জাফরান চাষ উৎসব
মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ইরানে জাফরান চাষ উৎসব পালিত হয়।
জাফরান। বিশ্বের সবচেয়ে দামি একটি মশলার নাম। যাকে অনেকে ‘লাল স্বর্ণ’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। তবে অত্যন্ত দামি এই মশলার উৎপাদন সহজ নয়। আবহাওয়াগত বৈচিত্র্য, উর্বর মাটি এবং কষ্টসহিষ্ণু পরিশ্রমী মানুষের কাজ জাফরান চাষ। আর ইরানের পরিশ্রমী কৃষকদের কল্যাণে সেদেশের মাটি হয়ে উঠেছে আল্লাহর নিয়ামতে পরিপূর্ণ। খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই তাই বিচিত্র উদ্ভিদের চাষ হয়ে আসছে ইরান ভূখণ্ডে। বলা হয়ে থাকে যে,ইরানিরাই সর্বপ্রথম জাতি যারা এসব মূল্যবান উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে এবং এগুলোর চাষবাস করে এসেছে দীর্ঘকাল আগে থেকে।
ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহ এবং হামাদানের আলভান্দ পাহাড়ের পাদদেশে এসব উদ্ভিদের চাষ করা হতো। এই এলাকাটিকেই জাফরান নামক মূল্যবান উদ্ভিদ চাষের মূল কেন্দ্র হিসেবে মনে করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৯ অব্দ থেকে ৭২৮ সালের মধ্যে মাদদের শাসনামলে এখানে এই উদ্ভিদের চাষ হতো। সময়ের পরিক্রমায় জাফরান চাষের কাজ যে কেবল ইরানের অন্যান্য শহরে ব্যাপ্তি লাভ করেছে তাই নয়,বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাফরান কেনাবেচা বা বাণিজ্যের ফলে অন্যান্য এলাকার লোকজনও এই উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে।
ইতিহাসবিদগণ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে ইরানে আলেকজান্ডারের হামলার ইতিহাসের সঙ্গে গ্রিস,রোম এবং চীনের এই মূল্যবান উদ্ভিদ জাফরানের পরিচিতির একটি সম্পর্ক রয়েছে।
বর্তমানে ইরানের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব এলাকায় জাফরানের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের মধ্যে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের জাফরান চাষের অন্যতম সূতিকাগার হিসেবে সারা বিশ্বেই খ্যাতি রয়েছে। সুস্বাস্থ্য ফুল, মশলার রাজা,লাল সোনা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত এই জাফরান। উদ্ভিদ ও কৃষিবিদদের দৃষ্টিতে এই জাফরানের বিচিত্র গুণাগুণ রয়েছে। জাফরানের পেঁয়াজ লাগানোর সময় হলো শরৎকাল। পেঁয়াজ থেকে পাতার বিকাশের সময় হলো শীতকাল। আর বসন্তকাল হলো জাফরানের কেশর তোলার সময়। জাফরান তোলার সময় দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে এই দৃশ্য দেখার জন্য। যেসব এলাকায় জাফরানের চাষ হয় সেসব এলাকা এ সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
জাফরানের ফুল বেগুনি রঙের। লাল রঙের লম্বা পুংকেশর হয় এই ফুলের। মাত্র তিনটি পুংকেশর হয় একটি ফুলে। এই কেশরগুলোই জাফরান নামে পরিচিত। আর বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মশলা জাফরান এই কেশর থেকেই উৎপন্ন হয়।
সবচেয়ে প্রাচীন তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী জাফরান ব্যবহারের ইতিহাস হাখামানেশি যুগ মানে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ থেকে ৫৫০ সাল পূর্বেকার। এ সময়কার একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ইরানি বাদশাহের দরবারে আনুমানিক এক কিলোগ্রাম জাফরান ব্যবহৃত হতো। বাদশাহের দরবারের চাহিদা অর্থাৎ এক কিলোগ্রাম জাফরান সংগ্রহ করতে দেড় থেকে দুই লাখ জাফরান ফুলের প্রয়োজন পড়ত। দেড় লাখ ফুল তুলতে একজন শ্রমিকের চল্লিশ ঘণ্টা সময় লাগত। সারা বিশ্বে আনুমানিক ২০০ থেকে ৩০০ টন জাফরান উৎপন্ন হয়। এর প্রায় নব্বই শতাংশই উৎপন্ন হয় ইরানে। আড়াইশ’ টন জাফরানের জন্য ২৫ মিলিয়ন টন জাফরান ফুলের প্রয়োজন।
আগেই বলা হয়েছে যে জাফরান একটি মূল্যবান উদ্ভিদ। এই জাফরান ঔষধ শিল্পসহ খাদ্য শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে ইরানের বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ জাকারিয়া রাজি, আবু আলী সীনা এবং আবু রেইহান বিরুনির মতো মহান মনীষিগণ জাফরানের ওষুধি গুণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত রেখে গেছেন। বহু রোগের নিরাময়ে এই জাফরান ব্যবহার করেছেন এবং ব্যবহার করার কথা বলে গেছেন তাঁরা। বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান দুরারোগ্য রোগ আলজেইমার, ক্যানসার কিংবা পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসায় এই জাফরান খুবই কার্যকর।
ইরানের ২২টি প্রদেশে জাফরান চাষ হয়। বর্তমানে জাফরান শিল্পে দেশব্যাপী ২ লাখ লোক কাজ করেন। ফসলপূর্ব, ফসলকালীন, ফসলোত্তর, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্যাকেজিং চেইনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা কর্মরত রয়েছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে দামি মশলাটি ইরান থেকে ৪০টি দেশে রপ্তানি হয়। ইরানি জাফরানের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ স্পেন, ভিয়েতনাম, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
জাফরান চাষ উৎসব | |