এজেন্সি
চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আলরাজি

চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আলরাজি

চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আলরাজি

পারস্যে ‘অনুবাদ আন্দোলন’ শুরু হওয়ার পর আব্বাসি যুগের গোড়ার দিকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ গ্রিক, সুরইয়ানি (প্রাচীন সিরীয়), পাহলাভি, সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষা থেকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে তা ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর ফলে গ্রিক দর্শনের নিদর্শনগুলো মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামি বিশ্বে এ সকল রচনা অনুবাদের পেছনে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। তবে এ সবের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন শাখার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার সাথে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের সমন্বয় সাধন করা। মূলত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কর্মগুলোর অনুবাদের মাধ্যমে ইসলামি চিন্তাদর্শনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের উন্মেষ ঘটে। এ ধারার কর্মতৎপরতা দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিষয়গুলো ছাড়াও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গবেষকদের আগুয়ান হতেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পারস্যের বিজ্ঞানমনস্ক মুসলিম দার্শনিক ও পণ্ডিতগণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন; বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁরা এক অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে যান।
উল্লেখ্য যে,মুসলমানগণ গ্রিকদের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথেই চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁদের জ্ঞানানুশীলনের সূচনা ঘটে। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রিক পণ্ডিতদের চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ও আয়ুর্বেদিক গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাবিদ গ্যালেন (এধষবহ, ১২৯-২১৬খ্রি.) যাঁকে ফারসি, আরবি ও উর্দু ভাষায় জালিনুস বলা হয়; তাঁর রচিত চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো পারস্য ও আরব সমাজে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মূলত তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় বিদ্যার উপর নির্ভর করেই মুসলমান চিকিৎসগণ চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁদের জ্ঞানানুশীলন শুরু করেন। গ্যালেনের রচনাসমগ্র সর্বপ্রথম আরবিতে অনুবাদ করেন বিখ্যাত সিরীয় অনুবাদক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী হুনায়েন ইবনে ইসহাক আল ইবাদি (৮০৯-৮৭৩ খ্রি.) যিনি তৎকালীন চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

এসব মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধুনাকালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃত হিসাবে অম্লান হয়ে আছেন। বিশ্ববিশ্রুত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আলরাজি (৮৫৪-৯২৫/৯৩২ খ্রি.) হলেন তাঁদের অন্যতম-যিনি ইউরোপে রাজেশ (জযধুবং) নামে পরিচিত।
মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলরাজি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ ও রসায়নবিদ। আলরাজি ইরানের প্রসিদ্ধ রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি আলরাজির প্রবল ঝোঁক ছিল। আর এ কাণেই তাঁর শৈশবের একাংশ কাটে গান চর্চায়। এরপর তিনি বিদ্যান্বষণে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ঘুরে ঘুরে বিদ্যার্জনের বড় কৌতুহল ছিল আলরাজির। হঠাৎ একদিন তিনি রেই শহরের একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। সেখানে ব্যাধিগ্রস্ত অসংখ্য লোক দেখে তাঁর হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকেই তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অধিক পড়াশুনার সিদ্ধান্ত নেন।

তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁর এ বিদ্যান্বেষণে আগ্রহ দেখে তাঁকে বাগদাদে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। আলরাজি বন্ধুর এ পরামর্শ অকপটে মেনে নেন এবং প্রায় বিশ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বাগদাদ গমন করেন। সেখানে তিনি বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের নিকট চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। এ অভিজ্ঞ শিক্ষদের সংস্পর্শে তিনি বহুদিন কাজ করেন এবং অল্প সময়েই মেধা ও মননের উৎকর্ষ সাধন করে চিকিৎসক হিসাবে সুপরিচিত হন। এরপর তিনি পুনরায় রেই শহরে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করেন।
আলরাজির উপলব্ধিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর ও সূক্ষ্ম। একটি বর্ণনা থেকে তা সহসা বুঝা যায়। আলরাজি নিজ শহরে ফিরে আসার কয়েক বছর পর পুনরায় যখন বাগদাদে ফিরে যান তখন বাগদাদে একটি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য সেখানকার অধিবাসীরা জল্পনা কল্পনায় মত্ত ছিল। হাসপাতালটি কোথায় স্থাপন করা যায় সে ব্যাপারেও তারা ছিল চিন্তিত। আলরাজি বুদ্ধিমত্তার সাথে সে সমস্যার সমাধান দেন। তিনি কতগুলো কাঁচা গোশতের টুকরো নিয়ে বাগদাদের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে দিলেন এবং তা কয়েকদিন ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দিলেন। একটি স্থান ছাড়া সব জায়গায় গোশতের টুকরোগুলো অতি তাড়াতাড়ি পচে গিয়েছিল। যে স্থানটিতে দীর্ঘ সময় ধরে গোশতের টুকরো ভালো ছিল আলরাজি সেখানে হাসপাতাল স্থাপনের পরামর্শ দিলেন। হাসপাতাল স্থাপিত হওয়ার পর তাঁকেই সে হাসপাতালের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হলো।
তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সর্বাগ্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠগ্রন্থ আল হাভি (ঈড়হঃরহবহং) এবং এরপর রসায়নশাস্ত্রের র্সেরুল আসরার (রহস্যাবলির রহস্য) শীর্ষক গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর শেষোক্ত গ্রন্থটি তদানীন্তন সময়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
আলরাজির শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূণ অবদান হলো আল হাভি। এ গ্রন্থে তিনি প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এতে আরো রয়েছে গ্রিক, সিরীয়, আরব্য, পারস্য ও ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তারিত আলোচনা। এরপর গ্রন্থটিতে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেন। এ গ্রন্থটি প্রায় ২০টি পুস্তিকার সমন্বয়ে প্রণীত। এর নবম পুস্তিকাটি খ্রিস্টীয় ষোলো শতক পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এ গ্রন্থটিতে তিনি মেডিসিন সম্বন্ধীয় অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ও তুলে ধরেন। এটি রচনা করতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ থেকে ১৫ বছর। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি তাঁর সাধনা চালিয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত লিখতে শুরু করেন। এমনি করে ধীরে ধীরে তিনি অন্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত আলরাজি কখনো ক্ষান্ত হননি। তিনি লেখার কাজ চালিয়ে গেলেন অন্যভাবে। তিনি বলতেন আর তাঁর ছাত্ররা তা লিখে রাখত। যখন তিনি মারা গেলেন তখন তাঁর ছাত্ররাই এ আল হাভির কাজ সমাপ্ত করেছিল। এসব বই ছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করে গেছেন- যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজও অনুসৃত হচ্ছে।
আলরাজি সবসময় বলতেন : ‘মানুষের অসুস্থতার অন্যতম কারণ হলো তারা অসুস্থ অবস্থায় বেশি অস্থিরতায় ভোগে।’ তিনি চিকিৎসকদের এই বলে অনুরোধ করতেন; যাতে তাঁরা রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। তাহলে রোগীদের অস্থিরতা এবং বিষণ্নতা কেটে যাবে। তিনি রোগীদের ভয়ভীতি, অস্থিরতা ও বিষণ্নতা দূর করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।
একদা খোরাসানের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাক অসুস্থ হয়েছিলন। তিনি এতটা অসুস্থ ছিলেন যে, দাঁড়াতে পারতেন না এবং হাঁটতেও পারতেন না। আলরাজি তাঁর চিকিৎসার ভার হাতে নিলেন। তিনি তাঁকে বললেন : ‘এখন গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন।’ আশপাশ থেকে মানুসর ইবনে ইসহাকের কর্মচারীদের তিনি সরিয়ে দিলেন। এরপর আলরাজি হাতে একটি ছুরি নিয়ে মানসুরের দিকে এগিয়ে গেলেন। মানসুর এ অবস্থা দেখে ভীত হলেন এবং লাফ দিয়ে গোসল খানার বাইরে চলে এলেন। তিনি যখন দৌড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন আলরাজি তাঁকে বললেন : ‘এখন আপনি দাঁড়াতেও পারেন এবং হাঁটতেও পারেন। আপনি এখন সুস্থ, কিন্তু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।’
তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর অন্যতম গ্রন্থ হলো কিতাব আল মানসুরি। এ গ্রন্থটি তিনি খোরাসানের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাক সামানিকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ গ্রন্থটিতে শরীরে যে নানা ধরনের ইনফেকশন হয় তার প্রতিকার নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থটি বিশ্বের বহ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ গ্রন্থটি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো।
প্রথম দিকে তিনি আল-কেমি (মধ্যযুগীয় রাসায়নশাস্ত্র), গণিতশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিশেষ করে আল-কেমি তথা রসায়নের উপর অধিক বুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি রসায়নশাস্ত্রের উপর র্সেরুল আসরার (রহস্যাবলির রহস্য) শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন যাকে ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ংবপৎবঃং বা গোপন তথ্যনির্ভর পুস্তক বলা হয়ে থাকে। তৎকালীন সময় এ গ্রন্থটি বেশ পরিচিতি লাভ করেছিল। আমরা অনেকেই জানি না যে, এ গ্রন্থ দিয়েই আজকের রসায়নবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল।
শল্য চিকিৎসার প্রাণপুরুষ আলরাজিই প্রথম চিকিৎসক যিনি হাম ও গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসাবে চি‎িহ্নত করেছিলেন। তাঁর রচিত আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ নামক গ্রন্থে তিনি হাম ও গুটি বসন্ত সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপক আলোচনা করেছেন। সে সময়ে গুটি বসন্ত মহামারি আকারে গ্রামের পর গ্রাম মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াতো। আলরাজি ছিলেন গ্রিক দর্শনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী। তিনি গ্রিক ভাষায় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করে ও নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে গুটি বসন্ত প্রতিরোধের কার্যকরি উপায় ব্যাখ্যা করেন। তিনি তাঁর সারাজীবনের প্রাপ্ত জ্ঞান ও গবেষণা একত্র করে এ গ্রন্থটি লিখেন। যেখানে তিনি বলেন : ‘কিছুদিন আগেও বুখারার হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। তাই সাধারণ লোকদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।’ এ গ্রন্থটি ল্যাটিন ও ইউরোপের প্রায় সকল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৪৯৮ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রন্থটির ইংরেজি সংস্করণ প্রায় চল্লিশবার প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেনো পাথর হয় এ সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক ও গবেষণালব্ধ পুস্তিকা রচনা করেন। লাশ কাটা সম্পর্কেও তাঁর রচিত পুস্তিকা রয়েছে।
দীর্ঘদিন বাইরে জীবনযাপন করার পর বৃদ্ধ বয়সে আলরাজি পুনরায় রেই শহরে ফিরে এলেন। যদিও তিনি অন্ধ ছিলেন কিন্তু তাঁর দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করার জন্য তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও ছাত্ররা সদা প্রস্তুত ছিল।
আল রাজি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০টির অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই তিনি গবেষণালব্ধ পুস্তিকা লিখে গেছেন। এছাড়া তিনি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন ও পরিশোধন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
আলরাজি উচ্চমার্গের একজন দার্শনিকও ছিলেন। নানা মতবিরোধের কারণে তাঁর দার্শনিক রচনাবলি ব্যাপক প্রসারতা লাভ করেনি। আলরাজির দার্শনিক গুরুত্ব স্পষ্টত ইসমাইলি সম্প্রদায়ের চিন্তাধারার সাথে যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। এ দলের বড় মাপের পণ্ডিত তথা মোহাম্মাদ র্সাখে নিশাপুরি ও হামিদ কেরমানির সাথে তাঁর দার্শনিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতবিরোধ ছিল। যদিও তাঁদের বেশিরভাগ মতবিরোধ ও বিতর্ক ছিল রসায়নশাস্ত্রীয় বিষয়ের ওপর। আলরাজি আধ্যাত্মিক ও রহস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃতির দৃশ্যমান বিষয়গুলোর পরিচিতি তুলে ধরার বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু দার্শনিকগণ সময়, প্রকৃতি, আত্মা ও নবুওয়াতের ক্ষেত্রে রাজির চিন্তাদর্শনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় দার্শনিকদের কাছ থেকে সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। নবুওয়াত সম্পর্কিত রচনার কারণে তাঁকে নিন্দা আর সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে নবুওয়াত সম্পর্কিত তাঁর কোনো রচনারই অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনেকেই এ বিষয়টিকে দর্শন বহির্ভূত বিষয় বলে মনে করেছেন। মোটকথা, তাঁর ধর্মীয় ও মরমি মতবাদগুলো প্লেটো ও ইরানে প্রাচীন ধর্মীয় মতবাদকে ধারণ করে আছে।
বিশাল জ্ঞানের অধিকারী আলরাজি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। তিনি গরিবদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ বিতরণ করতেন। তিনি যেমনি ছিলেন বিদ্বান তেমনি ছিলেন পরহিতৈষী ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। বাগদাদ নগরীতে তাঁর একটি পরীক্ষারগার ছিল। তাঁর নামে ইরানে রাজি ইন্সটিটিউট ও ইরানের কেরমানশাহ শহরে রাজি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট আলরাজিকে স্মরণ করে রাজি দিবস পালন করা হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলরাজির অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহের কারণে তাঁকে আরব্য মেডিসিনের পিতা বলা হয়। তিনি আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। তাঁকে ব্যতীত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র
১. আবদুল মওদুদ (১৯৮০ খ্রি.), মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
২. আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.), ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস (বাংলা ভাষায় অনূদিত), আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
৩. মো. ফজলুর রহমান মুনশী (১৯৯৭ খ্রি.), বিশ্বের মুসলিম মনীষীদের কথা, বার্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
৪. সৈয়দ হোসেন নসর (২০০৫ খ্রি.), তিনজন মুসলিম মনীষী, (অনুবাদ: মহীউদ্দীন), দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৫. নিউজ লেটার, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার মুখপাত্র।
৬. Edward G. Browne (1969), A literary History of Persia, (Vol.-I), Cambridge University press, London
৭. https://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_ibn_Zakariya_al-Razi

লেখক: ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী, অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আলরাজি
আল হাভি

ইসলামিক কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন অর্গানাইজেশন হল ইরানি সংস্থাগুলির মধ্যে একটি যেটি সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের সাথে অধিভুক্ত; এবং 1995 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[আরও]

:

:

:

: