ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের তাৎপর্য
রাশিদ রিয়াজ
প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা উদ্যাপন করি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। যদিও ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নিয়ে আমরা দুর্ভাগ্যবশত বিতর্ক ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে গেছি। রাহমাতুল্লিল আলামীন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনে দূরীভূত হয়েছিল অন্ধকার, নির্যাতন-নিপীড়ন-নিষ্পেষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল মানবতা। তার রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে আমরা হয় অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে গেছি বা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে না পারায় আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘোর অমানিশার অন্ধকারের সৃষ্টি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের তাৎপর্য কোথায়? আসলে আমরা নবী জীবন ও তার আদর্শ সঠিকভাবে উপলব্ধি করার পাশাপাশি তা আমাদের জীবনে কার্যকর করে তুলতে পারি নি। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য সৃষ্টি করেছে যা চিন্তা ও মননে যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে তেমনি লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিচ্ছে।
আল্লাহ মুসলমানদের বিশ্বে অনন্য জাতি হিসেবে তৈরি করেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে চিন্তাগত মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোতে পার্থক্য না থাকা সত্ত্বেও আমরা গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে নিজেদের মধ্যে এত বিভেদ তৈরি করেছি যা আমাদেরকে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় দূরত্ব তৈরি করছে। আল্লাহর রজ্জুকে যেখানে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার কথা বলা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে খোদার রঙে নিজেকে রাঙাও সেখানে লম্বা টুপি না গোল টুপি, দাড়ি কতটুকু লম্বা হবে না ছোট হবে কিংবা বিভিন্ন দিবস উদযাপন জায়েজ কি নাজায়েয এধরনের বিষয় যা মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় তা নিয়ে আমরা এতটাই সময় ব্যয় করেছি এবং এভাবে অনৈক্যের আবর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।
একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত মহানবী (সা.)-এর আদর্শকে পুরোপুরি অনুসরণ করা। আর তা করতে পারলে আমাদের বর্তমান দৈন্য দশায় নিপতিত হয়ে থাকার কথা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন মুসলমানদের কী অবস্থা! কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক, কি সামরিক সর্বক্ষেত্রেই মুসলমানরা মার খাচ্ছে। একই সঙ্গে ইসলামোফোবিয়া বা পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাসকে ইসলামের নামে ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী এমন একটি অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। পশ্চিমা মিডিয়া এধরনের অপপ্রচারের প্রধান ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। আর পশ্চিমা এই মিডিয়া কবলিত বিশ্বের বাকি দেশগুলোর মিডিয়া তাদের আবহেই খবরগুলো পরিবেশন করছে।
এমনি প্রেক্ষাপটে ঈদে মিলাদুন্নবী প্রতিবছর আমাদের দরজায় কড়া নাড়িয়ে জানিয়ে যাচ্ছে, আমরা কতটা নবীজীর আদর্শ সম্পর্কে জেনে বুঝে এবং সে অনুযায়ী জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দিবস উদযাপন আমাদেরকে সেই দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে আরো গভীরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এটা শিশু থেকে তরুণ-তরুণী, এমনকি বয়স্কদের পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্নভাবে বিষয়টি অনুধাবনের উপাদান যোগায়। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনে একটি শিশু সহজেই জানতে চাইবে নবীজী (সা.) শিশুদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন, তিনি শিশুদের কী বলতেন, কতটা আদর করতেন, তেমনি তরুণদের সবচেয়ে সোনালি জীবনের অংশে তাদের প্রতি নবীজীর কী আহ্বান ছিল, বয়স্কদের প্রতি কী কী বিষয়ে নবীজী (সা.) হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ইত্যাদি।
এখন দিবস উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গেই যেমন বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না তেমনি ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের প্রতিনিয়ত নবীজী (সা.)-এর আদর্শ থেকে আমরা আসলে কতটা দূরে কিংবা কতটা কাছে অবস্থান করছি সেই সম্পর্কে আত্মসমালোচনার তাগিদ সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে যাঁর কারণে আমরা ইসলাম পেলাম তাঁর আগমনের দিনটি আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই অনেক গুরুত্ব বহন করে। কোন পরিস্থিতিতে, কোন প্রেক্ষাপটে তাঁর আগমন, আরবে তখন সার্বিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট কেমন ছিল আর আজকেই বা আমাদের জীবন যাত্রা কেমন চলছে তার মধ্যে একটা পার্থক্য যাচাই বাছাই করে নেয়ার এক মহাসুযোগ আমরা যে কোনো সময় পেতে পারি একথা যেমন সত্যি তেমনি দিবসের তাৎপর্য আমাদের মনে তা আরো বদ্ধমূল করে দিয়ে যায়।
আমরা অনেক সময় শিশুদের অযথা বকা দেই। গায়ে হাত তুলি। বাচ্চারা মসজিদে নামাযে গেলে অনেক সময় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সে হয়ত হেসে ওঠে, দুষ্টুমি করে, কিন্তু আমরা এমনভাবে চোখ রাঙ্গাই বা গালমন্দ করি তাতে মসজিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অথচ আমরা জানি যে, নবীজীর নামায পড়া অবস্থায় অনেক সময় তাঁর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন শিশুকালে তার কাঁধে উঠে যেতেন, নবীজী (সা.) তাঁদেরকে হাত দিয়ে সামলিয়ে সেজদায় অবনত হতেন। এমনকি সেজদায় যদি শিশু হাসান ও হোসাইন নবীজীর পিঠে চড়ে বসতেন, যতক্ষণ না তাঁরা নামতেন, নবীজী সেজদা থেকে উঠতেন না। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বাচ্চারা স্কুলে ছুটি পায়। নবীজী সম্পর্কে বিশেষ ক্লাস নেওয়া বা রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষকরা শিশুদের কচি মনে চমৎকার ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন।
অপসংস্কৃতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার না করা, খেলার মাঠের অভাবে অতিরিক্ত টিভি না দেখা, মাদকাসক্ত হয়ে না পড়া, অসৎ সংসর্গে না যাওয়া, মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া, পিতামাতা ও গুরুজনদের মেনে চলা, ছোটদের স্নেহ করা সহ হরেক রকম প্রায়োগিক শিক্ষা শিশু যদি পেয়ে থাকে এবং তার অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে বাকি জীবনে তার পথভ্রষ্ট হওয়ার সুযোগ খুব কমই থাকে।
এবার আসা যাক তরুণ-তরুণীদের বিষয়ে। প্রচণ্ড অভিমানী এ জীবনে ভালোবাসার কাঙ্গাল মন নিয়ে কিশোর-কিশোরীরা তরুণ ও তরুণীর বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের উপযোগী করে নবীজী (সা.)-এর আদর্শের পূর্ণ পরিচয় জানান দেয়ার এক বিশাল দায়িত্ব আমাদের সকলের। একটি দেশের জনসংখ্যার ৩ থেকে ৪ কোটি তরুণ-তরুণী আগামী দিনের নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নেবে। অপসংস্কৃতির জোয়ারের জোয়াল তার কাঁধে চেপে বসলে সে না পারে নিজেকে আলোকিত করতে, না পারে সমাজকে আলোকিত করতে। আগামী দিনের জন্য তার ব্যক্তিত্ব নির্মাণে ঈদে মিলাদুন্নবী তাই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এরপর বয়স্কদের কথা না বললেই নয়। জীবনের অনেক ত্রুটি নিজের কাছে ধরা পড়তে থাকে বলে মন অনেকটা থিতু হয়ে আসে। আর ভুল বুঝতে পেরে অন্য কেউ যাতে একই ভুলের ফাঁদে পা না দেয় সেজন্য নিজে শুধরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্যকে নতুন পথের সন্ধান দেয়া জরুরি হয়ে ওঠে মাঝ বয়সী থেকে শুরু করে মুরুব্বিদের মাঝে। ঈদে মিলাদুন্নবী তাঁদের কাছেও এক নতুন জীবনের হাতছানি দিয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু আমরা যদি ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে নিজেরাই বিপথগামী হয়ে তর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে থাকি তাহলে নিজে ও চারপাশ পরিবর্তনের সুযোগ পাব কিভাবে? নানা বিতর্কের আবর্তে পড়ে ঈদে মিলাদুন্নবীর মূল তাৎপর্য খুঁজে ফেরার পথই আমরা হারিয়ে ফেলছি। এটাতো সত্য, নবীজী আমাদের জীবনকে সহজ সরল সুন্দর করে তুলতে তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। কবে, কখন, কোথায় এসব নিয়ে বিস্তর বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে আসুন আমরা নিজেদের উপলব্ধি করার প্রস্তুতি নেই। তাঁর আদর্শ এখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু যে ফেতনা-ফ্যাসাদ আমাদের পেয়ে বসেছে তা নিশ্চিত নবীজীর কাছ থেকে আমাদেরকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বরং প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবীতে আমাদের শপথ আরো অনেক দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে ধাপে ধাপে ধারাবাহিকভাবে নবীজীর আদর্শ অনুসরণের মধ্য দিয়ে।
ঘরে যথেষ্ট সময় দিতেন নবীজী (সা.)। বিবিদের রান্নার কাজে সহায়তা করতেন। নারীকে আজকের সমাজে পণ্যের বিজ্ঞাপন করে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা প্রদর্শন বস্তু করে তুলে ফেলেছি। ফ্যাশন সংস্কৃতিতে যেটি প্রকট হয়ে দেখা যায়। এরপর নারীর প্রতি সহিংস আচরণ পত্রিকা খুললেই আমাদের মনকে কেন প্রভাবিত করে না বুঝি না। প্রবঞ্চনা, নারীকে ঘরের যাবতীয় কাজের মধ্যে ফেলে রেখে তাকে যেন কলুর বলদ করে ফেলেছে। সমাজ গঠনে নারীর অংশগ্রহণে নবীজী (সা.) কী বলেছেন আমরা তা ভুলেই গেছি। নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা যদি মুসলমান হয়ে নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে অন্য সমাজে নারীর প্রতি আচরণ আমাদের পরিবারকে ভাঙ্গনের মুখে নিয়ে যাবে। আমাদের সন্তানরা দিশেহারা, হতাশার ছোবলে পড়ে নিজেকে ধংসের পথে নিয়ে যেতে পারে। একবার নবীজী (সা.) মসজিদে সাহাবাদের সাথে মজলিসে ছিলেন। সেখানে মা ফাতেমা এলে তিনি দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন। একজন নবী হয়েও নারীর প্রতি এতটা সম্মান দেখানোর জন্য সাহাবারা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তিনি এটা করলেন। নবীজী তাঁদেরকেও নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করার কথা বলেছিলেন। নারী শুধু জায়া, জননী, কন্যা নয়, সমাজ, ঘর, সংসার থেকে রাষ্ট্র গঠনের কারিগর সে।
ইরান ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালন করে আসছে। এ ঐক্য সপ্তাহে মুসলিম দেশগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের নবীজীর আদর্শ অনুসরণে পিছিয়ে থাকা বা কোনো কোন ক্ষেত্রে অগসর হওয়া সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর চিন্তা করে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যকে কমিয়ে আনার একটা উপায় খুঁজে পেতে পারে। মুসলমানদের যে একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এথেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার মধ্যেই ঐক্যের মূলভিত্তি নিহিত রয়েছে তা উপলব্ধি করতে না পারলে পরাশক্তি কর্তৃক উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে আমরা উদ্ধার পাব না। আমাদের তেলসম্পদ, মানবসম্পদ, মেধাশক্তি ব্যবহার করে অন্যরা লাভবান হবে আর আমরা চিরকাল বিভেদে খাঁচার পাখির মতো কেবল ডানা ঝাপটিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব তা কখনো হতে পারে না। এভাবে বিভ্রান্তিতে থাকলে আমরা শুধু নিজেদেরকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। পরাশক্তির কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে নিজের ভাইদের ওপর তা নিক্ষেপ করতে থাকব এবং পরাশক্তি আড়ালে ও প্রকাশ্যে আমাদের দেখে হাসবে আর আমাদের পিঠ চাপড়ে দেবে।
এজন্য শুধু নবীজী (সা.)-কে বুঝতে হবে, জানতে হবে। ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে যদি তার সামান্য সুযোগ আমরা পাই তাহলে তা থেকে বিরত থাকব কেনো? বিদাত নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে আমরা যেন নবীজীকে বুঝে ওঠার সুযোগ থেকে দূরে না থাকি। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যবস্থা বুঝে ওঠার কৌশল আয়ত্তে আনতে হবে। যেখানেই পরাশক্তির কূটনীতি মার খাচ্ছে সেখানেই বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কখনো তা আইএস, কখনো তা আল কায়েদা ইত্যাদি নামে। এতে সারাবিশ্বে মুসলমানদের ওপর ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে কারা ইসলাম থেকে মানুষকে আরো দূরে সরিয়ে রাখছে তা উপলব্ধি করতে হবে। নবীজী (সা.) দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন ও সুদূর চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞান অর্জনের কথা বলে গেছেন। আজকাল প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। আপনার হাতে যে মোবাইল ফোনটি তা দিয়েও আপনি বিশ্বের সমসাময়িক প্রসঙ্গ জানতে পারেন। উপলব্ধি করতে পারেন মুসলমান বলেই কি আমরা শুধু নিগৃহিত হচ্ছি, কিন্তু কেন, জ্ঞানই শক্তি তা কি আমরা ভুলে গেছি? আল্লাহর নবীজী একবার নামায পড়তে যাবার সময় দেখেন তাঁর প্রিয় বিড়ালটি চাদরের ওপর ঘুমাচ্ছে। বিড়ালটির ঘুম নষ্ট না করে তিনি কাঁচি দিয়ে আস্তে করে চাদরটির এক অংশ কেটে তা পড়ে নামাযে গেলেন। একটি বিড়ালের প্রতি তাঁর আচরণ মুসলমান হিসেবে আমাদের স্বভাবে রয়েছে। তাই মুসলমানরা কখনো বোমা ব্যবহার করে জিহাদের নামে সমাজে সন্ত্রাস করতে পারে না। তার ধর্ম কিভাবে জঙ্গি তৎপরতাকে সমর্থন করবে? কখনোই না। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা কখনো কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। অস্ত্র দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে গোপনে কারা এসব ছড়িয়ে দিয়েছে তাও বুঝে উঠতে না পারলে আমাদের সন্তানরা বিভ্রান্ত হবে। জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র, একথা নবীজী (সা.) কেন বলেছেন, তাও বুঝতে হবে।
ধর্মকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রেখে অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবধরনের জ্ঞান বিমুখ হয়ে আমাদের ভাগ্য সুবিধাবাদীদের হাতে বন্ধক রেখে ভাগ্যের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই। শোষণের হাতিয়ার ও অত্যাচারীর খড়গ কিভাবে আমাদের ওপর নেমে আসে তা যদি বুঝতেই না পারি, পুঁজিবাদ ও সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা কিভাবে আমাদেরকে পুঁজিপতিদের দাস বানিয়ে রেখেছে তার গোমর যদি ধরতেই না পারি তাহলে এক আল্লাহর জীবন ব্যবস্থা তাঁর দেয়া এ জীবনে আমরা কিভাবে আয়ত্ত করতে পারব? ঈদে মিলাদুন্নবীতে সেই মেধার আবাদ শুরু করতে হবে। যে জরাজীর্ণ ব্যবস্থা আমাদের ধ্বংস করছে তার সমাধান বা ব্যবস্থাপনায় ইসলাম কি দিয়ে গেছে তা আঁকড়ে ধরতে শিখতে হবে। নবীজী (সা.) বলেছেন, আগুন যেমন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, দারিদ্র্য তেমনি ঈমানকে খেয়ে ফেলে। আপনি যদি দরিদ্র হন তাহলে অপরের কাছে হাত পাততে হয়। যে মুহূর্তে আপনি হাত পাতলেন, অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হলেন তখন তার প্রতি আপনাকে অনুগত হতে হয়। আপনি আপনার মেরুদণ্ড সোজা করে সহজে উঠতে পারবেন না। প্রযুক্তি, পুঁজি ও ভালো জীবনের জন্য বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। এটা যদি না করতে হয় সে জন্য আপনাকে ইসলাম কী অনুসরণ করতে বলেছে, ঈদে মিলাদুন্নবীতে আসুন তার তালাশ করি। এটা করতে পারলে আমরা আমাদের নিজেদের স্বাবলম্বী করার মধ্য দিয়ে সমাজে সাম্য সৃষ্টি করতে পারব। বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করতে পারব। ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে, নিজের স্বার্থকেই শুধু প্রাধান্য দিয়ে সুন্দর সমাজ গড়তে পারব না। আমাদের বড় বিচ্যুতি হলো জ্ঞান থেকে নিজেকে বিমুখ করে রাখা। আর যাচাই না করে কোন তথ্যকে মেনে নেওয়া। আর মেনে নিচ্ছি বলেই আমাদের নিয়ে পরাশক্তির পাতা ফাঁদ ও চক্রান্ত তার উপাদান চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আমরা সচেতন হতে পারছি না। একবার ভাবুন যে সম্পদ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মুসলিম দেশগুলোকে দিয়েছেন তার সঠিক ব্যবহার না করে, তার চেষ্টা অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করে না আমরা ইহকালে লাভবান হচ্ছি না পরকালে লাভবান হব?
এজন্যই ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে মুসলমানদের মধ্যে ছোটখাট মতভেদ ভুলে যাওয়া। কে কালো, কে সাদা, কে ধনী, কে গরীব তা এক কাতারে নামাযে দাঁড়ালে যদি আমাদের খেয়াল না থাকে তাহলে সার্বিক জীবনযাত্রায় তা কেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়? আর এ বাধা থাকলে আমরা কি কখনো আমাদের মেধার সঠিক ব্যবহার করতে পারব? কখনো কি নিজেদের কৌশলগত অবস্থান টের পাব। দুর্ভিক্ষ নয়, গোলা ভরা ধান, হীনমন্যতা নয়, ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে বুকে আঁকড়ে ধরে, ‘পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ নয়, সম্পদের মালিকানা আল্লাহর’- এ বিশ্বাসের কার্যকর নজির উপস্থাপন করে বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মতো নবীজীর অসংখ্য শিক্ষা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবীতে আমাদের ডাক দিয়ে যায়। যা অনুসরণ করে আমরা প্রথমে আমাদের জীবন এবং সার্বিকভাবে পুরো বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারি।
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের তাৎপর্য | |