
একদিন আমার সময়ের খোঁজে আসবে যখন আমি নেই
মৃত্যুর চৌকাঠে যেটি জীবনের কারাগার
স্বজনদের অভিযোগ করা যায় না যে বেঁচে আছি
আমার অশ্রু-গোলাপে বোঝা যায় আমিও ফুলের মতো
একদিন হেসেছি আর এক জীবন কাঁদলাম]
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘হায়দার বাবার কবি’ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার | |
হায়দার বাবা | |
Template | Organized |