কারবালার চিরন্তন আহ্বান
মো. মাঈনউদ্দীন
৬১ হিজরির যে ঘটনাটি মানবেতিহাসের পাতায় সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান তা হলো কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনা। যুগযুগ ধরে ফোরাত কূলে সংঘটিত এ ঘটনা একদিকে যেমন মানুষের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে, নবী-পরিবারের বিয়োগান্তক বেদনায় মানুষ অশ্রু বিসর্জন দেয়, অপরদিকে এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানবতার জন্য অসংখ্য অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও পরতে পরতে সফলতার পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। কারবালার ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহ আলোচনা করা বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য নয়; বরং সমসাময়িক বিশ্ব ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা থেকে আমরা কী দিকনির্দেশনা নিতে পারি তাই আলোচ্য বিষয়। কারণ, আজকের সমাজ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মুসলমানদের জন্য যে চিত্র অঙ্কন করছে তা অনেকটা ইয়াযিদী যুগের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। প্রারম্ভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সে উক্তি যেখানে তিনি তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, তা উল্লেখ করতে চাই।
إنّى لمْ أخْرجْ أشرًا ولا بطرًا ، ولا مفْسدًا ولا ظالمًا ، وإنّما خرجْت لطلب الإصْلاح في أمّة جدّي ، أريد أنْ آمر بالْمعْروف وأنْهى عن الْمنْكر ـ
আমি না ভ্রমণের জন্য বের হয়েছি, না পৃথিবীতে ফেসাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কিংবা না জুলুম করার জন্য বের হয়েছি। আমি কেবল আমার নানার উম্মতের সংস্কারের জন্য বের হয়েছি। আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে চাই।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ উক্তিতে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে আমরা কারবালা থেকে নেয়া কয়েকটি শিক্ষা যা ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব।
১. মানবিক ও নৈতিক নীতির ওপর দৃঢ় থাকা : খোদায়ী মানুষ চরম প্রতিকূল পরিবেশেও কখনো মানবিকতা ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন না। এ প্রসঙ্গে আমরা কারবালার ঘটনা বর্ণনা করতে পারি। যখন হোর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পথরোধ করে দাঁড়ালেন তখন ইমামের সঙ্গিগণ হোর ও তার বাহিনীকে তাৎক্ষণিক নির্মূল করার পরমার্শ দিলেন। এ যুক্তিতে যে, হোরের বাহিনীকে ধ্বংস করার মতো সামর্থ্য তাঁদের ছিল। কিন্তু ইমাম সেখানে ধৈর্যধারণ করলেন ও এ কাজে সমর্থন দেন নি।
২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ : কারবালার ঘটনার শিক্ষাসমূহের অন্যতম হলো : দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করাÑ সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ। ইমাম হোসাইন (আ.) মদিনা থেকে বিদায়বেলায় তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার উদ্দেশে লিখেছিলেন : ‘…আমি চাই সৎকাজের আদেশ দিতে এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে।’
ইমামের এ বক্তব্যটি পবিত্র কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতের প্রতিস্মৃতি যেখানে মহান আল্লাহ উম্মত হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ উল্লেখ করেছেন : كنتمْ خيْر أمّةٍ أخْرجتْ للنّاس تأْمرون بالْمعْروف وتنْهوْن عن الْمنكر وتؤْمنون باللّه ۗ অর্থাৎ তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটনো হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে।
৩. আপোসহীনতা : ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বাইয়াতের প্রস্তাবে বলেছিলেন : مثلى لا يبايع مثله ‘আমার মতো কেউ তার (ইয়াযীদের) মতো কারো হাতে বাইয়াত করবে না।’ বিষয়টি হলো ন্যায়-অন্যায়ের, আলো-আঁধারের। ইমাম হোসাইন (আ.) ন্যায় ও আলোর প্রতীক হিসেবে অন্যায় ও অন্ধকারে নিমজ্জিত কারো হাতে বাইয়াত করতে পারেন না।
৪. আত্মসম্মানবোধ : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে অন্যায়ের নিকট মাথা নত করাটা ছিল অপমানজনক। তিনি সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করেন موت فی غز خیر من حیاة فی ذل ‘সম্মানজনক মৃত্যু অপমানজনক জীবন থেকে উত্তম।’ আজকের যুগে যাঁরা মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে যাঁরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ বাণী থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তাঁরা শত কষ্টক্লেশের মধ্যেও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি। এমনকি জীবন বিপন্ন হলেও। আত্মসম্মানবোধহীন নেতৃত্বের কারণেই একটি জাতি লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হয়।
৫. মহান আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) : ইমাম হোসাইন (আ.) কুফা অভিমুখে যাওয়ার পথেই কুফার জনগণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও হযরত মুসলিম ইবনে আকীলের শাহাদাতের সংবাদ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন নি; বরং কর্তব্যপরায়ণতার জন্য তিনি তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করেছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রতি হাত তুলে বলেছিলেন : ‘প্রভু হে! সব দুঃখ-কষ্টে আপনিই আমার ভরসাস্থল; আপনিই আমার আশার স্থল সব ক্লেশে।
৬. আল্লাহর নিকট সমর্পণ ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট : কারবালার অন্যতম শিক্ষার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকা। ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালার প্রান্তরে তাঁর অতি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, নিজ পরিবার বন্দিদশায় পতিত হয়েছিল। ছয় মাসের শিশুকে পিপাসার্ত অবস্থায় নিজ হাতের ওপর শহীদ হতে দেখেছেন; সব কষ্টই তিনি সহ্য করেছিলেন একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মহান প্রভুর দরবারে সমর্পণ করেছিলেন। নিজ কলিজার টুকরা আলী আসগরের রক্ত আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন : ربّنا تقبل هذا القليل ‘প্রভু হে! এ সামান্যটুকু আপনি কবুল করুন।’
ইমাম হোসাইন (আ.) যখন মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হলেন তখন স্বয়ং এ বিষয়টির প্রতি ইশারা করেছিলেন : ‘আমরা নবীর আহলে বাইত, মহান আল্লাহ যা কিছুতে সন্তুষ্ট থাকেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকি। তাঁর পরীক্ষা ও বালার বিপরীতে ধৈর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বন করি। তিনি ধৈর্যধারণকারীদের পুরস্কার আমাদেরকে দান করবেন।’
৭. স্বাধীনচেতা : কারবালার ঘটনা হলো স্বাধীন চেতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বাইয়াতের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ইমামকে নিরাপদ থাকার শর্তস্বরূপ। ইমাম (আ.) বললেন : ‘জেনে রাখ! নাপাকের জন্ম নাপাক, আমাকে অপমান আর মৃত্যুÑ এ দুয়ের মাঝে থাকতে বাধ্য করেছে। কিন্তু هيهات من الذلة ধিক্! অপমানের জীবন আমাদের থেকে দূরে থাক। মহান আল্লাহ অপমানের জীবন মেনে নেয়া আমাদের জন্য, নবিগণের জন্য ও মুমিনদের জন্য সমীচীন করেন নি।’
৮. ইখলাস বা একনিষ্ঠতা : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীদের কারবালায় তাঁর সাথে থাকার কারণ কী ছিল? হয়ত কারবালায় আসা পর্যন্ত ইমামের সঙ্গী হয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু যখন মৃত্যু অবধারিত, বেঁচে থাকার কোন আশা নেই, তখনও ইমামকে যাঁরা ছেড়ে যান নি তাঁরা কিসের আশায় ছিলেন? গণিমত, ধন-সম্পদ লাভের তো কোন আশাই ছিল না। একমাত্র ইখলাস বা একনিষ্ঠতা ছাড়া এর কোন কারণ নেই। ইমাম স্পষ্ট ভাষায় তাঁর সঙ্গীদেরকে বলেছিলেন : ‘তারা শুধু আমাকে হত্যা করতে চায়, তোমাদের ওপর থেকে বাইয়াত তুলে নিলাম। বাতি নিভিয়ে দিলাম, তোমরা রাতের অন্ধকারে চলে যাও।’ কিন্তু কেউই ইমামকে ফেলে যান নি। সুতরাং ইখলাসের চরম পরাকাষ্ঠার চিত্রায়ন হয়েছিল কারবালায়।
৯. ত্যাগ : কারবালার দৃশ্যপট ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যখন ইমাম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গীরা সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁরা যতক্ষণ জীবিত আছেন ততক্ষণ নবী-পরিবারের কোন সদস্যের গায়ে আঁচর লাগতে দিবেন না। আবার যখন নবী-পরিবারের পালা আসল তখন ইমাম তাঁর কলিজার টুকরা আলী আকবরকে প্রথম যুদ্ধে পাঠালেন। অনুরূপ হযরত আব্বাস যখন শত্রুর বুহ্য ভেদ করে ফোরাতের পানি হাতে তুলে নিলেন, মুহূর্তেই তাঁর মনে পড়ে গেল ইমাম ও তাঁবুতে থাকা নারী-শিশুদের তৃষ্ণার্ত চেহারাগুলো। তাদের আগে পানি পান করবেন না বলে মশক নিয়ে ছুটে চলেছিলেন তাঁবুর দিকে। কিন্তু পথেই তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শত্রুর তীরের আঘাতে শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন।
১০. কীর্তিকে অমর করে রাখা : ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন শাহাদাত তাঁর জন্য লিখা হয়ে গিয়েছে। কারণ, তিনি যেখানেই থাকতেন সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হতো। যদি মদিনা বা মক্কায় তাঁকে গুপ্তহত্যা করা হতো তবে তাঁর শাহাদাতের ফল খুব ¤্রয়িমাণ হতো। হয়তোবা কয়েক দশক পরেই সব কিছু ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু ইমাম মদিনা থেকে বের হয়ে মক্কায় চলে আসলেন; যখন দেখলেন গুপ্তঘাতকরা তাঁকে সেখানেই শহীদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তিনি হজ শেষ না করেই মক্কা থেকে বের হয়ে আসলেন। মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কারবালা এ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি একাধিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করেছিলেন। এমনকি যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তখন একটি চিরন্তন আহ্বান জানিয়ে তাঁর মিশন শেষ করেছিলেন : هل من ناصر ینصرنی ‘এমন কোন সাহায্যকারী কি আছ যে আমাকে সাহায্য করবে?’ ইমামের এ আহ্বানের ধ্বনি আজও ভক্তদের কানে ধ্বনিত হয়। যতদিন পৃথিবী থাকবে, যতদিন বিশ্বের মানবতার অস্তিত্ব থাকবে, ইমামের এ আহ্বান সবার জন্য, সর্বযুগে সর্বস্থানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে।
হয়তো সৌভাগ্যবানরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিবে। আর হতভাগারা চিরকাল হতভাগাই থেকে যাবে।
তথ্যসূত্র : ১. সিরায়ে পিশভায়ন ২. লুহুফ
কারবালার চিরন্তন আহ্বান | |