আন্তর্জাতিক কুদস দিবস এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি
৭ই আগস্ট ১৯৭৯ তারিখে মরহুম ইমাম খোমেইনি (রহ.) বলেছিলেন: ‘আমি ফিলিস্তিন থেকে এই দখলদার (ইসরাইল) এবং এর সমর্থকদেরকে উৎখাতের লক্ষে সকল মুসলিম ও মুসলিম সরকারকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং বিশ্বের সমস্ত মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদস দিবস হিসেবে নামকরণ করার এবং (ফিলিস্তিনি) মুসলমানদের আইনি অধিকারের সমর্থনে মুসলিমদের আন্তর্জাতিক সংহতি ঘোষণা করার। এই দিনটি ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের জন্য বিশ্বব্যাপী সমর্থনেরও প্রতীক।
জাতিসমূহ, মানবাধিকার কর্মী এবং নাগরিক সংগঠনসমূহের মিছিল,সভা-সমাবেশ, এবং র্যালির মাধ্যমে দিনটি উদযাপিত হয় এবং ইমাম খোমেইনির এই অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ঘোষণা স্পষ্টতই অপরিসীম গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
1800 সালের শেষের দিকে ইহুদিদেরকে একত্রিত করার জন্য ‘ইহুদিবাদ’ একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে এবং এর ফলে ফিলিস্তিনের জায়গায় জোরপূর্বক একটি অবৈধ ও জারজ ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়; তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে 1948 সালে মাত্র 5% ইহুদি বাসিন্দাদের অধিকৃত এ স্থান পশ্চিমা শক্তি দ্বারা তাদের বলে ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়।
নয় শতাব্দী আগে যখন খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা জেরুজালেমের ইহুদিদেরকে তাদের উপাসনালয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছিল, তখন মুসলিম সালাউদ্দিনই ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং এই অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে তাদেরকে বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এবং 800 বছর পরে নিউ ইয়র্কের ফ্লাশিং মেডোতে জাতিসংঘের সদর দফতরের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি মুসলমানদেরকে তাদের অতীত কৃপার প্রতিদান এভাবেই দেওয়া হয়েছিল।
ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর আধিপত্য বিস্তার অথবা অন্যরা যাকে অজ্ঞতাবশত মধ্যপ্রাচ্যের অবিরাম সংঘাত হিসাবে উল্লেখ করে, সে সম্পর্কিত সমস্ত রোড ম্যাপের প্রধান আলোচক এবং প্রধান স্থপতি ছিল আমেরিকা। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো: সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শান্তি আলোচনায় কি কোনো বাস্তব সাফল্য ছিল? ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি কোনো আশা আছে?
সংঘর্ষের অপর দিকটি আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় নির্মাতাদের লাভজনক অস্ত্র ব্যবসাকে তুলে ধরে।
অনেক লোক মনে করেছিল যে, যেহেতু আরব লীগ ১৯৪৫ সালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল তাই তাদের নীতিগুলোকে সমন্বয় করতে এবং তাদের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু লীগের সফলতাগুলো কী ছিল? লীগ এবং এর সহযোগী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যের কতটুকু অর্জন করতে পেরেছিল?
প্রশ্ন হলো আরব লীগ এবং পিএলও যা আরববাদ বা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তা কীভাবে ফিলিস্তিনকে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে যখন একই জাতীয়তাবাদকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল? সুতরাং,কোনো সন্দেহ নেই যে আন্তর্জাতিক কুদস দিবসই একমাত্র ব্যবস্থা যা মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ এবং প্রথম কিবলা আল-কুদসের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।
মুসলিম জাতির ঐক্যই প্রকৃতপক্ষে ইমাম খোমেইনির বাণীর মূল প্রতিপাদ্য এবং ফিলিস্তিন ও বিশ্বের অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের মুক্তির চূড়ান্ত আশা। 1911-1921 সালের ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স জর্জ কার্জন বলেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই এমন কিছুর অবসান ঘটাতে হবে যা মুসলমানদের সন্তানদের মধ্যে ইসলামি ঐক্য নিয়ে আসে। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই খেলাফত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে সফল হয়েছি,তাই আমাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, মুসলমানদের জন্য আর কখনই ঐক্য সৃষ্টি হবে না- তা বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক ঐক্য যেটাই হোক না কেন।’ এ কারণেই ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ি বলেছেন, যে আইএসআইএস স্পষ্টভাবে এই অঞ্চলে বিভেদ ও বিভেদের বীজ বপন করে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করে। পবিত্র কোরআনে এ সত্য সম্পর্কে বলা সত্ত্বেও যে,‘এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত হয়ো না’- সূরা আলে ইমরান : 103
সীমানাবিহীন সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়,আন্তর্জাতিক কুদস দিবস হলো ফিলিস্তিনিদের ও অন্যান্য নিপীড়িত জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের এবং তাদেরকে সমর্থন করার এবং সমস্ত মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে নিপীড়ন ও অবিচারের নিন্দা করার দিন। প্রয়াত ইমাম তিক্তভাবে বর্ণবাদকে অস্বীকার করেন এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে সাহায্য করেন। অন্যদিকে,ম্যান্ডেলা বলেছিলেন: ‘দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল।’ দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তির পর তেহরানে তাঁর প্রথম সফরে তিনি ইমামের পিতাসুলভ ভূমিকা এবং ইরানের ঐতিহাসিক সমর্থনের প্রশংসা করেন। প্রয়াত হুগো শ্যাভেজ এই দিনটি পালন করেছিলেন যেখানে তাঁকে অনুষ্ঠানসমূহে তাঁর দেশের অন্যান্য প্রতিবাদকারীদের সম্মুখসারিতে দেখা যেত।
অবৈধভাবে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে চলমান নৃশংসতাকে উপেক্ষা করে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা 2015 সাল থেকে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জড়িত;যা হলো সবচেয়ে দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী মুসলিম আরব জাতির ইচ্ছাকৃত আগ্রাসন। ইয়েমেনে আগ্রাসনের পরিণতিকে জাতিসংঘ সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সারা বিশ্বে শান্তির রাজত্ব ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের প্রচেষ্টাকে স্বীকার করা অপরিহার্য। যেমনটি ইমাম গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন- ‘কুদস দিবস একটি সর্বজনীন দিন। এটি কেবলই কুদসের জন্য একটি বিশেষ দিন নয়। এটি নির্যাতিতদের জন্য উদ্ধতদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ও রুখে দাঁড়ানোর জন্য দিন।”
ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ক্রমাগত সামরিক ও আর্থিক সহায়তা এবং এই অঞ্চলে তাদের অবিরাম হস্তক্ষেপ সেখানকার জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণকে ব্যাহত করছে যে বিষয়ে বিশ্ব ভালোভাবেই অবগত। এটি তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর মিথ্যাকে উন্মোচিত করে যারা সারা বিশ্বে মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রচারে নেতৃস্থানীয় অবস্থান দাবি করে। কী দ্বৈত ভূমিকা!
আমরা যেন ভুলে না যাই যে ইসরাইল সন্ত্রাসের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে এবং তা টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত সন্ত্রাস ও নিপীড়নের আশ্রয় নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক কুদস দিবসে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার সময় সকল ন্যায়বিচারকামী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থা ফিলিস্তিনি ও ইয়েমেনের জনগণের বিরুদ্ধে অবিরাম বর্বরতা ও নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে থাকে ।
আন্তর্জাতিক কুদস দিবস এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি | |