খুনে তেক্কুনি
খুনে তেক্কুনি : বছরের শেষ দিনগুলোতে নববর্ষকে সামনে রেখে অধিকাংশ বাড়িঘরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ধৌত করার কাজ শুরু হয়। এই সময় কাজটি বাড়ির নারীদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে রূপান্তরিত হয়। নওরোজ বা নববর্ষের প্রায় ১৫ দিন পূর্ব থেকেই ইরানের জনগণ নিজেদের বাড়ির পুরাতন আসবাবপত্র ফেলে দিয়ে নতুন আসবাবপত্র ক্রয় অথবা মেরামত করেন। বাড়ির দরজা-জানালা, কার্পেট, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মেতে উঠেন। ফারসিতে যাকে বলা হয় ‘খুনে তেক্কুনি’।
ইরানের অধিকাংশ জনগণ নতুন বছর শুরুর পূর্বে পুরাতন আসবাবপত্র বাড়ির বাইরে ফেলে দেওয়া না হলে একটি বড় ধরনের ভুল হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন বাড়িতে পূর্বের বছরের পুরাতন আসবাবপত্রের বিশাল একটি স্তূপ জমে আছে এবং এগুলো ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে বাড়ির পরিবেশ উন্মুক্ত হয়। এর ব্যতিক্রম হলে ভেবে নেওয়া হয় যে, বাড়ির জিনিসপত্র শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এই সময়ে পুরাতন পরিধেয় পোশাক, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র, পুরাতন আসবাবপত্র (যেগুলো আর ব্যবহৃত হয় না), বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের নিকট থেকে প্রাপ্ত উপহার সামগ্রী (যেগুলো কখনই ব্যবহৃত হয়নি), এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, যদি কেউ উপহার পাওয়ার এক বছরের মধ্যে এই উপহার সামগ্রী ব্যবহার না করে; তবে সেটির আর প্রয়োজন নেই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রথম রান্নাঘর থেকে শুরু করা হয়। তাদের মতে, বছরে একবার অবশ্যই সমস্ত ধুলাবালি পরিষ্কার করা উচিত, যেগুলো ধোয়ামোছা দরকার সেগুলোও সম্পন্ন করা উচিত। রান্নাঘরে রাখা বিভিন্ন মশলার মধ্যে যেগুলো আসলেই সুঘ্রাণ দেয়, তার মধ্যে অনেকগুলো আছে যা আদৌ রান্নায় ব্যবহৃত হয় না, এমনসব মশলা দূরে ফেলে দেওয়া হয়। রান্নাঘরের চুলা, গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের সংযোগ নতুন করে পরীক্ষা করা হয় এবং প্রয়োজনে সব বদলে ফেলা হয়।
রাথরুম, টয়লেট, বাড়ির গেইট একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলা হয়। শহরে, গ্রামে, বন্দরে প্রায় একইরকমভাবে কাজগুলো করা হয়। খাট, খাটের নিচের পাটাতন, তোশক, কম্বল, দরজা, জানালা, শোপাজ (তীব্র শীত নিরারণের গ্যাসচালিত যন্ত্র), কুলার (পানি ও বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র), ছামাভার (চায়ের বিশাল কেতরি), ঝাড়বাতি, ফ্রিজ, এমনকি ছাদ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়। প্রয়োজনে সব বদলে ফেলে নতুন জিনিসপত্র কেনা হয়। বাড়ির উঠোন, বারান্দা, পার্ক ও রাস্তায় পুরনো গাছপালা ছেঁটে নতুন করে ফলমূল, তৃণলতা ও বাহারি বৃক্ষ দ্বারা সজ্জিত করা হয়।
নওরোজের কেনাকাটার পাশাপাশি শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সবাই ‘খুনে তেক্কুনি’-তে ব্যস্ত থাকে। ‘খুনে তেক্কুনি’ নিয়ে রেডিও টেলিভিশনেও মজার মজার সব কৌতুক প্রচারিত হয়। সংবাদপত্রেও হরেকরকম মজাদার ক্যাপশন সম্বলিত কার্টুন ছাপা হয়। এমনকি বাড়িঘর ও সংবাদপত্রে বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার প্রকাশিত হয়। তাই ‘খুনে তেক্কুনি’ ইরানি নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
সূত্র : পারস্যের লোকজ সংস্কৃতি ও উৎসব, মুমিন আল রশিদ, নবান্ন প্রকাশনী
খুনে তেক্কুনি | |