ইসলাম-পরিচিতি (৩)
ইবাদত ও আচার-অনুষ্ঠান
ইসলামসহ সব ঐশী ধর্মের মৌলতম বিষয় হলো তাওহীদ। কিন্তু অন্যান্য ঐশী ধর্মগুলোতে এবং ইসলামের কোনো কোনো ফিরকা (দল) ও মাজহাবে তাওহীদের বিষয়ে কিছু বিকৃতি সাধিত হয়েছে। তাদের একদল এক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করেছে আবার অন্যদল অবহেলা করেছে ও শিথিলতা দেখিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে যে সকল কাজ মানুষের মধ্যে তাওহীদের বিশ্বাসকে দৃঢ় ও তাকে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ পালনের দিকে পরিচালিত করে তা পছন্দনীয় এবং যা কিছু তাওহীদকে অস্বীকারে পর্যবসিত হয় ও তাওহীদে বিশ্বাসের দাবির আবশ্যকতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তা অপছন্দনীয় বলে গণ্য হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে মৌলবিশ্বাসের বিষয়সমূহের পাশাপাশি ব্যবহারিক জীবনে কিছু কর্ম আবশ্যক বলে গণ্য করা হয়েছে যা দ্বীনের শাখাগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। বারো ইমামি শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত শিক্ষায় নামায, রোযা, হজ, যাকাত, খোমস, জিহাদ, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ, তাওয়াল্লী (ইসলামের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে বন্ধুত্ব) ও তাবাররী (ইসলামের অমঙ্গলকামীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ)। কিন্তু আহলে সুন্নাতের কাছে উল্লিখিত বিষয়গুলোর কোনো কোনোটি গুরুত্ব লাভ করেনি।
ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক
বিশ্বের বৃহৎ যে ধর্মগুলো বিশাল এক জনগাষ্ঠীকে এক বিশ্বাসের আওতায় সমবেত করতে পেরেছে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনুসারীদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিদান করে থাকে। কিন্তু নিঃসন্দেহে তাদের সবাই এ বিষয়টির প্রতি একইরূপ গুরুত্ব দেয়নি। ইসলাম সমাজ সংস্কার ও সামাজিক সম্পর্ককে সুশৃ্ঙ্খল ও সুসংগঠিত করাকে তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে বিবেচনা করেছে ও এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। পবিত্র কোরআন রাসূলদের সাথে ঐশী গ্রন্থ ও মানদণ্ড প্রেরণের উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা বলে উল্লেখ করেছে। (সূরা হাদীদ/ ৫৭:২৫) ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা অর্থ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
পবিত্র কোরআন ও মহানবির সুন্নাতে বর্ণিত বিধিবিধান এবং এর অনুসরণে ইসলামি ফিকাহর (আইনশাস্ত্র ও বিচারব্যবস্থা) একটি বড় অংশ সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত। ইসলামি ফিকাহ সাধারণ ও রাষ্ট্রীয় আইনের-যা সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি নির্ধারণ করে-পাশাপাশি নাগরিক আইন এবং ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন আইনকেও–যা নাগরিক অধিকার ও সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি সুবিন্যস্ত করা সম্পর্কিত আইন-শামিল করে।
ইবাদাতগত বিষয় ও সামাজিক দায়িত্ব
ক. যাকাত
পবিত্র কোরআনে অসংখ্যবার নামাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশের পাশাপাশি যাকাত দানের বিষয়টি ইসলামের অন্যতম প্রধান নির্দেশ হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে। যাকাত শব্দটির আভিধানিক অর্থ (পরিশুদ্ধি) এবং পবিত্র কোরআনে একই অর্থে তা ব্যবহারের সমর্থন থেকে বোঝা যায় যাকাতের মাধ্যমে আর্থিক দানের যে কাজটি সংঘটিত হয় তার সাথে ব্যক্তির আর্থিক (সম্পদের) ও আত্মিক পরিশুদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে। এ কারণেই পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহের বাহ্যিক অর্থ থেকে প্রাথমিক যে ধারণা অর্জিত হয় তা থেকে বোঝা যায় নামায-রোযার মতো অন্যান্য ইবাদাতের ন্যায় যাকাতের সঠিকতার (আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার) জন্যও (তা আদায় করার/দেওয়ার সময়) আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির নিয়্যত থাকা বাঞ্ছনীয়।
যাকাত ব্যক্তিগত ইবাদাত বলে গণ্য হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকে মুসলমানদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ ও তা বণ্টনের একটি পথ বলে বিবেচিত হয়। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে যাকাত সংগ্রহকারীদের বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। (সূরা তাওবা/ ৯:৬০) এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যাকাত, এমনকি মহানবি (সা.)-এর সময়েও রাষ্ট্রীয় তহবিলের একটি উৎস বলে গণ্য হতো এবং একদল লোক তা সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
যাকাত মাথাপিছু বা স্বয়ং সম্পদের ওপর আরোপিত কর নয়; বরং সমাজের মানুষদের সঞ্চিত অর্থ ও উৎপাদিত নির্দিষ্ট কিছু বস্তুসামগ্রী ও পণ্যের ওপর আরোপিত কর। অন্যভাবে বললে, মুসলমানদের মধ্যে যেসব ব্যক্তির সঞ্চিত অর্থ বা উৎপাদিত পণ্য একটি নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছায় (বা তা অতিক্রম করে) তখন তাদেরকে ঐ অর্থ ও পণ্যের একাংশ যাকাত হিসাবে দিতে হবে। এর পরিমাণ বস্তু ও পণ্যভেদে বিশভাগের একভাগ (পাঁচ শতাংশ) থেকে এক দশমাংশ (দশ শতাংশ) হয়ে থাকে।
খ. জিহাদ
ইসলামি সংস্কৃতিতে জিহাদ সার্বিক অর্থে ইসলামের দিকে দাওয়াতের লক্ষ্যে চালানো যে কোনো সামরিক বা অসামরিক প্রচেষ্টাকে শামিল করে। পবিত্র কোরআনে জিহাদ শব্দটি কখনও আল্লাহর পথে সার্বিকভাবে যে কোনো প্রচেষ্টা চালানো অর্থে এসেছে। (সূরা আনকাবুত/ ২৯: ৬ ও ৬৯) কিন্তু জিহাদ এর সীমিত পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর পথে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জিহাদ সম্পর্কে কোরআনের আয়াতসমূহ মহানবি (সা.)-এর দাওয়াতের পরিবেশ ও অবস্থা অনুযায়ী অবতীর্ণ হয়েছে। মহানবি (সা.) মক্কায় অবস্থানকালীন সময়ে মুসলমানরা মুশরিকদের সাথে কোনোরূপ সামরিক (সশস্ত্র) সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। এসময়ে অবতীর্ণ কোরআনের আয়াতসমূহে মুশরিকদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিপরীতে মুসলমানদের ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে বলা হয়েছে।
তবে মক্কায় অবতীর্ণ কোনো কোনো আয়াতে তাত্ত্বিকভাবে জিহাদের বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা ইসলামি রাষ্ট্রের কাঠামোতে জিহাদের স্বরূপ ও পরিধিকে নির্ধারণ করে। (দ্রষ্টব্য: ফুরকান/ ২৫:৫২; শোয়ারা/ ২৬:২২৭) মদীনায় মুসলমানদের হিজরতের মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে সেখানে নতুন ধরনের এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হলো। প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী যে আয়াতটিতে প্রথম মুসলমানদের সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয় তা হলো সূরা হজের ৩৯ নং আয়াত।
মহানবি (সা.)-এর দশ বছরের মদীনার জীবনে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অন্যভাবে বললে ইসলামের প্রথম যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পাতাগুলোর একাংশ, এ যুদ্ধগুলোর ঘটনা দিয়েই সাজানো হয়েছে। ইসলামি সমাজে জিহাদের প্রতি সার্বিক দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয় যে, মুসলমানরা যে কোনো যুদ্ধকেই-তা যে লক্ষ্যেই সংঘটিত হোক-জিহাদ বলে গণ্য করেনি। জিহাদ কখনই বিরোধী ও শত্রুদের নিধন করা বা দেশজয়ের মাধ্যমে অন্যদের ধনসম্পদ হস্তগত করা নয়। বরং জিহাদ হলো তাওহীদী ও মানবিক মূল্যবোধসমূহের প্রতিরক্ষার সংগ্রাম ও ঐ মূল্যবোধগুলোকে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। একারণেই জিহাদ সবচেয়ে বড় ইবাদাত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মহৎ এক পন্থা বলে বিবেচিত হয়েছে।
নাগরিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিঅধিকার আইন
ক. পরিবার
মানব সভ্যতার ইতিহাসে পরিবার সমাজের ক্ষুদ্রতম একক হিসাবে সবসময় বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। পরিবার একদিকে যেমন দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসার প্রাণকেন্দ্র এবং শিশুদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্র। অন্যদিকে তেমনি এর অর্থনৈতিক ও জৈবিক প্রয়োজনের দিকও রয়েছে। পরিবারের এ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে ইসলাম পরিবারের প্রতি বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক ও আইনগত উভয় দিক থেকেই দৃষ্টি দিয়েছে। এ দিকগুলোর প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ইসলামি শিক্ষায় নারী ও পুরুষ এ দুলিঙ্গের মানসিক ও আত্মিক পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেক মানুষের বিপরীত লিঙ্গের সাথে আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। পবিত্র কোরআন একদিকে নারীদের পুরুষদের প্রশান্তির উপকরণ বলেছে (আ’রাফ/ ৭:১৮৯) ও রূম/ ৩০:২১) অন্যদিকে পুরুষদেরকে নারীদের ওপর দায়িত্বশীল এবং তাদের পরিচালকও অভিভাবক (সূরা নিসা/ ৪:৩৪) কখনও বা তাদের সাধারণ ও পারস্পরিক প্রয়োজনের বিবেচনায় পুরুষদেরকে নারীদের পোশাক ও আবরণ এবং নারীদের পুরুষদের পোশাক ও আবরণ হিসাবে অভিহিত করেছে।
ইসলাম আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জনের জন্য দুনিয়া ত্যাগকে অপরিহার্য শর্ত বলে গণ্য করেনি এবং মানুশের বস্তুগত ও পার্থিব প্রয়োজনের প্রতি বাস্তবসম্মত দৃষ্টি দিয়েছে। কোনো কোনো ধর্ম যে বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদকে একটি ধর্মীয় রীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে (সূরা হাদীদ. ৫৭:২৭) –এর ফলশ্রুতিতে বিবাহকে পুরোহিত ও আধ্যাত্ম পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ গণ্য করেছে- ইসলাম তা একদল মানুষের সৃষ্ট বিদআত (উদ্ভাবিত বিকৃতি) বলেছে। সাধারণভাবে মুসলমানদের কাছে বিবাহ মহানবি (সা.)-এর অপরিহার্য সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় এবং অবিবাহিত থাকার বিষয়টি একটি অপছন্দনীয় কর্ম বলে গণ্য হয়ে থাকে। মহানবি (সা.) থেকে এ হাদীসটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, তিনি বলেছেন, ‘বিবাহ আমার সুন্নাত আর যে তা পরিত্যাগ করল সে আমার থেকে নয় (আমার সাথে সম্পর্কহীন)।’
খ. অর্থনৈতিক সম্পর্ক
ইসলাম এমন এক সমাজে আগমন করেছিল যেখানে বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, আইন ও বিধানপ্রচলিত ছিল। এগুলোর কোনো কোনোটি (সুস্থবিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে) পছন্দনীয় ছিল আবার কোনো কোনোটি ছিল অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়। ইসলাম ঐসব নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় রীতিনীতির সংশোধনকে নিজের মিশনের লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে। কিন্তু ঐ সমাজে প্রচলিত পছন্দনীয় বিধানগুলোকে বহাল রাখে। একারণেই দেখা যায় ইসলামের আইন ও বিধিবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ পূর্বে বিদ্যমান ও প্রচলিত আইনের সমর্থন (সত্যায়ন) ও অব্যাহততা। ইসলাম কেবল যেসব ক্ষেত্রে সংশোধন বা রহিত করার প্রয়োজন ছিল তা সংশোধিত বা রহিত করেছে অথবা নতুন বিধান প্রণয়ন করেছে।
ইসলাম-পরিচিতি (৩) | |