এজেন্সি
মেহেরদাদ আভেস্তার বাচনভঙ্গি ও কাব্যরীতির প্রতি এক নজর

মেহেরদাদ আভেস্তার বাচনভঙ্গি ও কাব্যরীতির প্রতি এক নজর

মেহেরদাদ আভেস্তার বাচনভঙ্গি ও কাব্যরীতির প্রতি এক নজর

ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ী

মেহেরদাদ আভেস্তা অত্যন্ত শক্তিমান কবি ও দক্ষ গবেষক ছিলেন। কাব্য বিশ্লেষণ ও সমালোচনায় তাঁর দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত প্রখর। সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন কাসিদা রচনায় তিনি খোরাসানী কাব্যরীতির অনুসারী ছিলেন। রুদাকী সামারকান্দী, নাসের খসরু, উনসূরী, মসউত সাআদ সালামান, খাকানী, মনুচেহের দামগানী, মালেকুশ শোয়ারা বাহার প্রমুখের কবিতার তিনি প্রশংসা করেছেন। এক কাসিদায় তিনি হিজরি ৫ম শতাব্দীর খোরাসানী কাব্য রীতির কাসিদা গায়ক কবি নাসের খসরু কুবাদিয়ানীকে সম্বোধন করে বলেন :

ای یگانه هنر ای ناصر بن خسرو

که نیامد به سخن هیچ کست ثانی

من و این طبع گهربار، تو را مانم

تو و آن درد روانکاه مرا مانی

ওহে শিল্পকলার একক কীর্তি

নাসের বিন খসরু!

কথার শিল্পে আসে নি তোমার বিকল্প কেউ

আমি এবং রত্নসম এই শিল্পরুচি তোমার মতোই

তুমি এবং হৃদয়বিদায়ী সেই ব্যথা

আমার মতোই।

আভেস্তার কাব্য সংকলন (راما) রামা থেকে সংকলিত, পৃ. ৩৭০।

আভেস্তা খোরাসানী কাব্যরীতিতে কাসিদা লেখার পাশাপাশি দার্শনিক বিষয় চর্চা ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ চিন্তাধারা ব্যাখ্যার প্রয়াস পান। কোথাও কোথাও অত্যাচারিত দুঃখী মানুষের ব্যথা-বেদনা ব্যক্ত করেন। একই সাথে অতি সূ² ও সুন্দর কবিতারও স্বাক্ষর রাখেন। তিনি গেয়েছেন :

فری شهید و عز واعتلای او

کرامت و کمال و کبریای او

ولایت و سرود جانفزای او

شهادت و حماسۀ ولای او

چه گوهری که خاک را بدل کند

به گرمی و به نور، کیمیای او

 

সাবাস শহীদ তার মর্যাদা ও উচ্চতা

বুজর্গী, পূর্ণতা আর মহীয়ান সত্তা

প্রাণ জাগানো বন্ধুত্ব ও গানের মূর্ছনা

শাহাদত ও বন্ধুত্বের অসীম ব্যঞ্জনা

কি রত্ন যে মাটিকে বদলায় আমূলভাবে-

উত্তাপে, আলোক মালায় যার পরশ মণি।

আমরা বলেছি যে, ‘কাসিদা’ রচনায় আভেস্তার অনুসৃত কাব্যরীতি হলো সাবকে খোরাসানী কাব্যরীতি। হয়ত তিনিই সর্বশেষ প্রতিভা ,যিনি এই কাব্যরীতিতে কীর্তি রচনা করে গেছেন।

چو یادی این منم از شهسواران مانده در این ره

چنان چون آتشی از کاروان رفته من تنها

এই পথে আমি যেন সেই বীর অশ্বারোহী

দৃঢ় চিত্ততাই রয়েছে যাদের স্মৃতি ছায়ায়।

আমি যেন সেই ধূমায়িত আগুন একাকী

কাফেলা যাওয়ার পর পড়ে থাকে যা পথের ধারে।

তিনি এমন শব্দ ও পরিভাষারও ব্যবহার করেন, যা হিজরি চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে ফারসি দারিতে কাব্য সাহিত্যের সূচনাকালের চিত্র ও রূপকল্প স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন : بارگی (বারাগী) এর মতো শব্দের ব্যবহার যার অর্থ ঘোড়া, جوشن  (জাওশান) বর্ম, شبرنگ (শাবরাঙ্গ) কালো প্রভৃতি শব্দ। যেগুলোর ব্যবহার বর্তমান নেই। কেবল হিজরি তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের কবিদের কাসিদায় তা দেখা যায়। আভেস্তা বলেন :

بارگی شبرنگ من، در جوشنی،...

دیو تندربانگ پولادین تنی

چون گسسته پایبند و سلسله

از طلسم قرنها، اهریمنی...

আমার কৃষ্ণ ঘোড়া একটি লৌহ বর্মে

বজ্রের মতো কণ্ঠ, ইস্পাত কঠিন দেহ,

সহস্র শতাব্দীর তেলেসমাতের

জিঞ্জির বন্ধন ছিন্নকারী

বাঁধন হারা দৈত্যের মতো।’

‘আভেস্তা’ শব্দ ও পরিভাষা চয়নে এবং ছন্দময়, শ্রুতিমধুর রূপকল্প নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা ও মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছন্দের বিচারে তাঁর কবিতা বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাঁর বাচনভঙ্গি ও কাব্যরীতিকে মান-অভিমান, দুঃখ-বেদনা ও কান্না-আহাজারির প্রতিচ্ছবি হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। তাঁর গ্রন্থ বাজেয়াপ্তকরণ, কারারুদ্ধ হওয়া এবং লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞার পেছনে হয়তো এগুলোর প্রতিক্রিয়াও ছিল। তিনি বলেন :

به رخ ستاره دمید از سواد چشم ترم

چو برگرفت زرخ پرده، شاهد سحرم

در آشیانۀ پندار مانده و شب و روز

به بال مرغ نفس، راه عمرمی سپرم

زتاب درد چو اندیشه گشته¬ام باریک

شگفت ترکه به اندیشه توره نبرم

‘আমার সজল নয়নের মণি টপকে

জেগেছে সেতারা চেহারার পরে

শেষ রজনীর প্রেমিক যখন

গুটিয়ে নিল তার আননের পর্দাখানি

কল্পনার নীড় পড়ে আছি আর রাত্রদিন

শ্বাস-প্রশ্বাসের পাখির ডানায়

জীবনের পথ করি অতিক্রম।

ব্যথার দহনে হয়েছি সূক্ষ্ম ক্ষীণকায় ’চিন্তার’ সম

আরো বিস্ময় যদি তোমার চিন্তায়

না পাই খুঁজিয়া পথ।’

অবশ্য তাঁর এই বাচনভঙ্গি ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর (১৯৭৯/১৩৫৭ ফারসি) নতুন ধাঁচের রূপ নেয় এবং নতুনতর আবহের যোজনা করে- যাকে ইরানে মহান ইসলামি বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা, তা বাহ্যিক বিপ্লবের সাথে অভ্যন্তরীণ বিপ্লবেরও পরিচয় বহন করে। তাতে কবি ও কথাশিল্পীদের শিল্পকর্মে বিবর্তন সাধিত হয়। ইসলামের প্রথম যুগে আরবের যমীনে ইসলামের আবির্ভাবের মাধ্যমেই আমরা শিল্পচেতনায় এ ধরনের বিবর্তনের সাক্ষাৎ পাই। মরহুম আভেস্তাও এ ধরনের এক বিরল প্রতিভা, যিনি তাঁর কাব্য কাঠামো ঠিক রেখে বিশেষত কাসিদার রচনায় খোরাসানী কাব্যরীতির অনুসরণ করে নতুন ও আধুনিক বিষয় এবং আঙ্গিক নির্মাণে পূর্ণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ‘শাহাদাতের বীরত্ব’ শীর্ষক কবিতায় আমরা সেই বৈশিষ্ট্য ও নতুনত্বের প্রকাশ দেখতে পাই। শহীদের সুমহান মর্যাদা এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর আধ্যাত্মিক মূল্যমানের চিত্রাংকন করে আভেস্তা গেয়েছেন :

 

فری شهید و عز واعتلای او

کرامت و کمال و کبریای او

ولایت و سرود جانفزای او

شهادت و حماسۀ ولای او

...فرشته نغمه سرکند چو بشنود

ترنم نوای ربّنای او

لقای دوست جوید وبلای وی

زهی شهید ایزدی لقای او

...ثنای من مدیح من سرود من

مدیح او سرود او ثنای او

 

‘সাবাস শহীদ তার মর্যাদা ও উচ্চতা

বুজর্গী, পূর্ণতা আর মহীয়ান সত্তা।

প্রাণ-জাগানো বন্ধুত্ব ও গানের মূর্ছনা

শাহাদাত ও বন্ধুত্বের অসীম ব্যঞ্জনা।

শুনবে যখন ফেরেস্তারা গাইবে প্রীতির গান

তার প্রাণস্পর্শী ’ইয়া রাব্বানা’ গুঞ্জরণের তান।

প্রেমাস্পদের মিলন আরো চাহে বালা ইমতিহান।

সৌভাগ্যবান শহীদ যে চায় মহান প্রভুর সন্নিধান।

স্তুতি আর প্রশংসা ও আমার গানের আনন্দ

তার স্তুতি, তাহারি গান, তার প্রশংসা অনন্ত।’

মরহুম আভেস্তা কেবল একজন কবিই ছিলেন না; বরং জ্ঞান-মনীষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তাঁর মূল্যবান গবেষণা ও অবদান বিচিত্র অঙ্গনে তাঁর দক্ষতার পরিচয় বহন করে। তিনি বিভিন্ন বিষয়কে উদার দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেন এবং পাণ্ডিত্যের দক্ষতা নিয়ে গবেষণা ও শিল্প নির্দেশনার দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। উদারহণস্বরূপ মরহুমের লিখিত ‘মানবিক রত্ন ও বিশ্ব সভ্যতা’ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করছি।

সভ্যতা অবিরাম তার শীর্ষদেশে আরোহণ করে নানা দুর্গতির জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস সেসব দুঃখ-দুর্গতির বিবরণ। সংস্কৃতির বিপরীত সভ্যতা বরাবর সমাজকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। বিশ্বে যে কোন মৌলিকতার পশ্চাতে আপদ আছে। যেমন কাল। যৌবন আর প্রাণচাঞ্চল্যের আপদ হলো কাল। বার্ধক্য ও ব্যর্থতা তার অবনতি ও পতনস্বরূপ। আর আভিজাত্য, আভিজাতের আপদ হলো বিলাসবহুলতা। সংস্কৃতিও আভিজাত্যের একটি অর্থ বা ভিন্নতর ভাষ্য। ক্ষমতা তার আপদ এবং সভ্যতা তার পতনের ফলশ্রুতি। এ কথার উজ্জ্বল প্রমাণ ইসলাম। শুরুতে ইসলাম স্বাধীনতা, ইনসাফ, ঈমান, গণমুখিতা, সাহসিকতা ও চিন্তা-চেতনাভিত্তিক একটি সংস্কৃতি ছিল। কুরআনের আয়াত এবং পয়গাম্বর (আ.) ও ইমামদের বাণীর আলোকে মানুষকে ধৈর্য, সহনশীলতা, স্বাধীনতা ও চিন্তা-চেতনার ঐশ্বর্যে লালন করছিল, কিন্তু যখন থেকে এই সহজ সরল প্রকৃতিসম্মত সংস্কৃতি ক্ষমতার দাপট ও বিলাসিতায় মিশ্রিত হলো তখন অনৈসলামিক ও ঈমানবিধ্বংসী দর্শনের দিকে ধাবিত হলো যা ছিল ঐ সভ্যতার অনিবার্য অনুষঙ্গ; কী বা করা যায়। শিল্পের আজব মূর্তি যা সিনেমা  ও টিভির পর্দা ও বেতার তরঙ্গে প্রচারণার যাদুমন্ত্রের ধূম্রজাল আর তাদের হাজারো মিথ্যা কাহিনীর সহায়তায় গ্রান্ট ওয়াশিংটন, লিংকন ও কাস্টারকে এক ধরনের পয়গাম্বররূপ চিত্রিত করে তার ওপর দাউদের শক্তি ও  ঈসার পূত-পবিত্রতার মতো অলৌকিকতা আরোপ করে সে সভ্যতা অভিজাত লাল চামড়াওয়ালাদের ভেতর থেকে মাতাল রক্তচোষা হিংস্র জন্তুই বানাতে পারে।

প্রবন্ধের অন্যত্র তিনি মাফিয়া ও ইহুদি চক্রের প্রসঙ্গ টেনে বলেন : ‘যে যুগের বড় বড় কর্তা তথা স্ট্যালিন, চার্চিল, ব্রেজনেভ, ট্রুমান, মোশেদায়ান, বেগীন, গুন্ডওয়াটার প্রমুখ সিনেমার সবচেয়ে দর্শনীয় চরিত্র এবং তারা কিনা বুদবুদের সৃষ্টি মহামানব ও বরফমূর্তির লৌহপুরুষ। সত্যিই মানবতার ভবিষ্যৎ কোথায়? মানবতার কি এমন কোন ভবিষ্যৎ আছে যে, ভবিষ্যৎ কিরূপ হবে তা বলা যাবে? পরিশেষে زدست رفتم ‘হারিয়ে গেলাম’ শীর্ষক গজলের উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনার ইতি টানছি-

ترانه خیزد به کهکشانها زسینه با آه آتشینی

فراز ایوان آسمانها، چه طرفه بزمی چه سرزمینی

ندید چشمی به دلنوازی به دلفروزی به فتنه سازی

که چشمۀ آفتاب تابدز چشم همچون توبی قرینی

شوم خیالی گرم نخوانی برآیم از هر درم برانی

زپافتادم چنانکه دانی زدست رفتم چنانکه بینی

‘আমার অগ্নিঝরা আহাজারিতে

ছায়াপথের বুকে সংগীতের সুর বাজে

আকাশগুলোর দ্বারমণ্ডপের শীষে কার্ণিশে

কি যে মজলিস জমে ঊর্ধ্বলোকের ঐ দেশে।

মন মাতানো হৃদয় হারানো পাগল করা ভঙ্গিমায়

তার অতুল নয়নের আলোর ঝর্না

দেখে নি এমন নয়ন কারো

কল্পনার রূপে ভাসব যদি না ডাক আমার নামটি ধরে

যে দ্বার হতেই তাড়াও না কেন আসব অন্য দুয়ার ধরে।

তুমিতো জান পড়ে আছি আমি কতখানি অসহায়

যেমনটি দেখছে হারিয়ে গিয়েছি অন্তিম নিরালায়।’

তথ্যসূত্র:

১. ইরানের সমকালীন কথাশিল্পী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বাকের রোরকেয়ী, ১ম খণ্ড, খোররাম প্রকাশনী, ১৩৭৩/১৯৯৫।

২. ‘কবিতা’ ম্যাগাজিন, ফারভারদীন ও উর্দিবেহেশ্ত, ১৩৭৩/১৯৯৫ (দশম সংখ্যা)।

৩. কায়হানে ফারহাঙ্গী, ৪র্থ সংখ্যা, তৃতীয় বর্ষ, তীর ১৩৬৫, ২য় সংখ্যা, উর্দিবেহেশ্ত ১৩৭২, সংখ্যা উর্দিবেহেশ্ত ১৩৭৩। ৮ম সংখ্যা, আবান, ১৩৭৩। ১২১তম সংখ্যা, দ্বাদশ বর্ষ, খোরদাদ ও তীর ১৩৭৪/১৯৯৬।

লেখক: ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর, উর্দু ও ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুবাদ : মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

নিউজলেটার, জুন, ১৯৯৬

মেহেরদাদ আভেস্তার বাচনভঙ্গি ও কাব্যরীতির প্রতি এক নজর
TemplateOrganized

:

:

:

: