
পার্সিয়ান কার্পেট
পার্সিয়ান কার্পেট
শৈল্পিক চমৎকারিত্বের পরম উৎকর্ষ পার্সিয়ান কার্পেটের ইতিহাস ২৫০০ বছরের পুরোনো। ইরানিরা প্রাচীন সভ্যতার অগ্রগামী কার্পেট বুননকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল,যারা শতবর্ষের সৃজনশীলতা এবং দক্ষতার মাধ্যমে একটি উচ্চতর অবস্থান অর্জন করেছে। পিতারা বংশপরম্পরায় তাদের ছেলেদের হাতে কার্পেট বুননের কারিগরি কৌশলকে তুলে দিত,যারা সেই কৌশলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এবং তাদের সন্তানদের কাছে এটি ছিল সুরক্ষিত পারিবারিক গোপনীয় বিষয়। পার্সিয়ান কার্পেটের ইতিহাস খুঁজে বের করা হলো বিশ্বের অন্যতম মহান সভ্যতার সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ সম্পর্কে জানা।
যাযাবর উপজাতিরা ঠাণ্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ জিনিস হিসেবে মেঝে বা প্রবেশপথের আচ্ছাদন হিসেবে কার্পেট ব্যবহার করত।
সাইরাস দ্য গ্রেট যখন ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলন জয় করেছিলেন তখন তিনি এর জাঁকজমক দেখেছিলেন এবং সম্ভবত তিনিই পারস্যে কার্পেট তৈরির শিল্পের প্রবর্তন করেছিলেন। যাইহোক,ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলো থেকে বোঝা যায় যে চমৎকার কার্পেটগুলো সাইরাস দ্য গ্রেটের দরবারে শোভা পেয়েছিল,যিনি ২৫০০ বছর আগে পারস্যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটাও বলা হয় যে সাইরাসের সমাধি,যাকে পার্সেপোলিসের কাছে পাসারগাদে সমাহিত করা হয়েছিল,তা মূল্যবান কার্পেট দিয়ে আবৃত ছিল। এমনকি তার সময়ের আগেও সম্ভবত পারস্য যাযাবররা গিঁটযুক্ত কার্পেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানত। এই কাজে তারা ভেড়া ও ছাগলের পাল থেকে উচ্চ মানের ও টেকসই পশম সংগ্রহ করত।
কার্পেটের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম নথিভুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় সাসানি রাজবংশের (২২৪-৬৪১ খ্রিস্টাব্দ)সময়কালের চীনা গ্রন্থ থেকে।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হেরাক্লিয়াস সাসানিদের রাজধানী টিসেফোন জয়ের পর বিভিন্ন ধরনের কার্পেট নিয়ে আসেন। আরবরা ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে টিসেফোন জয় করে এবং
তাদের অর্জিত জিনিসগুলোর মধ্যে অনেক কার্পেট ছিল বলে জানা যায়, যার মধ্যে একটি ছিল বিখ্যাত বাগান-কার্পেট,যার নাম ছিল ‘খসরুর বসন্তকাল’।
এই কার্পেটটিকে ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে মূল্যবান কার্পেট বলে মনে করা হয়। (প্রথম) খসরুর (৫৩১-৫৭৯ খ্রি.) শাসনামলে তৈরি কার্পেটটি ছিল ৯০ বর্গফুট।
আরব ঐতিহাসিকদের বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘প্রান্তভাগটি ছিল নীল,লাল,সাদা,হলুদ ও সবুজ পাথরের একটি চমৎকার ফুলের বিছানা;পশ্চাৎপটে জমিনের রঙকে সোনা দিয়ে শোভামণ্ডিত করা হয়েছিল;
স্ফটিকের মতো পরিষ্কার পাথরগুলো দেখতে পানির মতো মনে হতো;গাছপালাগুলো রেশম দ্বারা এবং ফলগুলো রঙিন পাথর দ্বারা গঠিত হয়েছিল।’
আরবরা এই চমৎকার কার্পেটটিকে কেটে অনেকগুলো টুকরো করেছিল,যা পরে আলাদাভাবে বিক্রি করা হয়েছিল।
আরব খলিফাদের আধিপত্যের সময়কালের পরে একটি তুর্কি উপজাতি সেলজুক পারস্য জয় করেছিল। উপজাতি প্রধানের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল সেলজুক শাসনামল। সেলজুক আমল (১০৩৮-১১৯৪ খ্রিস্টাব্দ) পার্সিয়ান কার্পেটের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেলজুক মহিলারা দক্ষ কার্পেট প্রস্তুতকারক ছিল যারা তুর্কি গিঁট ব্যবহার করত। আজারবাইজান ও হামাদান প্রদেশে যেখানে সেলজুক প্রভাব সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল সেখানে আজও তুর্কি গিঁট ব্যবহার করা হয়।
পার্সিয়ান কার্পেট ১৬ শতকে সাফাভি রাজবংশের শাসনামলে শীর্ষস্থানে পৌঁছেছিল। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাদুঘরে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রায় ১৫০০টি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। শাহ আব্বাসের রাজত্বকালে (১৫৮৭-১৬২৯ খ্রি.) পারস্যে বাণিজ্য ও কারুশিল্পের উন্নতি ঘটে।
শাহ আব্বাস ইউরোপের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন এবং তার নতুন রাজধানী ইসফাহানকে পারস্যের অন্যতম গৌরবময় শহরে রূপান্তরিত করেন। তিনি কার্পেটের জন্য একটি কারখানাও তৈরি করেছিলেন যেখানে দক্ষ ডিজাইনার ও কারিগরদেরকে চমৎকার কার্পেট তৈরি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল।
এই কার্পেটের বেশির ভাগই রেশমের তৈরি,সোনা ও রুপার সুতা এর শোভাকে আরো বর্ধিত করে। সাফাভিদের আমলের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি কার্পেট ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে আরদেবিল মসজিদ থেকে আনা হয়েছিল। অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে এই কার্পেটগুলো কার্পেট ডিজাইনে চূড়ান্ত উৎকর্ষের প্রতিনিধিত্ব করে। দুটি কার্পেটের মধ্যে বড়টি এখন লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে এবং অন্যটি লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তিকে এবং কাজার শাসকদের শাসনামলে বাণিজ্য ও কারুশিল্প তাদের গুরুত্ব ফিরে পায়। তাবরিজ বণিকরা ইস্তাম্বুল হয়ে ইউরোপে কার্পেট রপ্তানি করার সাথে সাথে কার্পেট তৈরি শিল্প আরও একবার বিকাশ লাভ করে। ১৯ শতকের শেষে কিছু ইউরোপীয় ও আমেরিকান কোম্পানিগুলো পারস্যে ব্যবসা শুরু করে এবং পশ্চিমা বাজারের জন্য হস্তশিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োজিত হয়।
বর্তমানে কার্পেট বুনন ইরানের সবচেয়ে ব্যাপক হস্তশিল্প। পার্সিয়ান কার্পেটগুলো রঙের প্রাচুর্য, বিভিন্ন দর্শনীয় শৈল্পিক নকশা এবং ডিজাইনের গুণমানের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বজুড়ে প্রাসাদ,বিখ্যাত ভবন,বড় বিল্ডিং এবং জাদুঘরগুলোতে পারস্যের কার্পেট সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তির মধ্যে একটি।
প্রধান বয়ন কেন্দ্র:
আরাক, আরদেবিল, বিজার, হামাদান,ইসফাহান,কাশান, কেরমান, মাশহাদ, নাইন, কোম, সানান্দাজ, শিরাজ, তাবরিয, তেহরান, ইয়ায্দ,জানজান।
অন্যান্য কেন্দ্র:
আবাদেহ, আফশার,ঘোটলু, আহর, আমোল, আনজেলাস আরদকান, বাফ্ট, বখতিয়ার, বালুচ, বাম, বন্দর তুর্কমান, বেহবাহান,বিদগোল,বোরচেলু, বোরুজেরদ,চেনার,দারাব,দারজেজিন,ফারাহান, ফিরোজাবাদ,গারাভান, ঘোটলগ,গোলখার,গোলপায়গান, গোম্বাদ, হারিস, হোসেইনাবাদ, জুরকান, কাবুদার, আহং, কাশমার, কোলিয়াই খামসেহ, খুই,খোসরোবাদ, লোরেস্তান, মাহল্লাত, মাকউ, মালায়ের, মাহাবাদ, মোশকাবাদ, মোঘান, মিয়ানে, নাজাফাবাদ, নাতানজ, নাহাভান্দ,নিরিজ, নিশাবুর, কাশগে,কাযভীন, কৌচান, রাফসানজান, রাভার, রুদবার, সামান, সারমিলাক, সরুক, সেমনান, সেনেহ, সিরজান, শাহরে কোর্দ,শাহরেজা, শাহর বাবাক, শাহরৌদ, শাহসাভান, তাবাস,তোরবাত হেইদারিয়ে, তৌসিরকান, তাজাবাদ, তাফরেশ, তুর্কামান সাহরা, ভারামিন, ভিজ, ইয়াসুজ,যারান্দ।
পার্সিয়ান কার্পেট | |

