এজেন্সি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে একটি ভূমিকা, চৌদ্দটি পরিচ্ছেদ এবং একশ সাতাত্তরটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং এই সরকার ব্যবস্থার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বেলায়েতে ফকীহ এবং গণরায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণরায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এই সরকার ব্যবস্থায় রাহবার বা সর্বোচ্চ নেতা হবেন একজন ন্যায়পরায়ণ মুজতাহিদ বা ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ। তিনি জনসাধারণের পরোক্ষ ভোটে অর্থাৎ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কাঠামো বা বিভাগগুলো হবে নিম্নরূপ : আইন বিভাগ,নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। মজলিসে শুরায়ে ইসলামি বা পার্লামেন্টের সদস্যগণ এবং প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইসলামি আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত অভিভাবক পরিষদ ইসলামি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদিত আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে ইরানি সমাজের অর্থনৈতিক,সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোগুলোর ব্যাখ্যা ইসলামের মূল নীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে উপস্থাপিত হয়েছে,যা ইসলামি জাতির প্রাণের দাবির বহিঃপ্রকাশ। ইরানের মহান ইসলামি বিপ্লবের প্রকৃতি এবং সূচনা থেকে বিজয় পর্যন্ত মুসলিম জনতার সংগ্রামের গতিধারা এই মৌলিক দাবির উদ্ভব ঘটিয়েছে যা সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেছে সর্বস্তরের জনগণের দৃঢ় এবং আপোসহীন স্লোগানে। মহান বিজয়ের সূচনালগ্নে এখন আমাদের জাতি পূর্ণ অস্তিত্ব দিয়ে দেই সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। আদর্শিক এবং ইসলামি চরিত্র এই বিপ্লবকে গত এক শতকে সংঘটিত ইরানের অন্যান্য আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে। ইরানের মুসলিম জাতি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন উত্তরণের মাধ্যমে যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তা থেকে তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, বিগত আন্দোলনগুলো আদর্শিক না হওয়ার কারণেই সফলতা লাভ করতে পারে নি। যদিও সাম্প্রতিক কালের ঐ সব আন্দোলনে ইসলামি চিন্তা-চেতনা এবং সংগ্রামী আলেমদের নেতৃত্ব মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তারপরও প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ঐ আন্দোলনগুলো খুব দ্রুত নিরুদ্যম হয়ে পড়ে। ফলে প্রখ্যাত মার্জায়ে তাকলিদ (উচ্চ প্রজ্ঞাসম্পন্ন ফকীহ বা আলেম) হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খোমেইনি (র.)-এর নেতৃত্বে জাতির জাগ্রত বিবেক খাঁটি ইসলামি এবং আদর্শিক আন্দোলনের অপরিহার্যতা অনুভব করে। তাই দেশের সংগ্রামী আলেম সমাজ- যাঁরা সর্বদা গণআন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং প্রত্যয়ী লেখক ও বুদ্ধিজীবিগণ (ইমাম খোমেইনির) নেতৃত্বে নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। (ইরানি জাতির এই আন্দোলন ১৩৮২ হিজরি মোতাবেক ১৩৪১ ফারসি সাল,১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সূচিত হয়)
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর ইরানের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্ভরশীলতাকে পাকাপোক্ত করতে এবং স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে মার্কিন ষড়যন্ত্রের (শ্বেত বিপ্লব) বিরুদ্ধে ইমাম খোমেইনির বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীকালে ফারসি ১৩৪২ সালের খোরদার মাসে (জুন-১৯৬৩) সংঘটিত ইসলামি জাতির রক্তাক্ত বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে গৌরবময় ও গণজাগরণের পেক্ষাপট তৈরি করেছিল এবং ইসলামি নেতা হিসেবে ইমামের অবস্থানকে শক্তিশালী ও সংহত করেছিল। কলঙ্কজনক আইন কেপিচ্যুলেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার কারণে ইমামকে নির্বাসনে পাঠানো সত্ত্বেও জতির সাথে ইমামের দৃঢ় সম্পর্ক অটুট থাকে এবং এই মুসলিম জাতি বিশেষ করে প্রত্যয়ী বুদ্ধিজীবী ও সংগ্রামী আলেম সমাজ নির্বাসন, মৃত্যুদণ্ড ও জেল-জুলুম উপেক্ষা করে তাঁদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। এভাবে সমাজের সচেতন ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মসজিদ, মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা নিজেরা ইসলাম ও বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে চলমান সংগ্রাম সম্পর্কে ইরানের মুসলিম জাতির জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফলপ্রসূ ও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার ইসলামি আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ফায়জিয়া মাদ্রাসা,বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিপ্লবী কেন্দ্রের ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে;এবং বিপ্লবী জনতার রোষানল থেকে বাঁচার জন্য চরম পাশবিকতার আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুসলিম জাতি চলমান সংগ্রামের প্রতি তাদের অনড়-অবিচল অবস্থানের মাসুল দেয় মৃত্যুদণ্ড,মধ্যযুগীয় নির্যাতন ও দীর্ঘমেয়াদি কারাবরণের মাধ্যমে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব সেই সব ঈমানদার তরুণ-তরুণীর রক্তে গতি লাভ করে যারা ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই বধ্যভূমিগুলোতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ফরিয়াদ করতো কিংবা যারা বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটে শত্রুপক্ষের গুলির নিশানায় পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন উপলক্ষে প্রেরিত ইমামের বাণী বা বার্তা এই মুসলিম জাতির মনোবল ও সঙ্কল্পকে করেছে শাণিত।
ইসলামি শাসন ব্যবস্থা
স্বৈরাচারী শাসনামলের চরম শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে ইমাম খোমেইনি (র.) বেলায়েতে ফকীহ (শ্রেষ্ঠ ইসলামি আইনজ্ঞের শাসন) ভিত্তিক ইসলামি শাসন ব্যবস্থার পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন, যা মুসলিম জনগণের মাঝে সুনির্দিষ্ট ও নতুন চেতনার জন্ম দেয় এবং ইসলামি ভাবধারার আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে। ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে সংগ্রামী এবং আদর্শিক মুসলমানদের তৎপরতা আরো গতিশীল হয়। এই পথ ধরে আন্দোলন অব্যাহত থাকে, অবশেষে একদিকে ভেতরের চাপ ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা অপর দিকে সংগ্রামী আলেম ও ছাত্রসমাজ কর্তৃক বহির্বিশ্বে সংগ্রামের খবর প্রতিফলিত হওয়ায় স্বৈরাচারী শাসনের ভিত নড়ে ওঠে। ফলে সরকার ও তার প্রভুরা জনগণের ওপর চাপ কমাতে এবং রাজনৈতিক পরিবেশ উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়। তাদের ধারণা ছিল এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের অনিবার্য পতন ঠেকানো যাবে এবং তাদের ওপর জনগণের আস্থার বাতাবরণ তৈরি হবে। কিন্তু ইমামের নিরবচ্ছিন্ন ও দৃঢ় নেতৃত্বে সচেতন, সঙ্কল্পবদ্ধ ও বিপ্লবী জনতা দেশ জুড়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সফল আন্দোলন ব্যাপকভাবে শুরু করে।
জনতার ক্রোধ
ফারসি ১৩৫৬ সালের ১৭ দেই (৭ জানুয়ারি ১৯৭৮) শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আলেমসমাজ বিশেষ করে ইমাম খোমেইনি (র.)-এর উদ্দেশ্যে অবমাননাকর চিঠি প্রকাশিত হলে এই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে এবং দেশ জুড়ে জনগণের মাঝে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সরকার প্রতিবাদী আন্দোলন দমনের জন্য রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। কিন্তু এই পদক্ষেপের কারণে বিপ্লবের ধমনীতে আরো বেশি রক্ত সঞ্চালিত হয়। বিপ্লবের শহীদদের শাহাদাতের সপ্তম ও চল্লিশতম দিবসে অনুষ্ঠিত স্মরণসভাগুলোতে বিপ্লবের হৃদস্পন্দন দেশ জুড়ে চলমান আন্দোলনে প্রাণের সঞ্চার করে এবং আন্তরিকতা ও ঐক্যের স্পৃহাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। দেশের সকল প্রতিষ্ঠান গণআন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে এবং সর্বাত্মক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়ে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে ঐক্যের এই বন্ধন বিপ্লবী আন্দোলনকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্থবহ করে তুলেছিল। বিশেষ করে এই মহান জিহাদের সর্ব ক্ষেত্রে নারী সমাজের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক মাত্রায়। লড়াইয়ের ময়দান বা মেশিনগানের দিকে সন্তান কোলে নিয়ে মায়েদের ধাবমান হওয়ার দৃশ্যগুলোই প্রমাণ করে এই সংগ্রামে নারীসমাজের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল!
জাতি যে মূল্য দিয়েছে
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরন্তর সংগ্রাম, কয়েক বিলিয়ন তুমান (ইরানি মুদ্রা) আর্থিক ক্ষতি, ৬০ সহস্রাধিক শহীদ, লক্ষ আহত ও পঙ্গুর রক্তে পুষ্ট হয়ে এই বিপ্লবের চারা গাছ ‘মুক্তি, স্বাধীনতা, ইসলামি শাসন ব্যবস্থা’ এই সেøাগানের মধ্য দিয়ে ফলবান হয়ে ওঠে। এই মহাবিপ্লব ঈমান, ঐক্য, সংবেদনশীল ও সঙ্কটময় সময়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জাতির আত্মত্যাগের ফলে বিজয় অর্জন করে এবং সাম্রাজ্যবাদের সকল হিসেব-নিকেশ উল্টে দিতে ও তাদের সকল প্রতিষ্ঠান এবং বন্ধন ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের বড় গণ বিপ্লবগুলোর ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। ফারসি ১৩৫৭ সালের ২১ ও ২২ বাহমান (১৯৭৯ সালের ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি) রাজতন্ত্রের ভিত ধসে পড়ে, এর ফলে অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার এবং বিদেশী আধিপত্যের পরাজয় নিশ্চিত হয়। এই মহা বিজয়ই ইসলামি হুকুমাতের সূচনাকে নিশ্চিত করে যা ছিল মুসলিম জনগণের দীর্ঘ দিনের আকাঙ্ক্ষা এবং এটি চূড়ান্ত বিজয়ের সুসংবাদ বয়ে আনে। ইরানের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে এবং দেশের বরেণ্য আলেমগণ ও মার্জায়ে তাকলিদগণ ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত ও বলিষ্ঠ রায় ঘোষণা করেন। ৯৮.২ ভাগ ভোট পড়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থার পক্ষে। সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও এর পারস্পরিক সম্পর্কের নির্ধারক হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানই ইসলামি শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা এবং বিধ্বস্ত পূর্ববর্তী শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থার রূপরেখা উপস্থাপন করার পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে।
ইসলামে সরকার ব্যবস্থার কাঠামো
ইসলামের দৃষ্টিতে সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতা শ্রেণিগত দৃষ্টিকোণ কিংবা ব্যক্তি বা দলীয় কর্তৃত্বকামিতা থেকে উৎসারিত নয়। বরং তাতে একই চিন্তা ও বিশ্বাসের অধিকারী কোন জাতির রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিফলিত হয়। এটি সংঘবদ্ধ এজন্য যাতে আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত লক্ষ্যে (আল্লাহর পথে চলার) উপনীত হওয়ার পথ সুগম করা যায়। আমাদের জাতি বৈপ্লবিক পূর্ণতার গতিপথে নিজেদেরকে তাগুতের (খোদাদ্রোহী শক্তির) ময়লা ও মরিচা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এবং বিজাতীয় মতাদর্শের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে পবিত্র করে প্রকৃত ইসলামি মতাদর্শ ও বিশ্বদর্শনের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। এখন তারা ইসলামি নীতিমালার ভিত্তিতে নিজেদের জন্য আদর্শ সমাজ গড়তে চায়। এরই ভিত্তিতে সংবিধানের কর্তব্য হচ্ছে বিপ্লবের আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করা এবং মানুষ যাতে ইসলামের সুউচ্চ ও সর্বজনীন মূল্যবোধ অনুসারে প্রতিপালিত হতে পারে সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা। ইরানের বিপ্লব হচ্ছে সবলের (মুস্তাকবিরীন) ওপর দুর্বলের (মুস্তাদআফীন) বিজয়; এর ইসলামি বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংবিধান দেশের ভেতরে ও বাইরে এই বিপ্লব অব্যাহত রাখার সুযোগ রাখবে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামি আন্দোলসমূহ এবং মুসলিম জনগণের সাথে সম্পর্ক বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বে একক জাতি (উম্মাহ) গঠনের পথ সুগম করবে (ان هذه امتكم امة واحدة وانا ربكم فاعبدون) । বঞ্চিত ও নির্যাতিত জাতিসমূহের মুক্তির জন্য এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। এই মহাবিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট্যের কারণে এই সংবিধান অর্থনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য এবং যে কোন ধরনের সামাজিক ও মানসিক স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিভূ; এবং স্বেচ্ছাচারিতাকে নির্মূল করে জনগণের ভাগ্য জনগণের হাতে অর্পণ করার জন্য সচেষ্ট (ويضع عنهم اصرهم والاغلال التى كانت عليهم) । রাজনৈতিক বুনিয়াদ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা সমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি; আদর্শিক বিবেচনায় উত্তীর্ণ সৎকর্মশীল ব্যক্তিরাই দেশ ও শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন (ان الارض يرثها عبادى الصالحون) । আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান-যা সমাজ পরিচালনার নিয়ম-কানুনের ব্যাখ্যাতা-কোরআন ও সুন্নাহর বৃত্তে আবর্তিত হবে। অতএব, ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ, প্রত্যয়ী ইসলাম বিশেষজ্ঞদের (ন্যায়পরায়ণ ফকীহবৃন্দ বা ইসলামি আইনজ্ঞ) আন্তরিক ও নিবিড় তত্ত্বাবধান অত্যন্ত জরুরি। শাসনক্ষমতার উদ্দেশ্য যেহেতু ঐশী জীবন বিধানের দিকে পথ চলায় মানুষের উন্নতি বিধান করা, (و الى الله المصير) যাতে মানব সত্তায় বিদ্যমান ঐশী চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে (تخلقو باخلاق الله) সহজাত প্রবণতা বা প্রতিভাগুলো বিকশিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়, তাই সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সমাজের সকল অংশের সক্রিয় ও ব্যাপক অংশগ্রহণ ব্যতীত এটি সম্ভব হতে পারে না। কাজেই রাজনৈতিক ও ভাগ্য নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল ক্ষেত্রে সংবিধান সমাজের সকল সদস্যের অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করবে যাতে মানুষের পরিপূর্ণতা অর্জনের গতিপথে প্রত্যেকেই এর সাথে জড়িত হতে পারে এবং সমাজের নেতৃত্ব, উন্নতি ও অগ্রগতিতে অংশীদার হতে পারে। এটা হবে পৃথিবীতে মুস্তাদআফদের (দুর্বলদের) শাসনক্ষমতা লাভের সেই (প্রতিশ্রুতির) বাস্তবায়ন।
نريد ان نمن على الذين استضعفوا فى الارض و نجعلهم ائمة ونجعلهم الوارثين-
বেলায়েতে ফকীহ
বেলায়েতে ফকীহ বা ন্যায়পরায়ণ ইসলামি আইনজ্ঞের শাসন ইসলামি মৌলিক নীতিমালা এবং ইমামতের ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; জনগণ কর্তৃক নেতা (রাহবার) হিসেবে স্বীকৃত সার্বিক যোগ্যতার অধিকারী ইসলামি আইনজ্ঞের (ফকীহ) নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে সংবিধান। (مجارى الامور بيد العلماء بالله الامناء على حلاله وحرامه) যাতে প্রকৃত ইসলামি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থার বিচ্যুতি প্রতিহত করা যায়।
অর্থনীতি হচ্ছে মাধ্যম
অর্থনৈতিক বুনিয়াদগুলো মজবুত করাই অর্থনীতির লক্ষ্য নয়; মূল লক্ষ্য হবে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতিপথে মানুষের প্রয়োজন মেটানো। অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতো শুধু মুনাফা বৃদ্ধি বা সম্পদ পুঞ্জিভূত ও কেন্দ্রীভূত করা এর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বস্তুবাদী মতবাদগুলোতে অর্থনীতি হচ্ছে নিজেই লক্ষ্য; ফলে মানবিক উন্নয়নের প্রবাহে অর্থনীতিই অধঃপতন, দুর্নীতি ও ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামে অর্থনীতি হচ্ছে মাধ্যম; আর কোন মাধ্যমের নিকট থেকে মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উত্তম কার্যক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইসলামি অর্থনীতির পরিকল্পনা হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন সৃজনশীলতা বিকশিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কাজেই সকলের জন্য কর্ম সংস্থান করা, উপযুক্ত ও সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন তৎপরতার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব ইসলামি সরকারের।
সংবিধানে নারীর অবস্থান
ইসলামি সমাজের ভিত্তিগুলো গড়ে ওঠার পর জনগণ-যারা এ যাবৎ সার্বিকভাবে বিদেশী শোষণের অন্তর্গত ছিল-নিজেদের আত্মপরিচয় ও মানবিক অধিকার পুনরায় ফিরে পায়। এই ফিরে পাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাগুতি (খোদাদ্রোহী) শাসনামলে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার নারীসমাজই তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক একক এবং মানুষের নৈতিক উন্নতি ও উৎকর্ষের প্রাণকেন্দ্র। ফলে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পারিবারিক একক সম্পর্কে এই উপলব্ধির আলোকে নারী বঞ্চনা, ভোগ্য বস্তুতে পরিণত হওয়া কিংবা ভোগবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া থেকে মুক্ত হয়ে চৌকস ও আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার জন্য মাতৃত্বের কঠিন ও মূল্যবান দায়িত্ব পুনঃঅর্জনের মাধ্যমে জীবনের কর্মশীল ক্ষেত্রগুলোতে হবে পুরুষের সহযোদ্ধা। ফলে নারী অতি গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ এবং ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারিণী হবে।
ইসলামি মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী
দেশের সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও সুসজ্জিতকরণের ক্ষেত্রে ঈমান ও ইসলামি শিক্ষাকে ভিত্তি ও নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই কারণে উল্লিখিত লক্ষ্য অনুসারে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে গড়ে তোলা হবে। তারা শুধু দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হবে না; বরং ইসলামি মিশনকে পূর্ণতা প্রদান করতে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং বিশ্বে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন বিস্তৃত করার সংগ্রামও তাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
(واعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل ترهبون به عدو الله وعدوكم وآخرين من دونهم)
বিচার ব্যবস্থা
ইসলামি আন্দোলনের ধারা অনুসারে মানুষের অধিকার রক্ষা করা এবং ইসলামি জাতির অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিভ্রান্তি প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বিচার ব্যবস্থা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কাজেই ইসলামি ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে এবং ইসলামি বিধি-বিধানের সাথে গভীরভাবে পরিচিত, ন্যায়পরায়ণ বিচারকগণের সমন্বয়ে বিচার বিভাগ গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। সংবেদনশীলতা এবং আদর্শিক দিক বিবেচনা সাপেক্ষে বিচার ব্যবস্থাকে যে কোন ধরনের অসুস্থ সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। (واذا حكمتم بين الناس ان تحكموا بالعدل)
নির্বাহী বিভাগ
সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে ইসলামি আইন ও বিধি-বিধান বাস্তবায়নের যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তেমনি ভাবে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার কারণে নির্বাহী বিভাগকে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচনকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। ফলে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়াকে মন্থর কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন যে কোন জটিল প্রশাসনিক পদ্ধতি ইসলাম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবে। কাজেই আমলাতন্ত্র যা তাগুতি শাসনামলের অর্জন, তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অপসারণ করা হবে যাতে প্রশাসনিক কর্মকা-ে গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।
গণমাধ্যম
গণমাধ্যম অবশ্যই ইসলামি বিপ্লবের অগ্রগতি এবং ইসলামি সংস্কৃতি প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে সুস্থ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ থেকে গণমাধ্যম লাভবান হবে এবং ক্ষতিকারক ও ইসলামবিরোধী প্রথা বা রীতির প্রচলন ও প্রসার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকবে। যে আইনের মৌলিক বিষয়গুলো মানব জাতির সম্মান ও স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য মনে করে এবং মানুষের পূর্ণতা ও উন্নয়নের পথকে সুগম করে দেয় তা অনুসরণ করা সকলেরই কর্তব্য। এটি অত্যন্ত জরুরি যে, মুসলিম জাতি যোগ্য ও ঈমানদার কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করে এবং তাদের কর্ম তৎপরতার ওপর অব্যাহত নজরদারির মাধ্যমে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। এই প্রত্যাশায়, যাতে বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় ইসলামি আদর্শের সমাজ গঠনে সফল হওয়া যায়। (وكذلك جعلناكم امه وسطا لتكونوا شهداء على الناس)
প্রতিনিধিবর্গ
গণপ্রতিনিধিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ পরিষদ, বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রস্তাবসমূহ এবং সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়ার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের কাজ পরিত্রাণকারী জীবন ব্যবস্থা ইসলামের প্রবর্তক নবী করিম (সা.)-এর হিজরতের পনেরো শতকের সূচনা লগ্নে, ওপরে উল্লিখিত প্রেরণা ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করে। এই প্রত্যাশায় যে, বিশ্বে মুসতাদআফীনের কর্তৃত্ব এবং মুসতাকবিরীনের পরাজয় নিশ্চিত হবে। এই সংবিধানে বারোটি পরিচ্ছেদ এবং একশ পঁচাত্তরটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছে।

সূত্র : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান, আল-হুদা পাবলিকেশন।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ

ইসলামিক কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন অর্গানাইজেশন হল ইরানি সংস্থাগুলির মধ্যে একটি যেটি সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের সাথে অধিভুক্ত; এবং 1995 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[আরও]

:

:

:

: