এজেন্সি
মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মাহদী মাহমুদ

আমাদের নবী একজন মানুষ। ইসলামের মহানতম ব্যক্তিত্ব! সারা জগতের সেরা সৃষ্টি। অন্যদিকে, গৌতম বুদ্ধ, মহাত্মা গান্ধী, কনফুসিয়াস, শ্রী বিবেকানন্দ, লালন ফকির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন সমাজের আর দশজন থেকে একেবারেই অন্যরকম।

যেখানে আমাদের নবী ছিলেন গৃহি সেখানে অন্য অনেক মহাপুরুষ ছিলেন সন্ন্যাসী। তাঁদের কেউ কেউ বিয়ে-শাদী করেন নি। কেউ বিয়ে করলেও পরে কঠোর ব্রহ্মাচার্য গ্রহণ করেছিলেন! কেউবা সংসারত্যাগী। কেউবা ধ্যানী ছিলেন। কেউবা নির্জন সাধনার মাধ্যমে আত্মবিলয় লাভ করেছিলেন! কেউবা আধ্যাত্মিক আনন্দে আবিষ্ট হয়ে জগৎ-সংসারকে ভুলে ছিলেন।

আমাদের নবী ১১টি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর একজন পালক সন্তান ছিল। তিনি আমাদের মতই সমাজে বসবাস করতেন। তিনি ঘুমাতেন। খাদ্য গ্রহণ করতেন। স্ত্রীদের সাথে সময় অতিবাহিত করতেন। নিজ স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুতে কাঁদতেন। হাসি-মজাও করতেন মাঝে মাঝে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ছিলেন সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে। খেটে খুটে নিজের খাদ্য জোটাতেন।

সত্যি বলতে এই পারিবারিকতা-সামাজিকতা-গৃহিত্বই আমাদের নবীর এক বড় বৈশিষ্ট্য। আমাদের গর্ব আর শিক্ষার ক্ষেত্র। প্রয়োজন শুধু বস্তুবাদী-নাস্তিক্যবাদের চশমা ত্যাগ করে ইসলামের নবীকে ধর্মের প্রকৃত দর্শনের ক্ষেত্র থেকে মূল্যায়ন করা। তবেই নবীর ওপর আরোপিত ভুল ধারণাগুলো আমরা অপনোদন করতে সক্ষম হব এবং নবীর জীবন থেকে প্রকৃত নূর বা আলোকের উৎস খুঁজে পাব।

বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ম মানবজীবনের নিছক একটি অংশ। মানুষ একরকমের জৈব যন্ত্র। কাজ-কর্ম-দুঃখ-কষ্টের দোলাচলে মানুষ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায়। কখনো নিরাশ হয়ে পড়ে। স্থবিরতা দেখা দেয়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু অবস্তুগত মোটিভেশনের দরকার হয়, ধর্ম হলো মোটিভেশন।

আর ধর্মের প্রকৃত দর্শন অনুযায়ী ধর্ম জীবনের নিছক একটি অংশ নয়; বরং এই ক্ষণস্থায়ী অথচ সার্বিক জীবনাচার ও ও ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অঙ্গ বা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক! আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের যৌক্তিক প্রয়োগ আছে।
ইসলাম অনুযায়ী পলিটিক্স মানেই ম্যাকিয়াভেলিক ধোঁকাবাজি নয়। কৌটিল্যের কূটচাল নয়! ইসলামে পলিটিক্স, ইকোনমিক্স কিংবা জার্নালিজম সবই এথিক্সের সাথে জড়িত। আর এথিক্স এর ভিত্তি এখানে ধর্ম।
যাহোক, কথা হচ্ছে, মুহাম্মাদ (সা.) যে বিকশিত একত্ববাদী ধর্ম নিয়ে এসেছেন, সেটা একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। নেহায়াত কোন থিওরিটিকাল সায়েন্স নয় (অর্থাৎ শুধু একটি উচ্চ-মানস শ্রেণির বোধগম্য আধ্যাত্মিক শ্লোক এর সমস্টি নয়)।

ইসলামের আবেদন রয়েছে জ্ঞানী-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, পাপী-নিষ্পাপ, নারী-পুরুষ, আরব-অনারব, রাজা-প্রজা, রোগী-নিরোগ সবার প্রতিই।

অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে সারা দুনিয়া যখন একটি সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থার মুখাপেক্ষিতা অনুভব করছে, ইসলাম সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান; শুধু সাপ্তাহিক ‘ঝঢ়রৎরঃঁধষ জবভৎবংযবৎ’ নয়।

আমাদের নবী একটি গণমুখী জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। আর তাঁর মাঝে রয়েছে সেই জীবনব্যবস্থার বাস্তব ও জীবন্ত রূপ। প্রতিটি শ্রেণির মানুষের জীবনের প্রতি পদক্ষেপের প্রতিটি জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্নের জন্য নবী করিম (সা.)-এর জীবনে রয়েছে উত্তর। আমাদের জন্য নবী (সা.)-এর জীবনের কোন প্রেক্ষাপটই অপরিচিত নয়।

আমাদের নবী সমস্যা-দুঃখ-কষ্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবনের পরীক্ষার সমাধান করেন নি। তিনি মানব-পরিবার-সমাজ-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাসঙ্কুল ঘূর্ণিপাক আর জটের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করেই জীবনে জয়ী হয়েছেন। তিনি পারিবারিক কিংবা সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করেছেন। দারিদ্রের কষ্টকে মোকাবেলা করেছেন। তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়, সমস্যার মধ্যে থেকে সেগুলোর স্থায়ী সমাধান করাই মানবীয় দায়িত্ব। বস্তুজগতের মধ্যেই অধ্যাত্ম-জগতের সন্ধান দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।

উপমহাদেশের একজন আলেমের একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘রাসূল (সা.) মিরাজে গিয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করার পরেও আল্লাহর সান্নিধ্য ছেড়ে আবার বস্তুগত পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। আমি হলে কখনোই ফিরে আসতে সক্ষম হতাম না। আর এখানেই রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।’

এখানেই সাধারণ আধ্যাত্মিক পুরুষগণের সাথে রাসূল পাকের পার্থক্য। অপরদিকে অনেক মহাপুরুষই জীবনের কাঠিন্য আর বাস্তবতাকে বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাঁদের চোখে ঈশ্বরের দুনিয়া শুধুই তাঁদের মনমতই রোমান্টিক হবে! যখন তাঁদের মোহমুক্তি ঘটে তখন তাঁরা ‘নিষ্ঠুর’ বাস্তবতা থেকে পলায়ন করেছেন। বনবাসে গিয়েছেন। নিজ পরিবার ত্যাগ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অন্যদের ফেলে রেখে নিজেরা শান্তি খুঁজেছেন আর অত্যাচারী শাসকদের হাতে নিষ্পেষিত মযলুমদের জন্য কিয়াম করেন নি! কেউ কেউ বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন- ‘ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে পুষ্টিবিজ্ঞানের তত্ত্বকথা তুলে ধরা!’

তাঁদের জীবনে নেই যুলুম-পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আবেদন। কিংবা তা থাকলেও নেই মযলুমদের সমতাভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি গড়ে তোলার মূলমন্ত্র ও বিধিবিধান। অর্থাৎ তাঁদের জীবন বাস্তব সমাজের প্রেক্ষাপটে একপেশে, অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু ইসলামের নবীর জীবন সাধারণ মানুষকে এক্ষেত্রে আশার আলো দিতে পারে।

এতিমদের জন্য তিনি প্রেরণা; কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাপুরুষ হিসেবে তিনি নিজেই এতিমদের প্রতিনিধি। সাধারণ গণমানুষের মতই একজন তিনি।

আবার তিনি দরিদ্রপল্লির সন্তানও নন; বরং বিচিত্র, কিন্তু আমাদের পরিচিত এক পরিবেশে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কাবাঘরের খাদেমের বংশে জন্ম নিয়েও কখনো তিনি মেষ চড়িয়েছেন। কখনো দাদা মুত্তালিবের সাথে শান-শওকত-মর্যাদা উপলব্ধি করেছেন। আবার চাচা আবু তালিবের পরিবারের দারিদ্র দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মরুর দুরন্ত ছেলেদের মাঝে বেড়ে উঠেছেন। দুধ মায়ের সাথে ভিন্ন পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছেন আর দশ জন আরবের মতই! ব্যবসা করেছেন চাচার সাথে সাথে। যুদ্ধ দেখেছেন। কষ্ট দেখেছেন। দারিদ্র অনুভব করেছেন। আবার নিজে হেরা গুহায় আত্মমগ্ন হয়েছেন (নিজ দায়িত্বকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নয়!)।

সমাজের মানুষের সাথেই তিনি জীবনযাপন করেছেন! তাঁর জীবন আমাদের থেকে ভিন্ন অক্ষে ছিল না। তিনি জীবনে বাস্তব পরিস্থিতির পেক্ষাপটে কম-বেশি ৭০ এর মত যুদ্ধ করেছেন। কখনো ভালোবেসেছেন। কখনো কঠোরতা দেখিয়েছেন। শাস্তি দিয়েছেন। কখনো ক্ষমা করেছেন। কারণ, এসব বৈপরীত্ব নিয়েই এ জীবন। কেউ যদি ভালোকে ভালোবাসতে চায় তবে মন্দকে অবশ্যই ঘৃণা করতে হবে! পরম ভালোবাসা সম্ভব নয় এই আপেক্ষিকতার দুনিয়ায়।
‘অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে না!’ এটি একটি থিওরিটিকাল কথা। কিন্তু এতে মানব-সমাজে অশান্তির কোন সমাধান নেই। অপরাধ একটি ক্রিয়ার নাম। ক্রিয়া নিজে ঘটে না। একজন মানুষকে তার ফ্রি উইল দিয়েই ঘটাতে হয়। তাই, শুধু অপরাধকে ঘৃণা করাই যথেষ্ট নয়, অপরাধীকে করুণা আর ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে ঘৃণা করতে হবে। তা না হলে সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের কোন কার্যকরী পার্থক্য থাকবে না। এই ভিত্তিতে ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে সামাজিক শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

‘অহিংসা পরম ধর্ম!’- এটিও একটি থিওরিটিকাল সত্য। কিন্তু এর বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আবার ‘আমরা শান্তি চাই। যুদ্ধ চাই না।’- এটি একটি খোড়া একপেশে বাক্য। ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধ, হিংসা, হিংস্রতা, অশান্তিকে দূর করতে যুদ্ধবাজ, হিংস্র, অশান্তিকামী নিপীড়কের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হয়! মহাত্মা গান্ধীর অহিংস বাণীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করলেও বলতেই হবে, তিনি নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছেন, কঠোর হয়েছেন এবং এর যৌক্তিকতাও উপলব্ধি করেছেন।

কিন্তু ইসলামের নবী তাঁর সমগ্র জীবনে যুদ্ধ করেছেন অন্ধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসের পরাধীনতার বিরুদ্ধে। চিন্তার স্বাধীনতার জন্য। পৌরহিত্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যালেমের বিরুদ্ধে। শোষকের বিরুদ্ধে। তিনি সাধারণ মানুষ আর তাঁর নিজের মাঝে উপস্থিত সকল বস্তুগত ও অবস্তুগত বাধাকে সরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি যে কোরআন নিয়ে এসেছেন তা যেকোন সংস্কারমুক্ত স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষকেই পথ দেখাবে। মানুষের সাধারণ পথ প্রদর্শনে কোরআনের বাণী খুবই সহজ-সরল। আর জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য নবীর জীবন, তাঁর বাণী, তাঁর বংশধর এবং আলেমগণ রয়েছেন।

কোরআন থেকে যেমন সাধারণ মূর্খ কৃষক আলোকপ্রাপ্ত হবেন, তেমনিভাবে ইবনে সিনা, ইবনে রুশ্দ, ফারাবি, মোল্লা সাদরার মত চিন্তাবিদ-দার্শনিকগণ গভীর চিন্তার খোরাক পাবেন। একজন অধ্যাত্মবাদী, অতীন্দ্রিয়বাদীও আত্মার খাদ্য পাবেন। বিপ্লবী পাবে বিপ্লবের চেতনা। আবার খারাপ নিয়্যতের মানুষ কোরআন পাঠ করে অন্ধকারের আরো গভীরেই প্রবেশ করবে! (কোরআনের আয়াত : এই কোরআন মুমিনদের জন্য পাথেয় আর কাফেরদের জন্য ক্ষতির কারণ)। প্রত্যেকে তার যোগ্যতা, জ্ঞান ও চিন্তার স্তর, নিয়্যত অনুযায়ী কোরআন থেকে ফলাফল লাভ করবে।
অন্য মহাপুরুষদের সাথে ইসলামের নবীর আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। অন্য ধর্মের মহাপুরুষেরা বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটে তাঁদের ‘আধ্যাত্মিক’ জীবনধারা গ্রহণ করেছেন। যেমন, সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে যুদ্ধে প্রচুর মানুষকে হত্যা করেন। পরে তাঁর মনে হিংস্রতার বিরুদ্ধে, জীব হত্যার বিরুদ্ধে একটি চেতনা সৃষ্টি হয় এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

ইসলাম খোদামুখী ধ্যান, সাধনা, কঠোর আত্মসংযম ইত্যাদির বিরোধী নয়। বরং ইসলাম এগুলোর জেনারালাইজেশনের বিরোধী। কারণ, ইসলাম এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ্যে মূল্যায়িত হলে আমজনতা ঐ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতো না বরং ভীত হয়ে যেত। তাই নবী (সা.)-এর শিক্ষা হচ্ছে মধ্যপন্থার জীবন, যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য হেদায়াতের পথ।

কিন্তু, নবীর জীবনের সাথে এবং ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ ধরনের কতক আধ্যাত্মিক সাধকের ঘটনাও জড়িত, যাঁদেরকে নবী (সা.) নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের যোগ্যতা, তাঁদের ক্ষমতা আর ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে।
ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিগণ অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁদের জীবনেতিহাস আর জীবন শিক্ষা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উসমান বিন মাজউন (রা.) ছিলেন একজন সন্ন্যাসী-প্রায় মানুষ। তিনি এতটাই আত্মসংযম চর্চা করতেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলতে গেলে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মাংস খেতেন না। এমনকি ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও তিনি মদপান করেন নি। যদিও মহানবী (সা.) তাঁর মাত্রাতিরিক্ত আত্মসংযমের জন্য তাঁকে সতর্ক করতেন, তবুও উসমান বিন মাজউন আল্লাহ, তাঁর নবী ও নবীর আহলে বাইতের নিকট অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর এক পুত্রের নাম উসমান বিন মাজউনের প্রতি ভালোবাসাবশত রাখেন উসমান।

হযরত আবু যার গিফারি ছিলেন মরুদস্যু গোত্রের লোক। অথচ সত্যান্বেষী এই সাহাবী কঠোর আত্মসংযমী জীবন ধারা অনুসরণ করতেন। তিনি মহানবীর মৃত্যুর পর সমাজের ভোগবাদী জীবন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি। তাঁর প্রতি এমনকি তাঁর যামানার ইহুদি, খ্রিস্টানগণও মুগ্ধ ছিল। তিনি সকল ধর্মের সবার প্রতি সাম্যের ভিত্তিতে বিচার করতেন। প্রবলতম শত্রুকেও গালি দিতে কঠোর নিষেধ ছিল তাঁর অনুসারীদের প্রতি! সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিতেন এই মহাপুরুষ। তাঁর সম্প্রীতিবোধের বাণী প্রবাদতুল্য। জনগণের প্রতি ন্যায়শাসনের জন্য তিনি তাঁর প্রতিনিধি মালিক আশতারকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেটি জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের বাইরের দেয়ালে ইংরেজি অনুবাদে টানানো রয়েছে!

এই সাহাবিগণের অনেকেই নবীর হাতে প্রশিক্ষিত। এভাবে নবীর সাহাবীদের জীবনে রয়েছে ভিন্নমাত্রার শিক্ষা।
নবীর পারিবারিক জীবন আমাদের পারিবারিক জীবনের জন্য শিক্ষার উৎস। তাঁর পারিবারিক জীবনে কখনো স্ত্রী খাদিজা, উম্মে সালামা কিংবা কন্যা ফাতেমার সাহচার্য তাঁকে শান্তি দিয়েছে। আবার কখনো পারিবারিক সমস্যাগুলোকে সামাল দিতে হয়েছে ধৈর্য আর প্রজ্ঞার সাথে। কিন্তু তিনি পালিয়ে যান নি। তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে বিচলিত হলেও আত্মসমর্পণ করেন নি জীবনযুদ্ধে।

আমাদের নবী আর যেকোন মহাপুরুষের চেয়ে অনেক বেশি মযলুম-নির্যাতিত ছিলেন। সত্য সাধনার পথে মুনাফিকের কূটচক্রের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। সাম্রাজ্যবাদী, মূর্তিপূজারি পুরোহিত সমাজ তাঁকে বয়কট করেছিল। সেই অন্ধকূপ থেকেই তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন মানবতাকে। বাস্তবসম্মতভাবে। সহজ-সরল ও বোধগম্য ভাবে। মানুষের সাথে, সমাজের সাথে, রাজনীতি আর অর্থনীতির মধ্যে থেকে তিনি কূটজাল ছিন্ন করে সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ, কিন্তু তিনি কোন রোবোট ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষ। যিনি তাঁর মনো-দৈহিক চাহিদা পূরণ করেছেন সুন্দরতম স্বাভাবিক উপায়ে এবং আমাদেরকেও তেমনটাই শিক্ষা দিয়েছেন। যে যতটুক ধারণক্ষমতাস¤পন্ন, নবীর শিক্ষা তাকে ততটাই হেদায়াত দেবে। যার অন্তর যত গভীর তার অন্তরে ততদূর পর্যন্ত আলো প্রবেশ করবে। যার অন্তর যতটা পরিষ্কার তার অন্তর ততটাই আলোক প্রতিফলন করবে। নবীর হেদায়াত সাধারণতম মানুষ থেকে অসাধারণতম মানুষ পর্যন্ত! শেষকথা, ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক আত্মার সাধনার ধর্ম নয়। আবার নিজের প্রতি উদাসীন থেকে শুধু সমাজ-রাষ্ট্রমুখী সংশোধনের ধর্মও নয়; বরং ইসলাম হলো একই সময়ে ব্যক্তি ও সমস্টির আত্মিক-মনোদৈহিক-পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয়-জাগতিক উন্নয়নের মধ্যপন্থি ধর্ম, যেখানে ব্যক্তির ধর্ম আত্ম উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা আর সমাজের ধর্ম সামাজিক-রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির সকল প্রকার বিকাশের পথ সুগম করা।
অবিশ্বাসী কিংবা বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা এরকম সর্বব্যাপী ধর্ম চায় না। তারা চায় আংশিক এবং পঙ্গু ধর্ম যেগুলো তাদের শোষণব্যবস্থার ওপর বাধার সৃষ্টি করবে না। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্র তেমন আংশিক ক্ষেত্র বিশেষের জন্য নয়। ইসলামের নবীও আংশিক বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে প্রেরিত হন নি।

পরিশেষে আমরা নবী করিম (সা.)-এর সেই অমিয় হাদিসের কথা স্মরণ করব। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি তোমার দায়িত্ব রয়েছে। তোমার উচিত সেগুলো পালন করা।’

 

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

:

:

:

: