সমগ্র মানবতার কবি নেজামি গাঞ্জাভি
ফারসি সাহিত্য ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান কবি নেজামি গাঞ্জাভি।
ফারসি সাহিত্য ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান কবি নেজামি গাঞ্জাভি। ফারসি সাহিত্যে ‘খসরু ও শিরিন’ কাব্য সংকলনের সুরেলা রোমান্টিক এবং গীতিকবিতার রচয়িতা তিনি।
নেজামি গাঞ্জাভির প্রকৃত নাম জামাল আদ-দীন আবু মুহাম্মাদ ইলিয়াস ইবনে-ইউসুফ ইবনে-জাক্কি। তিনি ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর পারস্যের একজন মুসলিম কবি। তাকে ফারসি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্টিক মহাকবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ফারসি মহাকাব্যে একটি কথ্য ও বাস্তবসম্মত শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন এবং তার এ ঐতিহ্যধারাকে ইরান, আফগানিস্তান, আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, কুর্দিস্তান অঞ্চল এবং তাজিকিস্তানে ব্যাপকভাবে প্রশংসা করা হয়। বর্ণনামূলক কবি হিসেবে তিনি ইরানের বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের কবি ও ‘শাহনামা’ (রাজাদের বই) এর লেখক আবুল-কাসেম ফেরদৌসি তুসি (আনুমানিক ৯৪০ থেকে ১০২০ খ্রিস্টাব্দ) এবং দিওয়ান-ই কাবির (মহান দিভান) ও কিতাব-ই মসনভিয়ে মা’নাভির (আধ্যাত্মিক যুগল) লেখক (১২০৭-১২৭৩) জালালুদ্দিন রুমির এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। নেজামির বর্ণনামূলক কবিতা ফেরদৌসি বা রুমির চেয়েও ব্যাপক। এতে মানব সম্পর্কের রোমান্টিক মাত্রার পাশাপাশি বীরত্বও রয়েছে এবং তা অভূতপূর্ব গভীরতা ও বোঝাপড়ার সাথে মানব মানসিকতাকে গভীরভাবে তুলে ধরে। নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে, একটি গভীর আধ্যাত্মিক চেতনা তার কবিতায় বিস্তৃত। নেজামি কবিতার ভাষার তুলনামূলক প্রসার ঘটিয়েছেন। তিনি ইরানের প্রথম কবিদের মধ্যে ছিলেন যিনি দরবারি কবিতার গীতি শৈলীকে এর অলঙ্কারপূর্ণ জটিলতা এবং রূপক ঘনত্বের সাথে বর্ণনামূলক ফর্মের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। নেজামির কাছে কবিদের স্বর্গীয় মর্যাদা রয়েছে। তিনি বারবার তার বইয়ে বক্তৃতার গঠন এবং এর শিক্ষামূলক দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং কবিতাকে কুরআনের মতোই স্পষ্ট নৈতিক দিকনির্দেশনার উৎস হিসেবে তুলনা করেছেন। তার সময়ের জন্য এটি ছিল একটি সাহসী দাবি। মাখজান আল-আসরার (দ্য ট্রেজার হাউস অফ মিস্ট্রিজ) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশ ছিল বক্তৃতা…. বক্তৃতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো কণ্ঠস্বর নেই।’ তাঁর নাম ছিল ইলিয়াস এবং কবিনাম ছিল নেজামি। তিনি গাঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সমগ্র জীবন একই অঞ্চলে কাটিয়েছেন বলে মনে করা হয়। প্রায় পঁচাত্তর বছর পরে সেখানেই তিনি মারা যান। নেজামি এমন এক সময়ে বাস করতেন যখন ইরান বা আরও সঠিকভাবে বললে, ভূমধ্যসাগর থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ইসলামি বিশ্ব একটি মহান সাংস্কৃতিক প্রসারের সময় উপভোগ করছিল। তাঁর কবিতাগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি কেবল আরবি ও ফারসি সাহিত্য এবং মৌখিক ও লিখিত জনপ্রিয় এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে সম্পূর্ণ পরিচিত ছিলেন না, বরং তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, কোরানের ব্যাখ্যার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাথেও পরিচিত ছিলেন। ইসলামি তত্ত্ব এবং আইন, ইরানি পুরাণ এবং কিংবদন্তি, ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র, দর্শন এবং গুপ্ত চিন্তা, সঙ্গীত, এবং ভিজ্যুয়াল আর্ট বিষয়ে তার জানাশোনা ছিল। তার দৃঢ় চরিত্র, সামাজিক সংবেদনশীলতা এবং মৌখিক ও লিখিত ঐতিহাসিক নথির জ্ঞান, সেইসাথে তার সমৃদ্ধ পারস্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাক-ইসলামিক এবং ইসলামি ইরানকে একত্রিত করে সাহিত্যিক অর্জনের একটি নতুন মান দিয়েছে। নেজামি মূলত ‘খামসেহ’ এর জন্য পরিচিত। এটির দুটি কপি ইরানে সংরক্ষিত আছে। ২০১১ সালে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার তালিকায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সূত্র: মেহর নিউজ।
.