এজেন্সি
বিশ্ব সিনেমার অগ্রদূত আব্বাস কিয়ারোস্তামি

বিশ্ব সিনেমার অগ্রদূত আব্বাস কিয়ারোস্তামি

বিশ্ব সিনেমার অগ্রদূত আব্বাস কিয়ারোস্তামি

সাইদুল ইসলাম

আব্বাস কিয়ারোস্তামি। বিশ্ব সিনেমার স্বনামধন্য এক নক্ষত্রের নাম। যিনি সত্যিকার অর্থেই গত চার দশকের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করে গেছেন বিশ্ব সিনেমাজুড়ে। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রশিল্পী।
১৯৭০ সাল থেকে নিয়মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য সব ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন তিনি। ‘কোকের ত্রয়ী’, ‘টেস্ট অব চেরি’ এবং ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এর মতো সিনেমার জন্য আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি অর্জন করেন; এর মধ্যে ‘টেস্ট অব চেরি’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘পাম দো ওর’ অর্জন করে।

শিল্পের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় চিত্রকলার মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা শুরু করেন যার ফলশ্রুতিতেই ১৮ বছর বয়সে লাভ করেন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। এর কিছুদিন পরই বাড়ি ছেড়ে তেহরান চলে যান ইউনিভার্সিটি অব তেহরানে চারুকলায় পড়ার জন্য। চিত্রকলার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যোগ দেন ট্রাফিক পুলিশের চাকরিতে। কিন্তু তিনি দমে যান নি। কিছুদিন পর আবার পরীক্ষা দিয়ে চিত্রকলায় উত্তীর্ণ হন। যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। চিত্রকর, নকশাবিদ ও অংকনবিদ হিসেবে ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন।

এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বখ্যাত এই চলচ্চিত্রকার বলেছিলেন : ‘১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে বোধহয় ১৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপন বানিয়েছিলাম। সেগুলো খুব উপভোগ করতাম। কাজটা আসলেই বেশ মজার; মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ভূমিকা, পুরো গল্প এবং আপনি দর্শকদেরকে যা জানাতে চান তা তুলে ধরতে হয়। এর জন্য প্রথমেই একটা ভালো গল্প বানাতে হয়, এরপর খুব দ্রুত সেটা দর্শকদেরকে বোঝাতে হয় এবং অবশ্যই এমনভাবে বোঝাতে হয় যাতে বিজ্ঞাপন দেখার পর তারা পণ্যটা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কমার্শিয়াল আর গ্রাফিক আর্ট থেকেই আমি সিনেমা সম্পর্কে জেনেছি। গ্রাফিক প্রকল্পগুলোতে একটা পৃষ্ঠা, কলাম বা ইনসার্ট থাকে; এই ছোট্ট পরিসরেই এমন কিছু আঁকতে হয় যাতে দেখামাত্রই সবাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আমার তো মনে হয়, গ্রাফিক্সই সব শিল্পের জনক।

সীমাবদ্ধ পরিসর এবং বাণিজ্যিক চাপের কারণে এখানে শিল্পীরা তাঁদের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হন। বিজ্ঞাপনে কাজ করার শেষ কয় বছরে আমি বেশ কিছু ইরানি সিনেমার ক্রেডিট সিকোয়েন্সও ডিজাইন করেছিলাম। সে সময়ই আমার কর্মজীবনের মোড় ঘুরে যায়, বাণিজ্যিক গ্রাফিক শিল্প থেকে অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ি। আসলে ক্রেডিট সিকোয়েন্স ডিজাইন করার সময়ই আমি আমার ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছিলাম।’

সিনেমার ভেতর দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ানো, কিংবা কখনো জীবনকে স্থূল আর সমস্ত অর্থহীনতার সামনে দাঁড় করিয়ে শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছেই নিয়ে যাওয়ার কারিগর ছিলেন কিয়ারোস্তামি।

বিষয়-বৈচিত্র্য গল্পভাবনা কিংবা ক্যামেরার কলাকৌশল আর নতুন উদ্ভাবনের দিকে তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্কে বাংলাদেশের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকদের নতুন মাত্রায় ভাবতে শিখিয়েছেন কিয়ারোস্তামি। সিনেমা সম্পর্কে দর্শকদের চিন্তার জগতে নিয়ে যেতে হবে বলেই তিনি হয়তো তাঁর চলচ্চিত্রে কোন উপসংহার টানতেন না। যেকারণে দর্শকরা তাঁদের ভাবনার মধ্য দিয়ে একেকজন তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্কে একেক রকম উপসংহার টানার চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানোর এই কৌশলটা তিনি দেখিয়ে গেছেন।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক বলেন, ইরানি চলচ্চিত্র বলতেই বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা রয়েছে। যার পেছনের কারিগর কিয়ারোস্তামিদের মতো নির্মাতারা। কিয়ারোস্তামি ক্যামেরাকে সৃজনশীল অভিপ্রকাশের উন্নত মাধ্যম মনে করতেন। একটা বিষাদময় মুহূর্তে একটা মৃদুমন্দ বাতাস কীভাবে একজন মানুষের জীবন পাল্টাতে পারে এটাও তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন।

কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই যখন বর্বরোচিত হামলার এক ভয়াবহ চিত্র প্রত্যক্ষ করছিলাম তখন নিজেকেও নিরাপত্তাহীন মনে হচ্ছিল। কোন কিছুই ভালো লাগছিল না। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন সময় কিয়ারোস্তামির একটি ছবি আমার মনের বিষণœতাকে দূর করে দেয়। একমাত্র শিল্পই যে পারে সকল প্রকার হিংসা দূর করে মানুষকে ভালোবাসার চাদরে আবৃত করতে তা কিয়ারোস্তামিই তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়ে গেছেন।
সিনেমার পরতে পরতে স্বাভাবিকতা চাইতেন কিয়ারোস্তামি। ছবিটাকে যতভাবে পারা যায় বাস্তবতায় মুড়িয়ে দিতেন তিনি। তাঁর চরিত্ররা কখনোই অভিনয় করেনি। অলিভ ট্রি, উইন্ড উইল ক্যারি আস, টেস্ট অব চেরি কিংবা শিরিন সিনেমার সেই দর্শকদের অভিব্যক্তি যেভাবে প্রাণবন্ত করে তিনি নির্মাণ করলেন যেকেউ হয়তো ছবিগুলোকে চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে দৃশ্যধারণ করা বলে ভেবে বসতে পারে।

কিয়ারোস্তামির সিনেমায় প্রধান সুবিধাটা হচ্ছে, একজন কবি যখন কিয়ারোস্তামির সিনেমা দেখেন তখন তিনি কাব্যরসসমৃদ্ধ সমস্ত ব্যাপারই তাঁর সিনেমায় খুঁজে পাবেন। একইভাবে নির্মাতা এবং ভিন্ন ধাঁচের গল্প বলতে চাওয়া কোনো স্টোরি টেলারও।
যে উঠতি সিনেমা নির্মাতা ভিন্ন স্বাদের গল্প বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তিনি যখন আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমায় মগ্ন হবেন তখন তো তাঁর নেশা পেয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সিনেমা দিয়ে সম্মোহন করার যে অভূতপূর্ব ক্ষমতা, তিনি তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন জীবনভর।

১৯৭৯ সালের যুগ পরির্বতনকারী ইরানি বিপ্লবের পর যে সকল সফল চলচ্চিত্রকার ইরানে থেকে গিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম আব্বাস কিয়ারোস্তামি। বিপ্লব-পরবর্তীকালে কিছুসংখ্যক নির্মাতা পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে যান। কিন্তু আব্বাস বিশ্বাস করেন দেশে থাকাটাই তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, ইরানে থেকে নিজের জাতীয় পরিচয় ও সত্তা আঁকড়ে থাকার কারণে তাঁর চলচ্চিত্র জীবন মহিমান্বিত হয়েছে।

‘মূলোৎপাটিত করে একটি গাছকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে সে আর ফল দেবে না। অন্তত আপন স্থানে সে যত ভালো ফল দিত নতুন স্থানে তত ভালো ফল দেবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি মনে করি দেশ ছেড়ে গেলে আমার অবস্থা হতো সেই গাছের মতো।’

বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কারিগর গত ৪ জুলাই ২০১৬ হাজারো ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি যে কতটা মানুষের হৃদয় জুড়ে ছিলেন তারও কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল তাঁর মৃত্যুর পর। টুইটার, ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে আব্বাস কিয়ারোস্তামির স্মৃতি নিয়ে চলছে মানুষের রোমন্থন। আফসোস আর চোখের জলে শোকে কাতর তাঁর অনুসারি ও ভক্তশ্রেণি। যেকোনো ধরনের ইগো ঝেড়ে ফেলে তাঁর সমসাময়িক আর পরবর্তী প্রজন্মের নির্মাতা বা আর্টিস্টরা অনায়াস ভঙ্গিতে গুরুর আসনে রেখে কথা বলছেন আব্বাস সম্পর্কে।

তাইতো এমন শোকের দিনেও ইরানি সিনেমার জন্য আফসোস করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলে ওঠেন- ‘বিশ্ব সিনেমা অঙ্গনে কা-ারিকে হারালো ইরান।’ এমনকি তাঁকে ইরানি সিনেমার ওস্তাদ বলেও আখ্যা দেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো শোকে পাথর সংস্কৃতিমন্ত্রী আলী জান্নাতিও। আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে একজন মানবতাবাদী আখ্যা দিয়ে বিশ্ব সিনেমার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এমনকি আব্বাস যে নতুন ধরনের সিনেমা ইরানে শুরু করেছেন তা বিশ্বজুড়ে আজ ছড়িয়ে গেছে বলেও আব্বাস কিয়ারোস্তামির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন।
২০১১ সালে ‘এ সেপারেশন’ নির্মাণ করে বিশ্বজুড়ে শোরগোল ফেলে দেয়া অস্কারজয়ী নির্মাতা আলি আসগর ফারহাদি। তিনি কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখেই বলতে পারেন, আব্বাসের জন্যই আজ ইরানি সিনেমা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাঁর জন্য তিনি নিজেও আজ নির্মাতা হিসেবে সম্মানিত।

বিশ্বখ্যাত হলিউড নির্মাতা ও অভিনেতা মার্টিন বলেন, আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমা মানেই ওভার ফ্লো। সৌন্দর্য আর শৈল্পিকতায় মোড়ানো।

নিউইয়র্কের চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন ‘দ্য ফিল্ম স্টেজ’ (ঞযব ঋরষস ঝঃধমব) কিয়ারোস্তামির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে লিখেছে, বিশ্ব সম্ভবত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাকে হারালো।

জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ মানুষদের জীবনের সন্ধান দিয়ে, বেঁচে থাকার মোমেন্ট তৈরি করে দিয়ে নিজেই হারিয়ে গেলেন কোন অজানায়, সেই মানুষটাকে আর যাই হোক অন্তত শোক জানানো শোভন হবে না। কেননা, ‘টেস্ট অব চেরি’র মতো তাঁর মহান এই সৃষ্টিকর্মগুলো যত দিন বিশ্বের মানুষকে ছুঁয়ে যাবে তত দিন পর্যন্ত জীবনের আরেক নাম হয়ে থাকবেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি।
আর্ট ফিল্মের অন্যতম কিংবদন্তী ও দিকপাল কিয়ারোস্তামি ৪০ বছরে ৪০টিরও বেশি প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য ছায়াছবি উপহার দিয়ে গেছেন। কয়েক ডজনেরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

বিশ্ব সিনেমার অগ্রদূত আব্বাস কিয়ারোস্তামি
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: ‘কোকের ত্রয়ী’, ‘টেস্ট অব চেরি’ এবং ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’

:

:

:

: