নিজামি গাঞ্জাভি
জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ ইলিয়াস ইবনে ইউসুফ ইবনে জাক্কি গাঞ্জাভি ছিলেন ১২শ শতাব্দীর পারস্যের একজন মুসলিম কবি। নিজামিকে পারস্য সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্টিক মহাকবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়,যিনি ফারসি মহাকাব্যে একটি কথ্যরূপ ও বাস্তববাদী শৈলী নিয়ে আসেন। তাঁর রচনা আফগানিস্তান, আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, ইরান, কুর্দিস্তান অঞ্চল এবং তাজিকিস্তানে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
নিজামি শিশুকালেই এতিম হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মামা খাজা উমর তাঁকে লালন-পালন করেন এবং তাঁকে চমৎকার শিক্ষা প্রদান করেন। তাঁর মা রাইসা ছিলেন কুর্দি বংশোদ্ভূত। তাঁর পিতার নাম ছিল ইউসুফ। তিনি সম্ভবত ইরানের কোম নগরীর অধিবাসী ছিলেন।
নিজামি ছিলেন একজন বিদ্বান কবি এবং গীতিমূলক ও সংবেদন শৈলীর পণ্ডিত ব্যক্তি। নিজামির অসাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কবিরা অনেক বিষয়েই পারদর্শী হবেন বলে আশা করা হয়ে থাকে;কিন্তু নেজামি একেবারেই অন্য ধরনের ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল আরবি ও ফারসি সাহিত্য এবং মৌখিক ও লিখিত জনপ্রিয় ও স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথেই সম্পূর্ণ পরিচিত ছিলেন না,বরং গণিত,জ্যোতির্বিদ্যা,জ্যোতিষবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা,কোরআনের তাফসীর, ইসলামিক তত্ত্ব ও আইন, ইরানি পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তি,ইতিহাস,নীতিশাস্ত্র, দর্শন, রহস্যবিদ্যা, সংগীত ও ভিজ্যুয়াল আর্টের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাথেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর দৃঢ় চরিত্র,সামাজিক সংবেদনশীলতা, মৌখিক ও লিখিত ঐতিহাসিক বিষয়াবলির জ্ঞান,সেই সাথে তাঁর সমৃদ্ধ পারসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইসলাম-পূর্ব এবং ইসলামি ইরানকে সাহিত্যের একটি নতুন মান নির্মাণে একতাবদ্ধ করে। সে সময়ের ইরানি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন হওয়ায় তিনি কেবল ইসলাম-পূর্ব ও ইসলামি ইরানের মধ্যেই নয়, বরং ইরান ও সমগ্র প্রাচীন বিশ্বের মধ্যেও একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন।
নিজামি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গভীর বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার যুগে বাস করতেন,যা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়;কিন্তু তাঁর জীবন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক বা তাঁর কাজের সুনির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়,কারণ, তাঁকে ঘিরে অনেক কিংবদন্তি তাঁর পরবর্তী জীবনীকাররা রচনা করেছেন। তিনি তাঁর কবিতাগুলো এই অঞ্চলের বিভিন্ন শাসকদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন যেমনটি সে সময়ের মহান কবিদের রীতি ছিল। নেজামী মসনভি শৈলীর (দ্বৈত-ছন্দযুক্ত পদ) একজন ওস্তাদ ছিলেন।
রচনা
নিজামির সবচেয়ে বড় কাব্যকীর্তি ‘খামসায়ে নিজামি’,যা পাঞ্জগাঞ্জে নিজামি বলেও পরিচিত। আরবিতে খামসা অর্থ পাঁচ আর ফারসিতে বলা হয় পাঞ্জ। গাঞ্জ এর অর্থ ধনভাণ্ডার। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় পাঁচ ধনভাণ্ডার। নানা উপাখ্যান নিয়ে গীতি কবিতার বয়েতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
‘খামসা’র অন্তর্ভুক্ত পাঁচ কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে :
১. মাখযানুল আসরার (রহস্যসমূহের ভাণ্ডার) : এতে রয়েছে আনুমানিক ২২৬০ বয়েত বা দ্বিপদী শ্লোক এবং তা ২০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। এর মূল বিষয়বস্তু চরিত্র,উপদেশ ও হিকমত বা তত্ত্বজ্ঞান। ৫৭০ হিজরিতে এর রচনা সমাপ্ত হয়।
২. খসরু ও শিরীন : আর্মেনিয়ার রাজকুমারী শিরীন শাহদুখতের প্রতি সাসানি বাদশাহ খসরু পারভেজের প্রেমের আলেখ্য নিয়ে রচিত। এই কাব্যগ্রন্থের বয়েত বা দ্বিপদী শ্লোকের সংখ্যা ৬৫০০। রচনাকাল ৫৭৬ হিজরি।
৩. লাইলি ও মজনূন : নিজামির আগেও ফারসি কবিতা ও সাহিত্যে লাইলি-মজনূন এর চর্চা ছিল। কিন্তু নিজামিই প্রথমবারের মতো লাইলি ও মজনূন এর প্রেমকাহিনীকে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত করেন,যার কলেবর ৪৫০০ বয়েত। আরবের জাহেলি যুগে সাদ এর মেয়ে লাইলির সাথে আমেরি গোত্রের কায়স আমেরি বা মজনূন এর মর্মস্পর্শী বেদনাময় প্রেমের আলেখ্য নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থটি রচিত। ৫৮৪ হিজরিতে এর রচনা সমাপ্ত হয়।
৪. হাফ্ত পায়কর : এটি মূলত বাহরাম গুরের রূপকথার ইতিকথা।
৫. ইস্কান্দারনামা : এটি ‘কারাপনামা’ ও ‘ইকবালনামা’ নামে দুই খণ্ডে বিভক্ত। ৬০০ হিজরির দিকে এই কাব্যগ্রন্থ রচনা করা হয়। এতে বয়েতের সংখ্যা দশ হাজার পাঁচ শত।
নিজামির রচনাবলির মধ্যে আরো রয়েছে ‘দীওয়ান’ বা কাব্যগ্রন্থ- যা হলো কাসিদা,গজল,কিতআ ও রূবাইয়্যাত ধরনের কবিতার সমষ্টি।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে পারস্য ও মুঘল দরবারে আঁকা ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্মের একটি জনপ্রিয় বিষয় ছিল ‘খামসা’। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের জন্য নিজামির ‘খামসা’ নিয়ে একটি চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে কবি নিজামির একটি পোর্ট্রেট রয়েছে।
নিজামি গাঞ্জাভি | |
রচনাকাল : ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দী | |
রচনা : মাখযানুল আসরার, খসরু ও শিরীন, লাইলি ও মজনূন, হাফ্ত পায়কর, ইস্কান্দারনামা |