পবিত্র হজের আধ্যাত্মিক দর্শন
ইসলামের একটি প্রধানতম রোকন হচ্ছে হজ। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও সামর্থ্য থাকা সাপেক্ষে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর যিলহজ মাসের প্রথম দশকে মক্কা শরিফে অবস্থিত মসজিদুল হারামে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফা ও মিনায় হাজির হয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে হয় এবং এর নামই হজ, যা ইসলামের অন্যতম প্রধান ফরয।
হজ সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সময়ে, মহানবী (সা.)-এর আগমনের অনেক আগে। তখন থেকেই হজ ও ওমরার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা, যেমন ইহরাম পরিধান, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ানো, আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়া, কাবাঘরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বা তাওয়াফ, কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপিত কালো পাথর-হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া প্রভৃতির প্রচলন ছিল। মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর যে হজ পালিত হচ্ছে তাতে আগের বিধানগুলোর সাথে মাত্র কয়েকটি ইসলামি শিক্ষার সংযোজন হয়েছে।
ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগে আরবরা কাবাঘর তাওয়াফের সময় ‘লাব্বাইকা ইয়া লাত’, ‘লাব্বাইকা ইয়া উজ্জা’ ও ‘লাব্বাইকা ইয়া মানাত’ বলত। লাত, মানাত, ওজ্জা ছিল জাহেলি যুগে আরবদের পূজ্য প্রতীমা। প্রত্যেক গোত্র তাদের নিজস্ব পূজ্য প্রতীমাগুলোকে হজের সময় আহ্বান করত। যেখানে পূর্বে প্রতীমার নাম নিয়ে আহ্বান করা হয়েছে সেখানে ইসলামি যুগে ‘আল্লাহুম্মা’ পরিভাষা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ‘আল্লাহুম্মা’ অর্থ ‘হে আল্লাহ!’ এভাবে হজের সময়কার আগের আহ্বান ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ হিসেবে পরিবর্তিত হয়। এর অর্থ ‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির।’ আরবরা সম্মানিত হারাম মাসে শিকার করা অবৈধ মনে করত। ইসলামের পয়গাম্বর (সা.) কেবল হজের দিনগুলোতে এবং ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আরবরা কখনো কখনো কাবাঘরের চারপাশে নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করত। ইসলাম এই কাজটি হারাম ঘোষণা করে। তার পরিবর্তে হজের সময় ইহরাম অবস্থায় সেলাইবিহীন পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করে। জাহেলি যুগের আরবরা কুরবানির গোশত খাওয়া অপছন্দ করত, পয়গাম্বর (সা.) তা জায়েয সাব্যস্ত করেন।
মুসলমানরা মক্কা বিজয়ের পর এবং কুরাইশদের স্থাপিত ও পূজ্য মূর্তিগুলো অপসারণের পর সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করা বা দৌড়ানো অপছন্দ করত। কেননা, এই দুই পাহাড়ের ওপর ইসলাম-পূর্ব যুগে দু’টি পাথরের মূর্তি স্থাপিত ছিল এবং ঐ যুগের হজ ও বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারীরা ঐ দু’টি মূর্তির সান্নিধ্য অর্জন ও সেগুলোকে চুম্বন করার জন্য সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করত। তবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করা জায়েয সাব্যস্ত করেন এবং কুরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী এ কাজ ইসলামের অন্যতম শায়ায়ের (নিদর্শন) বা ‘স্মারক বিধান’ বলে নির্ধারিত হয়।
হাজী কাকে বলা হবে
এমন ব্যক্তিকে হাজী বলা হবে, যিনি হজ সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে নিজের ব্যক্তিসত্তার বিকাশে প্রতিবন্ধক আপদগুলো দূর করা এবং নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা আর সামাজিক নানা আকর্ষণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সাধনার প্রান্তরে পরিভ্রমণ করেছেন। যিনি মনের স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ ও সৌজন্যবোধ প্রভৃতির পরিচর্যা করেন। যিনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যগামী জীবন সামনে নিয়ে চলেন। আল্লাহকেন্দ্রিক জীবন গড়ে তোলার সাধনা করেন। আধ্যাত্মিকতার শত্রু অবাধ্য নাফ্স ও শয়তানকে বর্জন করেন আর যুগের মুশরিক, যালিম ও তাগুতদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ ও প্রকাশ করেন। সবশেষে যিনি আল্লাহর রাহে নিজের প্রাণপ্রিয় বস্তু নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তিনিই হলেন সত্যিকার অর্থে হাজী, আল্লাহর ঘরের যিয়ারতে জীবন ধন্য করার সাধনায় সফলকাম।
ইসলামে হজের দর্শন
ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র হজে যে জীবনদর্শন নিহিত রয়েছে তা কুরআন মজীদের এই আয়াতের মধ্যে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘আপনি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা শুনিয়ে দিন, তারা আপনার কাছে আসুক পদাতিকভাবে এবং প্রতিটি কৃষকায় বাহনে সওয়ার হয়ে, তারা আসবে দূর দূরান্ত পাড়ি দিয়ে।’ (সূরা হজ : ২৭)
পবিত্র দ্বীনে ইসলাম হচ্ছে নিখাদ একত্ববাদের ধর্ম। এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতই এই দ্বীনের বৈশিষ্ট্য। দ্বীন ইসলাম আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে কোনো শরীকের ধারণায় বিশ্বাস করে না। মুমিন মুসলমানরা এমন একজন আল্লাহর ইবাদত করে যিনি মানুষের দেখা বা উপলব্ধির ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। মুসলমানদের অদ্বিতীয় খোদা কোনো ছবি যেমন নন, তেমনি কোনো প্রতিমাও নন। তিনি ভাস্কর্য নন বা দেহ ও অবয়বধারী নন। কেবল এমন ব্যক্তিই মহান আল্লাহর ইবাদত করতে সক্ষম যিনি সুউচ্চ চিন্তাধারার অধিকারী। যার নিয়্যত বা উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও ইচ্ছাশক্তি মজবুত আর আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে মুক্ত এবং কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান ও নিঃস্বার্থ।
ইসলামের কোলে যারা প্রশিক্ষিত হয়েছে তারা উচ্চতর চিন্তাধারা, বিশ্বাসের স্বচ্ছতা ও কর্মনিষ্ঠায় এমন স্তরে উপনীত হয় যে, অন্য ধর্ম বা দার্শনিক মতবাদ মানুষকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত ও দীক্ষা দানে সক্ষম হয় না।
পবিত্র ইসলাম তার অনুসারীদের শিক্ষা, সংশোধন ও দীক্ষা দানের জন্য কতিপয় সুন্দর বিধান ও আনুষ্ঠানিকতা প্রবর্তন করেছে। এর মধ্যে কিছু বিধান ইসলামের শক্তি ও ক্ষমতা এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। এর মধ্যে প্রকৃষ্ট একটি বিধান হচ্ছে পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফের হজ। এটি ইসলামের অন্যতম স্মারক বিধান- যার জন্য নির্ধারিত কাজ, আনুষ্ঠানিকতা ও সময়ের সীমাবদ্ধতা আছে। আবার এসব অনুষ্ঠানও এককভাবে ইসলামের স্মারক বিধানের মর্যাদা রাখে। এগুলো এমন বিধান, যা শরীয়তের পরিভাষায় অন্তরের তাকওয়া ও কল্যাণের পরিচয় বাহক। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে তা তার অন্তরের তাকওয়ার পরিচায়ক। (সূরা হজ : ৩২) আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন : ‘যে আল্লাহর সম্মানিত নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান দেখায় তা তার জন্য তার প্রভুর কাছে কল্যাণময়।’ (সূরা হজ : ৩০)
হজ তার সকল আহকাম ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে বান্দা ও তার প্রভুর মাঝখানে গভীর ও অকৃত্রিম সম্পর্কের নিদর্শন। আল্লাহ পাক এ ভূপৃষ্ঠের কোন কোন অংশকে বিশেষ মর্যাদা ও পবিত্রতার অধিকারী করেছেন। সেসব স্থানে আল্লাহর রহমত অবারিতভাবে বর্ষিত হয়েছে ও হচ্ছে। আল্লাহর পবিত্র সত্তার জালালিয়াতের প্রকাশ ঘটেছে অবিরত এবং সব মিলিয়ে আল্লাহর পরিচয় ও সান্নিধ্য লাভের নির্দশনস্থলে পরিণত হয়েছে। এসব কারণে এসব স্থানের সাথে মহান স্রষ্টার একান্ত ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে মুমিন বান্দা যখন সেখানে যায় বা প্রবেশ করে সাথে সাথে দয়াময় আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর জেগে ওঠে। সে স্থান দেখার সাথে সাথে তাদের শরীর কাঁপতে থাকে। আল্লাহর জালালিয়াতের তাজাল্লিতে তাদের দেহ-মন শিহরিত হয়।
বস্তুত হজ তার সকল আহকাম-আরকান নিয়ে মহান আল্লাহর নিরঙ্কুুশ আনুগত্য ও তাঁর সম্মুখে শর্তহীন ভাবে আত্মসমর্পণের পরিচয় বহন করে। যার ফলে হজের সময়ে হাজী নিজের কাছে কোন ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে বলে মনে করেন না। তিনি সর্বক্ষণ মক্কায়, মিনায়, আরাফাতে, মুযদালিফায় দৌড়ের মধ্যে থাকেন। কখনো কোথাও যাত্রাবিরতি করেন, আবার কোথাও আল্লাহর হুকুম পালনে তড়িঘড়ি তৎপর হন, রওয়ানা দেন। যখন মিনা থেকে রওয়ানা হন তখন মুযদালিফায় অবস্থান না করেই সরাসরি আরাফাত ময়দানের উদ্দেশে গমন করেন। আরাফাতে গিয়ে আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া ও বিনয়-কাকুতিতে নিরত হন। এভাবেই হজের যাবতীয় আহকাম ক্রমান্বয়ে আঞ্জাম দিয়ে যান।
হজে আল্লাহর সামনে দাসত্বের পরিচয় বাহক একটি সূক্ষ্ম বিষয় হলো আরাফার ময়দানে মাগরিবের সময় মাগরিবের নামায আদায় না করে মুযদালিফায় গিয়ে তা ইশার সময়ে একত্রে আদায় করা। কেননা, মহামহিম আল্লাহ এমনটি হুকুম দিয়েছেন এবং বান্দা তাঁরই হুকুম পালন করে দাসত্বের প্রমাণ রেখেছে। অর্থাৎ যিনি হজ পালন করেন তিনি আল্লাহর বান্দা ও দাস, নামায বা নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোনো ইবাদতের দাস নন।
হজের আকর্ষণীয় আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিষ্কলুষ অন্তরের লাখো মুমিন-মুসলমানের বিশাল ও প্রাণবন্ত সমাবেশ। সারা দুনিয়া থেকে আগত স্বচ্ছ অন্তর, নিষ্ঠাপূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পোষণকারী লাখো মানুষ একস্থানে সমবেত হয়। তাদের এই জমায়েতের মধ্যে কেয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার একটি ছোট্ট দৃশ্যপট উপস্থাপিত হয়।
হযরত ইমাম আহমদ ইবনে আব্দুর রহীম যিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাভী নামে পরিচিত তিনি হজের মহাসমাবেশের দর্শন সম্পর্কে বলেন, হজের হাকীকত হচ্ছে ইসলামি উম্মাহর নেককার বান্দাদের একই সময়ে এমন এক স্থানে উপস্থিত হওয়া, যে স্থান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ও নিষ্কলুষ হৃদয়ের বান্দাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ বান্দাগণ। তাঁরাও আল্লাহর স্মারক বিধানগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও মর্যাদা দানের জন্য যুগে যুগে এ স্থানে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরাও একক অদ্বিতীয় আল্লাহর রহমতের আশ্রয় পাওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের বাসনায় এখানে ইবাদত-বন্দেগি, কান্নাকাটি ও দোয়ায় রত হয়েছিলেন। এমন এক স্থানে এমন অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর সামনে যদি মানুষ হাজির হয় এবং নিজের মিনতি প্রকাশ করে তাহলে আল্লাহর রহমতের সাগরে জোয়ার আসবে না, আল্লাহর অপার রহমতের মধ্যে শামিল হবে না- এমন ধারণা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে।
হজের মানাসিক ও আনুষ্ঠানিকতা
হজের মানাসিকের মধ্যে শামিল রয়েছে পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, মুযদালিফায় রাত্রি যাপন, জামারায় শয়তানকে পাথর মারা, কুরবানি করা, মাথা কামানো বা চুল ছোট করা, মিনায় রাতে অবস্থান করা। এসব বিধানের প্রতিটির জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ, স্থান, পরম্পরা ও পরিমাণ নির্ধারিত আছে।
হজের সকল হুকুম পালনের মধ্য দিয়ে এর এমন মহত্ত্ব ও মহিমা উদ্ভাসিত হয়, যা বর্ণনা করা শব্দ বা বাক্যের আওতায় আসে না, সম্ভব নয়। বরং একে উপলব্ধি করার জন্য সেই নূরানি স্থানে হাজির হতে হবে। এর হুকুম-আহকাম পালনের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। সেসব পবিত্র স্থানে গিয়ে আল্লাহর কাছে বান্দার দাসত্বের কপাল ঠেকাতে হবে। হৃদয় নিংড়ানো কান্না ও চোখের অশ্রু দিয়ে সেসব স্থান ভিজাতে হবে।
হজের আধ্যাত্মিক ও ইরফানি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ময়দানে মাহশারে সমবেত হওয়া এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার দৃশ্যপট ফুটে ওঠে। এই আনুষ্ঠানিকতায় রাজা ও প্রজা, ফকির ও আমির, বৃদ্ধ ও তরুণ, আরোহী ও পদাতিক, কালো ও সাদা, আরব ও অনারব সবাই একাকার হয়ে যায়। দুই টুকরা সিলাইবিহীন কাপড়, খালি মাথা, ক্রন্দনরত চোখ নিয়ে এক আসমানের নিচে, একই প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশ পানে দু’হাত তুলে হাজীরা ফরিয়াদ জানান। আপন হাকিকী মাবুদ ও প্রভুর সম্মুখে হাজির হওয়ার তীব্র অনুভূতি ও আনন্দে দোয়া, কান্না ও হৃদয় উজাড় করা প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর মাগফিরাত, গুনাহ থেকে মুক্তি ও রহমত লাভের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেন। কেউ সিজদায়, কেউ রুকুতে, কেউ দ-ায়মান অবস্থায় আর কেউ নামাযে দীর্ঘ সূরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে কিংবা কেউ কুরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করে অন্তরের মরিচা ও কালিমা দূর করার সাধনায় নিবেদিত থাকেন। অন্তরের মরিচা মুছে ফেলে অলসতা ও অবহেলা ঝেড়ে ফেলে নিজের আসল সত্তাকে জাগ্রত করেন। তাঁরা আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটে মহান রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যের চেতনায় বিগলিত হন।
হজের দর্শন ও কতিপয় হিকমত
ইহরামের কাপড় পরিধানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। ইহরামের এই কাপড়ই মানুষের সামনে হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি তুলে ধরে। রাজা-বাদশাহ থেকে নিয়ে ফকির-দরিদ্র, শাসক, শাসিত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, জ্ঞানী-মনীষী, গবেষক, রাজনীতিবিদ, আলেম, জাহেল অর্থাৎ সর্বস্তরের যেকোনো মানুষই পবিত্র হজে যাওয়ার নিয়্যত করবে প্রথম প্রস্তুতিতে তাকে একই ধরনের কাপড় পরিধান করে বের হতে হবে। সেলাইবিহীন দু’টুকরা কাপড়। এখানে কেউ দামী কিংবা বড়ত্ব প্রকাশের পোশাক পরিধান করতে পারবে না। যারা গরীব, যাদের কাপড় জীর্ণশীর্ণ, তাদের সামনে বেশভূষা নিয়ে বাহাদুরি প্রকাশের অনুমতি কারো নেই। এখানে সবাই এক সমান। বাহ্যিকভাবে কারো কোনো ফযিলত বা বিশেষত্বের অবকাশ নেই। এখানে প্রদর্শনী হলো ঈমানের স্তর, তাকওয়া, আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রবল ঈমানি উদ্দীপনার, যা প্রতিটি মুমিনের অন্তর্জগতে বিরাজমান।
যে ব্যক্তি যে পরিমাণ বা যে মানে উচ্চতর ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী হবে সে সে পরিমাণেই হজের ফযিলত ও হজের আহকামগুলো পালন করার স্বাদ ও মজা অনুভব করতে পারবে। ঠিক সে পরিমাণেই আল্লাহর মারেফাত ও সান্নিধ্য অর্জনের সৌভাগ্যে আপ্লুত হতে পারবে। এসব দৃশ্য ও বৈশিষ্ট্য মানুষের সামনে বৃহত্তম সেই হজ অর্থাৎ কেয়ামত দিবসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরাফাতের ময়দানের আহাজারি, সেখানে হৃদয় বিগলিত আকুতিতে দোয়া, পৃথিবীর সকল স্থান হতে সমবেত হওয়া, আল্লাহর দরবারে নিজের গুনাহর কথা স্মরণ করে রোনাজারি, আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভের জন্য একাগ্র প্রার্থনা ও নিবেদনে মানুষ এমনই আত্মমগ্ন হয় যে, নিজের আশেপাশে কে বা কারা আছে সে কথাও ভুলে যায়। এই দৃশ্যপট কেয়ামতের ময়দানের সমাবেশের সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। কেননা, তখনো মানুষ নিজের কর্মজীবনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আল্লাহর আদালতের সামনে বিচলিত অবস্থায় থাকবে। প্রত্যেকের একমাত্র আহাজারি থাকবে : ইয়া নাফ্সি! ইয়া নাফ্সি! হায় আমার কী অবস্থা হবে, হায়! আমার কোন্ গতি হবে! তখন নিজের হিসাব-কিতাব, ভবিষ্যৎ পরিণতি ছাড়া আর কোনো চিন্তাই কারো মাথায় থাকবে না।
হাশরের দিন কেয়ামতের ময়দানে মানুষ কোনোরূপ দুনিয়াবি সহায়-সম্পদ ব্যতিরেকে খালি হাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির হবে। সেদিন যে জিনিসটি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করবে তা হচ্ছে, কোনো ধরনের র্শিক ও গুনাহ থেকে মুক্ত, পবিত্র, নির্মল ও স্বচ্ছ অন্তর। কুরআন মজীদে এ কথাই ইরশাদ হয়েছে :
‘যেদিন কোনো সম্পদ বা সন্তান-সন্তুতি কোনো উপকারে আসবে না, তবে যে ব্যক্তি স্বচ্ছ অন্তর নিয়ে আল্লাহর সমীপে হাজির হবে সে-ই হবে সফলকাম।’ (সূরা শোয়ারা : ৮৯)
যার অন্তর যতখানি পবিত্র, নির্মল ও কলুষমুক্ত হবে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সে হবে ততই সম্মানিত এবং বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকাম হবে তার জন্য নির্ধারিত।
পবিত্র হজের মধ্যে মুসলমানদের জন্য অপর যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি রয়েছে তা হলো, প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনার শিক্ষা। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করতে হবে তার শিক্ষা। হজ হচ্ছে সময়ের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে কতিপয় আমল ও ইবাদত ঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়ার নাম। অর্থাৎ প্রত্যেকটি কাজ তার জন্য নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে আদায় করতে হবে এবং হজের দিনগুলো থাকতে থাকতেই সমস্ত হুকুম আঞ্জাম দিতে হবে। চিন্তা করলে মানব জীবনের গতিধারাও এটিই। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে একটি সীমিত ও নির্ধারিত সময় দিয়েছেন। এই সংক্ষিপ্ত সময় সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করতে হবে। পরকালীন জীবনের শান্তি, সুখ ও সৌভাগ্যের জন্য ইহকালীন জীবনের সুযোগকে সঠিক খাতে ও সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগাতে হবে। চিন্তা করলে দেখা যাবে হজের মধ্যে জীবন পরিচালনার এই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সুন্দর ও যত্নের সাথে সম্পন্ন হচ্ছে।
হজের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলামের সকল হুকুমের সার-নির্যাস অতি সংক্ষেপে হজে সন্নিবেশিত ও একীভূত পাওয়া যায়। তাওহীদ, নামায, রোযা, যাকাত, জিহাদ, যিক্র ও তাসবীহ হজের মধ্যে সুন্দর বিন্যাসে শামিল রয়েছে। নামাযের ফরয আদায়ের সময় যে কাজটি করতে হয় তা হলো শারীরিক ও আত্মিক তৎপরতা। যাকাতের প্রতীকী রূপ হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয় করা। ক্ষুধা, তৃঞ্চা, নাফ্সের কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি হচ্ছে রোযার প্রতীকী অনুশীলনের নাম। সাফা-মারওয়ার মাঝখানে যেভাব দৌড়াতে হয় এবং জামারায় শয়তানকে পাথর মারার যে ইবাদত তাকেও জিহাদের প্রতীকী রূপ হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। মোটকথা ইসলামে এমন কোনো ইবাদত ও আনুষ্ঠানিকতা নেই পবিত্র হজের মধ্যে যার নিদর্শন ও অনুশীলন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হজে এভাবে ইসলামের যাবতীয় ইবাদতের প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বিরাট শিক্ষা রয়েছে। একটু আগে যেমন আমরা উল্লেখ করেছি, মানুষের জীবন-প্রণালির সঙ্গে হজের সাদৃশ্য প্রচুর। হজের সময় আল্লাহর সকল আদেশ নিষেধ যেমন বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করতে হয়, তেমনি মানুষের গোটা জীবনযাত্রাও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে। হজের মধ্যে যেভাবে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ আহ্বান অসংখ্যবার বলতে হয়, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর তাওহীদের স্বীকৃতি দেয় এবং বিশ্বপালক মহান প্রভুর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের ঘোষণা দেয়, তেমনি প্রতিটি মুসলমানকে তার দীর্ঘ জীবনব্যাপী ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ ধ্বনির বাস্তব চিত্র কর্মজীবনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
হজের মানাসিকের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো জামারায় পাথর মারা। এই পাথর মারার সময় যদিও মূল লক্ষ্য একটি পাথরের স্তম্ভে পাথর কণা নিক্ষেপ করা; কিন্তু এর মধ্যেও বহু হিকমত ও দর্শন নিহিত রয়েছে। প্রথম হচ্ছে, এই আমলটি একথার প্রমাণ বহন করে যে, মুসলমানরা আল্লাহ তা‘আলা ও আল্লাহর রাসূল সাইয়্যেদুল মুরসালীন (সা.)-এর আদেশের সামনে শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করে। দ্বিতীয়ত, এই জামারার তিনটি স্তম্ভ আল্লাহর মহান পয়গাম্বর হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনের স্পর্শকাতর কয়েকটি মুহূর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর হুকুম পালন করার উদ্দেশ্যে প্রতিশ্রুত স্থানের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই শয়তান তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে এবং নানা প্ররোচনা দিয়ে ইবরাহীম (আ.)-কে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.) তার দিকে পাথর নিক্ষেপ এবং মহান শক্তিমান আল্লাহর কাছে শয়তানের অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা করে শয়তানের দুরাচার দমন করেন। এই ঘটনা এ কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, শয়তান জীবনভর মানুষের পেছনে লেগে আছে এবং মানুষকে গোমরাহ করার জন্য হরদম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাজেই প্রত্যেক মানুষকে যেভাবে যে পন্থায়ই হোক শয়তানকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই শয়তানের ধোঁকার শিকার হওয়া যাবে না। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, জামারায় পাথর নিক্ষেপের কাজটি হজের অন্য আমলের চাইতে বেশি মাত্রায় পালন করা হয়। কেননা, এ কাজটি আঞ্জাম দেয়ার জন্য হজযাত্রীকে টানা তিনদিন মিনায় অবস্থান করতে হয় এবং পরপর তিনদিন শয়তানকে পাথর মারতে হয়। বিষয়টি যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজ তার প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের দীর্ঘ জীবনব্যাপী মানব ও দানব শয়তানের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এবং এর প্রতি কোনো অবস্থাতেই মানুষের সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন উচিত নয়। এই চেতনাকে জাগরুক রাখা ও শিক্ষা দানের নিমিত্তে আল্লাহর জন্য ইবরাহীম (আ.)-এর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক স্থান মিনায় প্রত্যেক হাজীকে জামারায় অর্ধ শতাধিক পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।
মোটকথা হচ্ছে হজের প্রতিটি হুকুমের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ হিকমত ও জীবন দর্শন। এগুলোর পূর্ণ বিবরণ দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে মানুষের দুনিয়ার জীবন, কবরের জীবন, হাশরের ময়দানে উপস্থিতি, হিসাব-কিতাব ও রোজ কিয়ামতের দৃশ্যপটের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রদর্শনী।
পবিত্র হজের আধ্যাত্মিক দর্শন | |