এজেন্সি
মেহেরদাদ আভেস্তা

মেহেরদাদ আভেস্তা

মেহেরদাদ আভেস্তা

ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ী

 

ইরানের সমকালীন কবি মুহাম্মদ রেজা রাহমানী (মেহেরদাদ আভেস্তা) ১৩০৮ ফারসি সালের ২০ বাহমানে (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) ইরানের বুরুজের্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল সাদেক। আভেস্তা স্বীয় জন্মভূমি বুরুজের্দেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্য সেখান থেকে তেহরানে যান এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাশনাল অ্যান্ড ট্রেডিশনাল ফ্যাকান্টিতে ভর্তি হয়ে দর্শন ও নীতিশাস্ত্রে লেখাপড়া করেন। ঐ সময়ই ১৩২৭ ফারসি সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গ্রন্থাগারগুলোর বিন্যাস ও জেলা পর্যায়ে নতুন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার দায়িত্বভার নিয়ে চাকুরিতে যোগদান করেন। একই সাথে কয়েকটি হাইস্কুলে ক্লাস নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৩৩০ সালে তিনি বিএম ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

১৩৩২ ফারসি সালে (১৯৫৩) জাতীয় স্বাধীনতার পক্ষ সমর্থন তথা জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতাকামী ও ইরানের তেলশিল্প জাতীয়করণের প্রধান উদ্যোক্তা ডক্টর মুহাম্মদ মুসাদ্দেকের প্রতি সমর্থন ঘোষণা, শাহের বিরোধিতা আর বিপ্লবী বক্তৃতা প্রদানের দায়ে গ্রেফতার হয়ে ৭ মাস কারাভোগ করেন।

‘আভেস্তা’ ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে ইউরোপে সফর করেন। সেখানে এক মাসব্যাপী ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রিটেনে সময় কাটান। ব্রিটেনে তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাতে উভয়ের সধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয় দফা সফরে তিনি ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড গমন করেন। তাতে জন পল সার্টারের সাথে সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের সূচনা ঘটে- যা বহু বছর স্থায়ী হয়।

১৩৫৬ ও ১৩৫৯ ফারসি সালেও তিনি ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে সফর করেন। এ সময় ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিভিন্ন বক্তৃতা দেন। তিনি পাকিস্তানও সফর করেন। তাতে হাফেজ ও সমকালীন আফগান কবি খালিলুল্লাহ খালিলীর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদান করেন।

‘মেহেরদাদ আভেস্তা’ ইরানের ভেতরে তেহরান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারুশিল্প কলেজ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, উচ্চতর শিল্প একাডেমী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে ফারসি সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলার ইতিহাস, শিল্প-ইতিহাসের দর্শন, শিল্পের সামাজিক ইতিহাস, ইউরোপে শিল্প গবেষণার পদ্ধতি, বিশ্বসাহিত্য, সৌন্দর্যবিজ্ঞান, সংগীতের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর শিক্ষকতার শেষ জীবন কাটে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের শিক্ষকতায়। তিনি সংগীতের ইতিহাসে অধ্যাপনা করতেন। ইসলামি সংস্কৃতি ও নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের কবিতা পরিষদের সদস্য ছিলেন।

১৩৭০ ফারসি মোতাবেক ১৯৯০ সালে তেহরানের ‘ওয়াহদাত হলে’ জনৈক কবির একটি কবিতা সংশোধন করছিলেন এমন সময় তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন বিপুল সংখ্যক সাহিত্যানুরাগী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অংশগ্রহণে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ইরানের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের কীর্তিমান পুরুষদের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি বলেন :

برق سهیل یمنم آرزوست

بوی اویس قرنم آرزوست

از براین قلمۀ نه تو حصار

پرزدن بر شدنم آرزوست

সুহাইল ইয়ামানীর দীপ্তিই আমার প্রত্যাশা।

ওয়াইস কারানীর খুশবুই আমার প্রত্যাশা।

নয় গ্রহের প্রাচীরে বন্দি এই দুর্গ ছেড়ে

উড়াল দেয়া আরো ঊর্ধ্বে ওঠাই আমার প্রত্যাশা।

মরহুম আভেস্তা তিন মেয়ে, এক ছেলে, বহু আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব রেখে গেছেন।

মরহুম আভেস্তার রচনাবলি

মরহুম আভেস্তা তেহরানে কয়েকটি সাহিত্য সমিতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ‘আনজুমানে সায়ের’ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এটি তেহরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পরিষদ। তিনি ফারসি সাহিত্য ও কবিতাতেই অধিকাংশ রচনা রেখে গেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ :

(১)     দর্শন, তর্কশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ক পুস্তক (১৩৩৩/১৯৫৪)

(২)     প্রজ্ঞা ও আলোকন (عقل و اشراق) (দর্শন বিষয়ক) (১৩৩৪/১৯৫৫)

(৩)     রাসায়েলে খৈয়্যাম (নওরোজ নামে/ ওয়াহদতুল ওয়াজুদ), হাকীম ওমর খৈয়্যামের জীবনী সম্পর্কিত গবেষণা পুস্তক ১৩৩৫/১৯৫৬)

(৪)     আয কারাওয়ান রাফতে (কাফেলা ছেড়ে চলে গেছে), এটি তাঁর প্রথম কবিতার বই, যা শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। (১৩৩৯/১৯৬০)

(৫)     ‘পলীযবান’ (پالیزبان), কয়েকটি ছোট গল্প, সাহিত্য-কথিকার সংকলন। (১৩৩৪২/১৯৬৩)

(৬)     ‘হামাসেয়ে অ’রেশ’ (অরেষের বীরত্ব), খুরাসানে প্রকাশিত দীর্ঘ কাব্য (১৩৩৪৪/১৯৬৫)

(৭)     ‘আয এমরূয তা হারগেজ’ (از امروز تا هرگز), আজ থেকে কক্ষনো না। কয়েকটি ছোট গল্পের সংকলন। (১৩৩৫/১৯৬৬)

(৮)     আশক ওয়া সারনেভেশত (অশ্রু ও ভাগ্য- اشک و سرنوشت) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-কর্মের নির্বাচিত অংশের সংকলন (১৩৪৮/১৯৬৯)

(৯)     ফারসি ভাষার গবেষণা পদ্ধতি, ব্যাকরণ ও লিখন পদ্ধতি। (১৩৪৮/১৯৬৯)

(১০)   শারাবে খানেগী তারসে মোহতাসাব খোরদে (নিয়ন্ত্রকের ভয়ই ঘরের শরার পান করেছে) ১৩৫১/১৯৭২ সালে এ কবিতা সংকলনটি প্রকাশিত এবং শাহের সরকারের পক্ষ হতে ঐ বছরই তা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

(১১)    তীরানা (تیرانا), সমালোচনামূলক এ গ্রন্থটি ১৩৫২/১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং ইমাম খোমেইনীর নামোল্লেখ ও আরো কিছু বিষয়ের কারণে শাহের সরকার বাজেয়াপ্ত করে। এছাড়া এক বছর পর্যন্ত তাঁর লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

(১২)   সালমান সাওজীর দিওয়ানের সম্পাদনা (১৩৩২/১৯৫৩)

(১৩)   সানায়ীর স্বরূপ ও তাঁর রচনাবলি। উল্লিখিত রচনাবলি ছাড়াও কাসিদা ও গজল আকারে কবিতাসহ বিভিন্ন প্রবন্ধ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় যা ফারসি সাহিত্যের এ শিক্ষকের ব্যাপক অধ্যবসায় ও প্রচেষ্টার পরিচায়ক।

লেখক: ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর, উর্দু ও ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুবাদ : মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

নিউজলেটার, জুন ১৯৯৬

মেহেরদাদ আভেস্তা
কতিপয় রচনা: দর্শন, তর্কশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ক পুস্তক, প্রজ্ঞা ও আলোকন, রাসায়েলে খৈয়্যাম ইত্যাদি

:

:

:

: