• Nov 10 2025 - 08:42
  • 13
  • : 3 minute(s)

দক্ষিণ খোরাসানের বিরজান্দ দুর্গ: যেখানে যুদ্ধ মিশেছে সংস্কৃতিতে

মাহুর পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক বিরজান্দ দুর্গ—যা বিরজান্দ সিটাডেল (আর্গ-ই বিরজান্দ) বা 'বিরজান্দ দুর্গ' নামেও পরিচিত।

মাহুর পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক বিরজান্দ দুর্গ—যা বিরজান্দ সিটাডেল (আর্গ-ই বিরজান্দ) বা 'বিরজান্দ দুর্গ' নামেও পরিচিত। এটি হল সেই নীরব, পাথুরে হৃদয়, যেখান থেকে ইরানের পূর্বাঞ্চলের দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের বিরজান্দ শহরটি প্রথম জীবন পেয়েছিল।

'বিরজান্দ দুর্গ' শহরের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি স্থানীয় জনগণের সহনশীলতার একটি জীবন্ত প্রমাণ, প্রতিরক্ষামূলক স্থাপত্যের একটি মাস্টারপিস এবং সাম্রাজ্য ও বাণিজ্যের স্রোতে গঠিত একটি অঞ্চলের স্থায়ী প্রতীক।

ইতিহাস ও অবস্থান

বিরজান্দ দুর্গকে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নানা নামে ডাকা হয়েছে — যেমন তাহ-এ-দেহ দুর্গ বা পইন-এ-শাহর দুর্গ (“শহরের নিচের দুর্গ”)।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই শক্তিশালী দুর্গ আশেপাশের সমতলভূমি পর্যবেক্ষণ করেছে। এর অবস্থান পাহাড়ের পশ্চিম দিকের সর্বোচ্চ বিন্দুতে, যেখান থেকে পুরো পুরোনো ও নতুন বিরজান্দ শহর দেখা যায়। এই কৌশলগত অবস্থানই দুর্গটির মূল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছিল- প্রতিরক্ষা।

যুদ্ধের দুর্গ: স্থাপত্য ও উদ্দেশ্য

বিরজান্দ দুর্গ ছিল একটি সামরিক পাহাড়ি দুর্গ, রাজপ্রাসাদ নয়। এটি ছিল সৈন্য ও প্রহরীদের ঘাঁটি, যারা শহরের নিরাপত্তা রক্ষা করত এবং বাইরের খবর পৌঁছে দিত।

দুর্গের নকশা ছিল প্রায় চারকোনা, আয়তনে প্রায় ৩,০০০ বর্গমিটার।

প্রতি কোণায় চারটি শক্তিশালী টাওয়ার এবং পূর্ব ও পশ্চিমে আরও দুটি টাওয়ার নির্মিত ছিল।

গঠনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে স্থানীয় উপাদান যেমন- ইট, কাদা ও মাটির গাঁথুনি—যা তাকে দিয়েছে দৃঢ়তা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব।

বৃত্তাকার টাওয়ারগুলোতে ছিল ছোট ছোট ছিদ্র (লুপহোল), যেখান থেকে সৈন্যরা শত্রুর গতিবিধি নজর রাখতে এবং প্রতিরোধ চালাতে পারত।

দেয়ালের গঠন এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে প্রহরীরা চারদিক দেখতে পারে এবং কেউ গোপনে আরোহন করতে না পারে।

সর্বোচ্চ সময়ে দুর্গটিতে সাতটি টাওয়ার ছিল, যার মধ্যে ছয়টি আজও অটুট। উত্তর ও পশ্চিম দিকের দুটি প্রধান ফটক ছিল দুর্গের প্রবেশপথ।

দুর্গের ভেতরে পানির ও খাবারের মজুত থাকত — দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য নয়, বরং জরুরি পরিস্থিতির জন্য।

যখন তুর্কমেন বা উজবেক বাহিনী আক্রমণ করত (সাফাভি থেকে কাজার যুগ পর্যন্ত), তখন এই দুর্গ পরিণত হতো পুরো শহরের আশ্রয়স্থলে।

নাগরিকরা, ব্যবসায়ী, কারিগর, সৈন্য ও তাদের পরিবাররা নিজেদের সম্পদসহ দুর্গে আশ্রয় নিত। তাদের নিরাপদ পালানোর জন্য ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক ছিল, যা দুর্গটিকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সঙ্গে যুক্ত করত— যেমন বাহারেস্তান সিটাডেল, কলাহ ফারাঙ্গি দুর্গ ও কাসবে কানাত।

সাফাভি থেকে কাজার যুগ পর্যন্ত

ইতিহাসবিদদের ধারণা, দুর্গটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল সাফাভি যুগে (১৬শ শতাব্দী), যা ছিল বিরজান্দ শহরের প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু। কিছু গবেষক আরও প্রাচীন উৎসের কথাও বলেন, কিন্তু ১৬শ শতাব্দীর পর থেকেই এটি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

এই সময় থেকেই বিরজান্দ শহর বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে, কারণ এটি ইস্ফাহান থেকে আফগানিস্তান (কান্দাহার) ও ভারতের সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্যপথে অবস্থিত ছিল।

সাফাভি আমলের শেষ দিকে বিরজান্দ আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নরেট অব কায়েনাতের কেন্দ্র হয়, যা শাসন করত প্রভাবশালী আলাম পরিবার।

নাদির শাহ-এর যুগে (১৮শ শতাব্দী) আমির ইসমাইল খান খুজাইমা গভর্নর নিযুক্ত হন এবং বিরজান্দ আরও সমৃদ্ধ হয়।

১৯শ শতাব্দীর শুরুতে এটি “দার আল-মুলক কাহেস্তান” নামে পরিচিত হয়— অর্থাৎ 'কাহেস্তানের রাজধানী শহর'।

কাজার যুগে দুর্গটি আবার সংস্কার করা হয় এবং শহরের প্রতিরক্ষায় প্রধান ভূমিকা রাখে। যদিও পানির সংকট ছিল, তবুও শহর বাণিজ্যে ক্রমে সমৃদ্ধ হতে থাকে।

২০শ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ নির্মিত করাচি–জাহেদান রেলপথ চালু হলে বিরজান্দ হয়ে ওঠে ভারত ও ইউরোপীয় পণ্যের একটি বাণিজ্যকেন্দ্র।

জীবন্ত ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দুয়ার

আজকের দিনে বিরজান্দ দুর্গ সংরক্ষিত ও সংস্কার করা হয়েছে (প্রথমবার ১৯৯৯ সালে) এবং এটি এখন ইরানের একটি নিবন্ধিত জাতীয় ঐতিহ্যস্থান।

দুর্গের মাঝের উঠোনে এখন সাজানো বালির মেঝে ও সবুজ গাছপালা, আর একটি বড় তিনধাপ বিশিষ্ট মঞ্চ, যা স্থাপত্যের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এখন এটি আর সামরিক দুর্গ নয়, বরং এক সংস্কৃতি কেন্দ্র, যেখানে স্থানীয় হস্তশিল্প প্রদর্শনী হয়—চামড়ার কাজ, বস্ত্রবয়ন, ও ঐতিহ্যবাহী হস্তনির্মিত সামগ্রী প্রদর্শিত হয়।

দুর্গের প্রাচীরে উঠে দাঁড়ালে পুরো বিরজান্দ শহরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ে—এক নজরে বোঝা যায়, কেন একসময় এটি ছিল এত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।

যদিও বিরজান্দ দুর্গ শহরের ঐতিহ্যের মুকুট, তবুও দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশে আরও অনেক ঐতিহাসিক দুর্গ আছে— যেমন ফুর্গ সিটাডেল (সবচেয়ে মহিমান্বিত বলা হয়), নেহবানদান দুর্গ, শাহদিজ দুর্গ এবং তাবাস সিটাডেল। প্রতিটি নিজ নিজ কাহিনি বলে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

বিরজান্দ দুর্গ শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, এটি এক জীবন্ত নিদর্শন — যা যুদ্ধ, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের অদম্য মনোবলকে আজও বহন করে চলেছে।#

পার্সটুডে

Dhaka Bangladesh

Dhaka Bangladesh

.

:

:

:

: