হাফ্ত সীন্
ইরানি নওরোয বা নববর্ষ অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কতগুলো জিনিস দিয়ে একটি দস্তরখান সাজানো। এতে এমন সাতটি জিনিস রাখা হয় যেগুলোর নামের প্রথম বর্ণ হয় ফারসি ‘সীন্’ হরফ; এ কারণে এটিকে ‘হাফ্ত্ সীন্’ (সাত সীন্) বলা হয়ে থাকে। এতে সাধারণত সাত ধরনের কৃষিজাত দ্রব্য রাখা হতো- যেগুলোকে ইসলাম-পূর্ব যুগে প্রাণসঞ্জিবনী সাতটি উপকরণের প্রতিনিধিত্বকারী বলে গণ্য করা হতো। পরবর্তীকালে এতে ধাপে ধাপে পরিবর্তন সাধিত হয়।
বর্তমানেও হাফ্ত্ সীনের দস্তরখান সাজানো হয়,তবে তার উপকরণসমূহে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং এতে ব্যবহৃত সাত উপকরণের প্রাচীনকালীন উপকরণাদির সাথে তেমন একটা মিল নেই। বর্তমানে হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে প্রাচীন কালের মতোই প্রবৃদ্ধির নিদর্শন হিসেবে গম বা বার্লি রাখা হয়। সেই সাথে যোগ করা হয় কাচের আধারে রক্ষিত মাছ- যা সহজেই সংগ্রহ করা যায়। তেমনি পানিও রাখা হয়। তাছাড়া আগুনের মতো উপকারী জিনিসের নিদর্শনস্বরূপ মোমবাতি জ্বালানো হয়। বর্তমানে তাতে আয়নাও রাখা হয়, তবে এটা কখন কীভাবে যুক্ত হয় তা জানা যায় নি।
প্রাচীন কালে হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে ব্যয়বহুল দ্রব্যাদি রাখা হতো এবং তার কতক দ্রব্য হতো চকচকে ধাতবের তৈরি। অবশ্য এমনটা মনে করা ঠিক হবে না যে, প্রতিটি পরিবারই তার হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে অভিন্ন জিনিস রাখত। বর্তমানে জরাথ্রুস্টরা তাদের হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে আয়নার সামনে জ্বালানো মোমবাতি রাখে। অতীতে তাদের দস্তরখানে সব সময়ই মদ রাখা হতো। যেহেতু ইসলামে মদ হারাম সেহেতু বর্তমানে তার পরিবর্তে ভিনেগার রাখা হয়।
নিচে হাফ্ত সীন্ এর পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
সাবযেহ (সবুজাভ) : গম বা ডালের কচি চারার গুচ্ছ যা নওরোজের অব্যবহিত পূর্বে গজিয়েছে একটা ট্রে বা প্লেটের ওপর বসিয়ে হাফ্ত সীন্ দস্তরখানায় রাখা হয় যা নব জীবনের প্রতীক।
সামানু : কচি গম,বার্লি বা অন্যান্য শস্যদানার আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের হালুয়া যা প্রাচুর্য ও নেয়ামতের প্রতীক। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য,এ কারণে এটি ভোজোৎসবেও রাখা হয়।
সেনজাদ : একপ্রকার শুষ্ক ফল যা ভালোবাসা ও প্রেমের প্রতীক।
সীর (রসুন) : রসুন রাখা হয় এতে নিহিত বিবিধ কল্যাণের কারণে। সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।
সোম্মাগ : মসুরের ডালের চেয়ে সামান্য বড় লাল রঙের টক ফলবিশেষ যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক।
সিরকা : দীর্ঘায়ু ও ধৈর্যের প্রতীক।
সোমবোল : ছোট আকারের ফুল ও উদ্ভিদবিশেষ যা বসন্তের আগমনবার্তা বহন করে নিয়ে আসে।
সেক্কেহ্ (কয়েন বা মুদ্রা) : সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক। ধন-সম্পদ ও উন্নতি-অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে ধাতব মুদ্রা রাখা হয়।
হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ডিম। কারণ,ডিম হচ্ছে পৃথিবীর উর্বরতা ও জন্মদানে সক্ষমতার প্রতীক। নওরোজের দস্তরখানে ফুল,আয়না,পানি,লাল রংয়ের ছোট মাছও রাখা হয়। এসবেরই রয়েছে বিশেষ অর্থ। ফুল ও সবুজ কিশলয় আনন্দ ও নব-জীবনের প্রতীক। প্রকৃতিতে নব-জাগরণের বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। চারদিকে ফুলের সমারোহ এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের মনও হওয়া উচিত ফুলের মতো সুরভিত ও সুন্দর।
হাফ্ত সীন্ | |